এক মেয়ের মা হয়েছিলেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে। জীবন থমকে যাওয়ার কথা তখনই। কিন্তু ১২ বছর পর সেই মেয়েকে নিয়েই আজ তিনি বেরিয়ে পড়েছেন বিশ্বভ্রমণে। জীবনের রুপ-রস-বর্ণ-গন্ধ উপভোগ করছেন সর্বোচ্চ মাত্রায়।
কাছিমের সাথে সাঁতার কাটা থেকে শুরু করে সার্ফিং, পর্বতারোহণ কিংবা গ্রেট ব্যরিয়ার রিফের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া, ২৮ বছরের রোজি চার্লস আর ১২ বছরের এলির অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রয়েছে এগুলো সবই! কিন্তু তাদের মধ্যে সম্পর্কটা আসলে কী, জানেন? অনেকেই হয়ত ভাবছেন তারা হয়ত দুই বোন, আপন অথবা দূর সম্পর্কের। কিংবা তারা অসমবয়সী দুই বান্ধবী। কিন্তু না, তারা আসলে মা-মেয়ে!
বয়সের ব্যবধানটা আসলেই আশ্চর্য রকমের কম। মাত্র ১৬ বছরের। তারমানে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই মা হয়েছিলেন রোজি। প্রথমবারের মত মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করা অবশ্যই যে কোনো নারীর জীবনের শ্রেষ্ঠতম মুহূর্ত। কিন্তু যারা টিনেজ বয়সেই, পরিবারের অসম্মতিতে কোনো পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে মা হয়ে যান, তাদের অধিকাংশের জন্যই এই অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ থেকে শুরু করে মা হওয়া, এবং তারপর অপরিপক্ব অবস্থায় একটি সন্তানকে বড় করে তোলার যাত্রাটি হয়ে ওঠে রীতিমত একটি অভিশাপ।
রোজির ক্ষেত্রেও বিষয়টি এমনই হতে পারত। শুরুর দিকে পরিবারের সমর্থন পাননি তিনিও। একে তো সকলের ভৎসর্না-তিরস্কার, তার উপর টিনেজ পেরোনোর আগেই নিজের স্বাধীনতার উপর এত বড় একটা বাধা- সবমিলিয়ে রোজির জীবন হয়ে উঠতে পারত দুর্বিষহ, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। কিন্তু ইচ্ছা থাকলে কী না হয়! রোজির মধ্যে এই ইচ্ছার কোনো কমতি ছিল না। সেই অদম্য ইচ্ছার জোরেই রোজি এখন মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন বিশ্বভ্রমণে। ঘুরে বেড়াচ্ছেন পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। আর দশটা স্বাভাবিক মানুষও যেভাবে জীবনকে উপভোগ করার কথা ভাবতেও পারে না, ১৬ বছর বয়সে মা হয়ে যাওয়ার পরও রোজি কাটাচ্ছেন তেমন স্বপ্নের মত একটি জীবনই।
তবে শুরুর দিকে রোজি নিজেও ভাবতে পারেননি জীবনে এত বড় একটি ধাক্কা খাওয়ার পরও কোনোদিন ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন তিনি। “আমি একজন টিনেজ মম হয়েছিলাম, মাত্র ১৬ বছর বয়সেই। এটি ছিল আমার জন্য বিশাল বড় একটি শক। নিজেকেই সন্দেহ করতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু কোন নতুন মা’ই বা নিজেকে সন্দেহ করে না!” এত অল্প বয়সে মা হওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি মিথ্যা বলব না। এটি ছিল খুবই কঠিন। আমি শুরুতে এর জন্য প্রস্তুতও ছিলাম না। কীভাবে কী করব সে সম্পর্কেও আমার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। মা হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি বছর কীভাবে যে কাটিয়েছি, তা আমার স্মৃতি থেকে পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও আমি ওই সময়টি পার করে এসেছি, এবং পরবর্তীতে খুব ভালো একটি চাকরিও জুটিয়ে ফেলেছিলাম।
তবে আমি জানতাম আমার এমন একটি চাকরি প্রয়োজন যেটি আমি অনলাইনে বা ঘরে বসেই করতে পারি। সেজন্য আমি পুরো দুই বছর ব্যয় করেছি নিজের একটি ব্যবসা দাঁড়া করাতে, যেখানে আমি নিজের ইচ্ছা মত যেকোনো জায়গা থেকেই কাজ করে যেতে পারব।” বিশ্বভ্রমণের মত একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়কে কী মনে করে শখ হিসেবে বেছে নিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে রোজি বলেন,
“একজন সিঙ্গেল মম হওয়া, নিজের মত করে মেয়ের সাথে ঘুরে বেড়ানো, একসময় টিনেজ মম থাকা- সচরাচর এই ধরণের প্যারেন্টিং দেখা যায় না। সবাই এগুলো মেনে নেয় না। আমার পরিবারও শুরুতে এগুলো মেনে নেয়নি। তারা চেয়েছে আমরা যেন সবসময় বাড়িতে থাকি, এবং সে (এলি) যেন নিয়মিত স্কুলে যায়। কিন্তু আমি শেষ পর্যন্ত এটি (বিশ্বভ্রমণ) করারই সিদ্ধান্ত নিই।” নিজের জীবন ও মায়ের সাথে সম্পর্ক নিয়ে এলিও দারুণ খুশি। “ইংল্যান্ডে থাকতে সে (রোজি) ছিল কেবলই আমার মা ও প্রিয় বন্ধু। কিন্তু এখানে সে শুধু আমার মা বা বন্ধুই নয়, সে আমার বোন ও শিক্ষকের মতোও।”
গত একটি বছর মা-মেয়ের অধিকাংশ সময় রাস্তাতেই কেটেছে। ইতিমধ্যেই ১১টি দেশ ভ্রমণ সম্পন্ন করে ফেলেছে তারা। তবে ভ্রমণ বিষয়ে তাদের কখনোই খুব বড় কোন পূর্ব পরিকল্পনা থাকে না। হুট করেই নতুন কোনো গন্তব্যের কথা মাথায় এসে যায়, এবং তারা বেরিয়ে পড়ে সেই অজানা গন্তব্যে পাড়ি দিতে। আর নিজেদের সেই রোমাঞ্চকর যাত্রাকে স্মৃতিতে সংরক্ষণের জন্য তারা বেছে নেয় ইনস্টাগ্রামকে। এভাবে তাদের দিন কেটে যাচ্ছে স্বপ্নের মতোই।
কিন্তু ওদিকে এলির বয়সও যে হয়ে গেছে ১২। তার মা তাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন এই বয়সের মাত্র বছর তিনেক পরে। নিজের জীবন নিয়ে এলিরও কি এমন কোন পরিকল্পনা আছে? মোটেই না। সে বলে, “আমার সত্যিই কোনো ইচ্ছা নেই, আরও বড় হওয়ার আগেই নিজের একটি পরিবার শুরু করার। কারণ আমি চাই পৃথিবীটাকে ঘুরে দেখতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে, এবং অন্যান্য দেশ ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতিকে আরও ভালো করে জানতে।”
একই মত মা রোজিরও, “হ্যাঁ, আমরা দুইজন মিলে আমাদের জীবনটাকে দারুণভাবে উপভোগ করছি। এভাবে জীবন কাটানোটা ছিল আমার জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত। এভাবেই আমি আমার আত্মসত্ত্বাকে আবিষ্কার করতে পারছি। কিন্তু তারপরও আমি চাই না আমার মেয়েও একজন টিনেজ মম হোক। এটি সত্যিই খুব কঠিন একটি বিষয় ছিল। অজস্রবার আমার মনে হয়েছে, আজ আমি যেমন আছি, কোনোদিন এই অবস্থানে পৌঁছাতে পারব না।
এমনকি দশ বছর আগেও যদি আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করতেন যে, আজ আমি এখানে থেকে জীবনকে উপভোগ করতে পারব কি না, বিশ্বাস করুন, আমি আপনার মুখের উপর হেসে দিতাম। কিন্তু একই সাথে এটিও প্রমাণিত হয় যে, আপনার মধ্যে যদি কোনো কিছু করার প্রবল ইচ্ছা থাকে, আপনার যদি স্বপ্ন দেখার সাহস থাকে, এবং আপনার যদি উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে, সত্যি সত্যিই আপনি জীবনে যেকোনো কিছু অর্জন করতে পারবেন।” (বিবিসি অবলম্বনে)
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন