আমরা করোনা নিয়ে আলোচনা করি, চীনের জন্যে হাহুতাশ করি। অথচ নিজেরা যে সাক্ষাৎ জাহান্নামে টিকে আছি, সেটা ভুলে যাই।

করোনাভাইরাস নিয়ে জনমনে ভয়, আতঙ্ক। চীনে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়া এই রোগ জায়গা করে নিয়েছে বাঙালির আড্ডার বিষয়বস্তু হিসেবেও। কেউ বলছে খোদার গজব, কেউ আবার চিন্তা করছে করোনা বাংলাদেশে এলে কী হবে, এ নিয়ে। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ন জায়গায় করোনা একবার ছড়াতে পারলে সেটা কি ভয়াবহ রূপ নেবে, তা কল্পনার বাইরে। তবে করোনা আসুক না আসুক, ঢাকার অর্ধেক মানুষ কয়েক মাসের মধ্যে ভ্যানিশ হয়ে যাবে মশার যন্ত্রণাতেই। দিনকে দিন যেভাবে মশার উপদ্রব বাড়ছে, করোনাকেও তুচ্ছ মনে হবে কয়েকদিন পরে।

ঘরে মশা, বাইরে মশা, বাসাবাড়ি, অফিস, রেস্টুরেন্ট- কোথাও মশার যন্ত্রণায় শান্ত হয়ে বসার একটু উপায় নেই। কয়েল জ্বালিয়ে, অ্যারোসল ছিটিয়েও রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না ক্ষুদ্র এই পতঙ্গের অত্যাচার থেকে। সাধারণ মানুষ নাহয় ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে ক্ষণিকের জন্যে নিস্তার খুঁজে নিলেন, কিন্ত যারা ভাসমান মানুষ, যারা রাতে বাইরে কাজ করেন, পুলিশ, দারোয়ান, নাইট গার্ড, কিংবা অন্যান্য আরও অনেক পেশাজীবি- তাদের অবস্থাটা একবার কল্পনা করুন, মশার অত্যাচারটা তাদের ওপর কেমন ভয়াবহভাবে নেমে আসছে!

গত বছর ডেঙ্গু যে ভয়াবহতা ছড়িয়েছিল দেশজুড়ে, সেখান থেকেও শিক্ষা নেয়নি কেউ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) সতর্ক করে দিয়েছিল, গত বছরের শেষ সময় থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে; বিশেষ করে নতুন বছরের শুরু থেকেই ডেঙ্গু দেখা দিতে পারে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তারা বছরজুড়ে মশা নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে- এমন কথাও তারা বলেছিলেন।

কিন্ত বিশেষজ্ঞদের কথা শোনার বা মানার সময় কি এই দেশে কারো আছে? মশা একটা জিনিস হলো? দুই হাতে তালি মেরে যে জিনিস মেরে ফেলা যায়, সেটার জন্যে এত আয়োজন করা লাগবে কেন? সবাই তো আর ডেইজি আপার মতো কামান নিয়ে মশা মারতে নামবেন না। দুই সিটি কর্পোরেশনের কেউই এসব সতর্কতা আমলে নেয়নি। ডেঙ্গুর প্রকোপ কমার পর থেকে মশা নিধনের কার্যক্রমও অনিয়মিত হয়েছে, নভেম্বরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা চার হাজারে নেমে আসার পর থেমেই গেছে মশা নিধনের কাজ। গত ডিসেম্বর থেকে মশা নিধনকাজ নেই বললেই চলে।

ঢাকায় আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে মশা

এরইমধ্যে আবার সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়েছে। কাজকর্ম সব ফেলে রেখে মেয়র আর ওয়ার্ড কমিশনারেরা নেমে পড়েছেন আগামী পাঁচ বছরের জন্যে নিজেদের আখের গোছাতে। জনগনের কথা ভাবার সময় আছে তখন আর? মশা যাক জাহান্নামে, আগে ইলেকশনটা জিতি! তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন পর্যন্ত মূলত কোনো কাজই হয়নি দুই সিটিতে। এমনকি নতুন মেয়র ও কাউন্সিলরদের দায়িত্ব নিতে অপেক্ষা করতে হবে আগামী মে মাস পর্যন্ত। এর আগে দুই সিটিতে মশা নিধন কর্মসূচি জোরালো করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।

নগরবাসী মশার যন্ত্রণায় অতীষ্ট, অসহায়ও। অথচ যাদের খোঁজ নেয়ার কথা, তদারকি করার কথা, মশা নিধন করার কথা- তারা আছেন ঘুমিয়ে। এরইমধ্যে একদল কীটতত্ত্ববিদ জানিয়েছেন, আগামী পনেরো দিনের মধ্যে মশার অত্যাচার আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। তারা বলেছেন, এখনই পদক্ষেপ না নিলে ১৫ দিনে ঢাকায় মশার ঘনত্বের রেকর্ড ছাড়াবে। মশার ঘণত্ব পরিমাপের বৈজ্ঞানিক পদ্ধ্বতি ব্রুটো ইনডেক্স ব্যবহাত করে তারা নিশ্চিত হয়েছেন, ঢাকার প্রায় প্রতিটা এলাকায় মশা এবং লার্ভার পরিমাণ জানুয়ারীর চেয়ে ফেব্রুয়ারীতে অনেকটা বেড়েছে, মার্চে সেটা আকাশচুম্বী হতে পারে।

ইত্তেফাকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে হিসেবটা সরাসরি তুলে দেই এখানে- জরিপে প্রতি ১০০ প্রজনন উেসর মধ্যে ২০টি বা তার বেশিতে যদি এডিস মশার লার্ভা বা পিউপা পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি’ বলা যায়। এই জরিপ অনুযায়ী, জানুয়ারিতে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরীবাগ ও শাহবাগ এলাকায় মশার ব্রুটো ইনডেক্স ছিল সবচেয়ে বেশি, ২৬ দশমিক ৬৭। এ ছাড়া লালমাটিয়া-মোহাম্মদপুরে ১০, গুলশান-বনানীতে শূন্য, বাসাবো-খিলগাঁওয়ে ১৩ দশমিক ৩৩, শাখারীবাজার ও পাটুয়াটুলীতে ১৩ দশমিক ৩৩। ফেব্রুয়ারিতে এখন পর্যন্ত গুলশান-বনানী এবং লালমাটিয়া-মোহাম্মদপুর এ দুটি অঞ্চলের তথ্য নেওয়া হয়েছে। এতে দেখা যায়, গুলশানে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ হয়েছে। লালমাটিয়ায় কমে হয়েছে ৬ দশমিক ৬৭।

আমরা করোনা নিয়ে আলোচনা করি, চীনের জন্যে হাহুতাশ করি। অথচ নিজেরা যে সাক্ষাৎ জাহান্নামে টিকে আছি, সেটা ভুলে যাই। ঢাকার এখন যা অবস্থা, যানজট, বায়ুদূষণ, শব্দ দূষণ, পানি দূষণ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মানুষের মানসিক অবসাদ- সব মিলিয়ে ঢাকার অবস্থা হাবিয়া দোজখের চেয়ে খুব একটা ভালো না। এরপরেও ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় সবার ওপরে স্থান দিলে কারো কারো অন্তরে জ্বালাপোড়া হয়, তারা তীব্র প্রতিবাদ জানায়, এগুলোকে বিদেশী আর বিরোধী দলীয় ষড়যন্ত্র বলে আখ্যা দেয়। এসব প্রতিবাদী মানুষগুলোকে কয়েক কোটি কিউলেক্স মশার সঙ্গে একটা বড় কাঁচের জারে ঢুকিয়ে রাখতে আমার খুব ইচ্ছে করে…


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা