এমন উন্নয়নের মুখে ওয়াক থু করে একদলা থুথু ফেলতে ইচ্ছে হয়, জাফর ইকবাল স্যারের মতো হড়হড় করে বমি করে সব ভাসিয়ে দিতে প্রচণ্ড ইচ্ছে করে, কিন্ত সেটা করা যায় না...

খালিদ রহমানের মায়ের অ্যাজমার সমস্যা ছিল। হালকা জ্বর এসেছিল সপ্তাহখানেক আগে। প্রচন্ড বুক ব্যথা আর পেট ব্যথার চিকিৎসার জন্যে মাকে নিয়ে খালিদ রহমান বারডেম গেছেন। বারডেম তাকে রাখেনি। তারা অজুহাত দেখিয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় থেকে নাকি নির্দেশ আছে, শ্বাসকষ্ট আর জ্বর আসা রোগীদের করোনার কারণে ভর্তি নেয়া যাবে না। তারা রোগীকে বারডেম থেকে মুগদা মেডিকেলে রেফার করছে। ছেলে তখন মাকে নিয়ে ছুটেছেন মুগদা মেডিকেলে, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে, সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে।

কেউ রাখেনি। কেউ না। অসুস্থ একজন রোগী, যার অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে, তাকে কেউ চিকিৎসা দেয়ার সাহস করলো না কেউ। মা কাতরাচ্ছেন, ছেলে বারবার বলছেন, তার মায়ের এজমার সমস্যা পুরানো। তাদের বাসার কেউ দেশের বাইরে যায়নি কিছুদিনের মধ্যে, বাইরে থেকে আসা কারো সংস্পর্শেও আসেনি। কেউ শোনেনি সেসব কথা। অন্য কোথাও যাওয়ার কথা বলেছে শুধু। ঢাকা মেডিকেলে করানো ইসিজি রিপোর্ট যে খারাপ ছিল, সেটাও তাকে জানানো হয়নি। খালিদ জেনেছেন গতকাল সন্ধ্যায় মাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের ডায়বোটিস হাসপাতালে যাওয়ার পর। 

খালিদ রহমানের মা মারা গেছেন আজ ভোরে, ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা থাকবে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট- সেখানে কোথাও কর্তৃপক্ষের গাফেলতির কথা লেখা থাকবে না, অসুস্থ মাকে নিয়ে উদভ্রান্ত অবস্থায় ঢাকা শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে খালিদের ছুটে বেড়ানোর গল্পটাও লেখা থাকবে না কোথাও। খালিদ ফেসবুকে সেই অবিশ্বাস্য গল্পটা শুনিয়েছেন, কীভাবে তিনি লিখেছেন আমি জানিনা। তবে এটুকু জানি, আমাদের গোল্ডফিশ মেমোরিতে এই ঘটনার ঠাঁই চব্বিশ ঘন্টার বেশি থাকবে না।

বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা লড়ছেন ঢাল তলোয়ার বিহীন নিধিরাম সর্দারের মতো করে

সরকার আমাদেরকে উন্নয়নের ফিরিস্তি শোনায়, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, জিডিপি, ব্লা ব্লা ব্লা। অথচ আমরা দেখি একজন মা মারা যাচ্ছেন বিনা চিকিৎসায়, একজন বৃদ্ধ বাবা চিকিৎসক সন্তানদের সামনেই ধুঁকতে ধুঁকতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন, কারণ কোন হাসপাতাল তাকে ভর্তি নিতে রাজী হচ্ছে না! ডাক্তারদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, আপনারা তাদের জন্যে নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি করতে পারেননি, তাদের কাছে মাস্ক নেই, করোনা  থেকে নিরাপত্তা দেয়ার মতো কোন পোষাক নেই, এমনকি পরীক্ষা-নীরিক্ষার যন্ত্রপাতিও নেই। তাদেরও তো জীবন আছে, বাসায় বৃদ্ধ বাবা-মা আছেন, রাতে তো তাদেরকেও ফিরতে হয় স্ত্রী-সন্তানের কাছে। প্রাণের মায়া তারা কেন করবেন না?

চীনে করোনার অফিসিয়াল ডিক্লারেশন এসেছে ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ, এখন মার্চের দুই তৃতীয়াংশ শেষ- আড়াই মাসের বেশি সময় পেয়েও যারা যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারে না, তারা অথর্বের চেয়েও অধম। হাসপাতালে যন্ত্রপাতি নেই, কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা নেই, হজ ক্যাম্প নিয়ে হাজারো অভিযোগ এসেছে, বিদেশ ফেরত যাত্রীদের ছেড়ে দিয়ে ভাইরাসের মচ্ছব বসানোর সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। দায়ী কে? 'কর্তৃপক্ষ'। হ্যাঁ, এখন সব কর্তৃপক্ষের দোষ। ভালো কিছু হলে সব ক্রেডিট যায় গণতন্ত্রের মানসকন্যার পকেটে, খারাপ কিছু হলেই সিস্টেমের ভুল, দোষ তখন কর্তৃপক্ষের ঘাড়ে। মনের ভেতরে প্রশ্ন জাগে, কেন লোকে 'ফাক দিস কান্ট্রি, ফাক দিস সিস্টেম' বলবে না?

জাস্টিন ট্রুডো থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প, বরিস জনসন থেকে নরেন্দ্র মোদি- সবাই এসে হাজির হয়েছেন মানুষের সামনে, অভয় দিচ্ছেন, সতর্ক থাকার আহবান জানাচ্ছেন, ভূটানের প্রধানমন্ত্রী তো নিজেই রাস্তায় নেমে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করছেন। ছোট দেশগুলোতে প্রধানমন্ত্রীরা হন রাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি, সবচেয়ে বড় সুপারস্টার। সেই জনপ্রিয়তাকে তারা কাজে লাগান, বিপর্যয়ের মুহুর্তে মানুষের কাছাকাছি নেমে আসেন। অথচ আমাদের দেশেও যে একজন প্রধানমন্ত্রী আছেন, সেটা ভুলেই গেছি! 

করোনা নিয়ে আতঙ্কিত হবার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি- বলেছেন ওবায়দুল কাদের

মন্ত্রীরা ভাঁড়ে পরিণত হয়েছেন অনেক আগেই, নির্বাচন কমিশন ভোটের আগে হাত ধোয়ার আয়োজন করছে, আওয়ামী লিগ প্রার্থী বলছেন, সাবান দিয়ে হাত ধোবেন, নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন। ওবায়দুল কাদের বলছেন,করোনায় নাকি আতঙ্কিত হবার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি! মানুষ দরকারের চেয়ে তিনগুণ বেশি বাজার করে সংকট তৈরি করছে, প্রতিটা জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে মিনিটের ব্যবধানে, করোনার আতঙ্কে রেগুলার পেশেন্টকেও ভর্তি করতে চাইছে না হাসপাতাল-অথচ করোনায় নাকি আতঙ্কিত হবার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি এখনও! তাহলে আতঙ্কিত হতে হবে কখন? ইস্রাফিল শিঙ্গায় ফুঁ দিলে? 

এসব দেখেশুনে এখন আর ক্লান্ত লাগে না। সবকিছু নিয়ে মজা করার অভ্যাস আমাদের মজ্জাগত। লাশের মিছিল শুরু হয়েছে, সেই মিছিলে অবশ্য খালিদের মায়ের কথা কেউ মনে রাখবে না- ওটা একটা কোলাটোরাল ড্যামেজ। উন্নয়ন পেতে হলে এরকম ছোটখাটো মৃত্যু মেনে নিতেই হবে, কিছু করার নেই। এমন উন্নয়নের মুখে ওয়াক থু করে একদলা থুথু ফেলতে ইচ্ছে হয়, জাফর ইকবাল স্যারের মতো হড়হড় করে বমি করে সব ভাসিয়ে দিতে প্রচণ্ড ইচ্ছে করে, কিন্ত সেটা করা যায় না...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা