গুজরাট দাঙ্গা থেকে নির্ভয়া ধর্ষণ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গেরুয়া সন্ত্রাসের তাণ্ডব থেকে সাম্প্রতিক সিটিজেন অ্যামান্ডমেন্ট বিল- গত দুই দশকের ভারতের কমবেশি প্রতিটা আন্দোলনেই রাজপথে একটা মুখ কমন ছিল, সেটা মৌসুমী ভৌমিকের।

তিনি গায়িকা, মাদকতা মিশে থাকে তার কণ্ঠে। অযুত-নিযুত তার ভক্তসংখ্যা, ফেসবুক-ইন্সটাগ্রামের এই যুগেও তার কাছে চিঠি আসে ভারত আর ভারতের বাইরে থেকে। সেসব চিঠিতে লেখা থাকে মুগ্ধতার কথা, কীভাবে কণ্ঠের জাদুমন্ত্রে তার প্রেমে পড়েছেন শ্রোতা, কীভাবে মোবাইলের ইয়ারফোন বা অডিও স্পিকারে হৃদয় ভাঙা মানুষের একাকী রাতের সঙ্গী হয়ে উঠেছেন তিনি- সেসব গল্প। 

তাকে লোকে বিখ্যাত বলে, কিন্ত শব্দটা নিজের নামের পাশে বসাতে নারাজ তিনি। ভদ্রমহিলা বলেন, 'আমি তো আপনাদেরই একজন, আমি আর আপনি মিলেই তো আমরা! আমি শিল্পী, আপনার কাছে আমি হয়তো জনপ্রিয়, কিন্ত তার আগে আমি একজন মানুষ, এই দেশের খুব সাধারণ একজন নাগরিক।' আর সেই নাগরিকত্বের দায় থেকেই গণমানুষের দাবী নিয়ে তিনি বারবার নেমে আসেন রাস্তায়, উত্তাল রাজপথের ছোট্ট একটা অংশ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। তার সুমধুর কণ্ঠস্বর বদলে যায়, তেজোদীপ্ত হয়ে ওঠে সেটা, আগুনের ফুলকি বেরোয় গলা থেকে, কণ্ঠ হয়ে ওঠে মেশিনগান। সেই অগ্নিগর্ভ কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেন মনুষ্যত্বের জয়গান। 

গুজরাট দাঙ্গা থেকে নির্ভয়া ধর্ষণ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গেরুয়া সন্ত্রাসের তাণ্ডব থেকে সাম্প্রতিক সিটিজেন অ্যামান্ডমেন্ট বিল- গত দুই দশকের ভারতের কমবেশি প্রতিটা আন্দোলনেই রাজপথে একটা মুখ কমন ছিল, সেটা মৌসুমী ভৌমিকের। নিজের শিল্পী পরিচয়কে যিনি ছাপিয়ে গিয়েছেন প্রতিবাদী স্বত্বা দিয়ে। গানের কথায় যিনি একাকীত্বের কথা বলেছেন, নিজের জন্যে বাঁচার গল্প শুনিয়েছেন, সেই মানুষটাই আবার রাজপথে হাজারো মুখের একজন হয়ে উঠেছেন প্রতিটি আন্দোলনে, প্রতিটি সংঘবদ্ধ প্রতিবাদে। 

এবারও নাগরিকত্ব সংশোধন বিল নিয়ে সমগ্র ভারত যখন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে, তখন চুপচাপ ঘরে বসে থাকাটা তো তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তিনি নেমে এসেছেন রাজপথে, নিজের আঁতুড়ঘর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া মিছিলের সামনের কাতারে দেখা যাচ্ছে তাকে প্রতিদিনই। মোলায়েম কণ্ঠে 'আমি শুনেছি সেদিন তুমি' গেয়ে যিনি আমাদের নিতান্ত আপন হয়ে উঠেছিলেন, সেই মানুষটাই গলার রগ ফুলিয়ে চিৎকার করে শ্লোগান দিচ্ছেন মোদি-শাহ'র অনাচারের বিরুদ্ধে। 

কখনও খড়গপুর, কখনও নিউ টাউন, আবার কখনওবা ধর্মতলার এসপ্লানেড- সব গণজমায়েতে মৌসুমী থাকছেন, হেঁটে চষে বেড়াচ্ছেন গোটা কলকাতা। যে শহরে তার বেড়ে ওঠা, যে শহরে তার মানসিক বিকাশ, সেই শহরটাকে একটা নির্দিষ্ট ধর্ম বা গোত্রের হাতে কুক্ষিগত তিনি হতে দেবেন না, দেশটাকে ধর্মের নামে ভাগাভাগি হতে দেখতে তার প্রচণ্ড আপত্তি। এই দেশ যতোটা হিন্দুর, ঠিক ততোটাই মুসলমানের, ততোটাই খ্রিস্টানের- সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করাটা সরকারের কাজ, আর সরকারকে বাধ্য করার কাজটা করবে জনগণ। সেই মিশনে মনের জোরকে শক্তি বানিয়ে মৌসুমী ছুটে চলেছেন নিরন্তর। 

পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুঁড়িতে জন্ম তার, বাবা-মায়ের চাকুরী সূত্রে বেড়ে উঠেছেন মেঘালয়ের শিলংয়ে। গানের প্রতি আগ্রহ ছিল ছোট থেকেই, শান্তিনিকেতনে শিল্পের সঙ্গে তার হাতেখড়ি। রবীন্দ্রনাথের গান, তার লেখা ভীষণ প্রভাবিত করেছিল তাকে, সেইসঙ্গে প্রেমে পড়েছিলেন লালন সঙ্গীতের। কবীর সুমনের গান তাকে মুগ্ধ করেছিল কৈশরেই। বাবা চমৎকার কবিতা লিখতেন, সেই গুণটা পেয়েছেন মৌসুমীও। শান্তিনিকেতন ছাড়ার পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে অনার্স- যাদবপুরের সেই চারটা বছরই মৌসুমীর ভেতরে সচেতন আর প্রতিবাদী স্বত্বাটাকে জাগ্রত করেছিল। 

বাংলাদেশের সঙ্গে মৌসুমী ভৌমিকের খুব গভীর একটা সংযোগ আছে, তার বাবা-মা দুজনেরই জন্ম হয়েছিল এই বাংলায়। একজনের বাড়ি পাবনা, অন্যজনের বরিশালে। দেশভাগের পর জলপাইগুড়িতে চলে গিয়েছিল সবাই। ২০০২ সালে তারেক মাসুদের 'মাটির ময়না' সিনেমার সঙ্গীতায়োজন করেছিলেন মৌসুমী ভৌমিক, নিয়মিতই তাকে দেখা যায় এপাড় বাংলায়। শেকড়ের টান তিনি ভোলেননি, বাংলার লালন সঙ্গীত আর বাউল গান নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরেই, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাউল গানকে তুলে ধরার জন্যে তার লড়াইটা এখনও চলছে। 

নিজেকে নির্দিষ্ট কোন দেশ বা সময়ের প্রতিনিধি হিসেবে মনে করেন না মৌসুমী। আমাদের সাংবাদিকেরা যখনই তাকে এপাড়ের মেয়ে বলে বলে আহ্লাদ করতে গিয়েছেন, মৌসুমী তাদের থামিয়ে দিয়েছেন, বলেছেন- 'আমার জীবনটা কোন নির্দিষ্ট দেশের ভেতরে আটকে নেই। আমি কোনো পূর্বপুরুষের জন্য এখানকার নই। আমি আমার জন্য এখানকার। আমিই এই জীবনটা তৈরি করেছি, হাতে করেই। উত্তরাধিকার সূত্রে পাইনি। এটা আমার কষ্টার্জিত জীবন। আমি ভালোবেসে বিশ্বাস করে রাজনৈতিকভাবে একটা বর্ডারকে অতিক্রম করে এক ধরনের জীবনযাপন করছি। আমি মনে করি এটাই একমাত্র পথ বাঁচার। এটাই আমার জীবন।'

স্পিকারে মৃদু ভলিউমে বাজছে মৌসুমীর গান- 'আস্থা হারানো এই মন নিয়ে আমি আজ, তোমাদের কাছে এসে দুহাত পেতেছি; আমি দুচোখের গহবরে, শূন্যতা দেখি শুধু, রাতঘুমে আমি কোন স্বপ্ন দেখি না; তাই স্বপ্ন দেখবো বলে, আমি দুচোখ পেতেছি...' মৌসুমী ভৌমিক তার দেশের নাগরিকদের কাছে স্বপ্ন দেখার আবদার করে দু'হাত পেতেই বসে থাকেননি, স্বপ্নকে পূরণ করার জন্যে ব্যক্তিগত 'জনপ্রিয়তা'কে বাড়ির অন্দরমহলে রেখে নেমে এসেছেন রাস্তায়, মিশে গিয়েছেন জনস্রোতের মাঝে। বাঙালীর তেজোদৃপ্ত মানসিকতা ঠিকরে পড়ছে তার ভেতর। মৌসুমীর জন্যে ভালোবাসা তো আগে থেকেই ছিল, সেই তেজী রূপটা দেখে এই মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধাটা বেড়ে গেলো বহুগুণে... 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা