তার নেতৃত্বেই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল ইরান। পশ্চিমা দেশগুলোর টার্গেটে তিনি ছিলেন আগে থেকেই, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীও নিজের প্রেজেন্টেশনে তার নাম নিয়েছেন। গতকাল এক আততায়ী হামলায় মারা গেছেন এই বিজ্ঞানী, ইরানের অভিযোগের তীরটা ইসরায়েলের দিকেই...

মোহসেন ফাখরিজাদেহকে বলা হতো ইরানের পারমাণবিক বোমার জনক। দেশটির পরমাণু অস্ত্র সমৃদ্ধকরণে তার অবদান অনস্বীকার্য, ইরানের সবচেয়ে প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ পরমাণু বিজ্ঞানী ছিলেন তিনি। গতকাল আততায়ীদের হামলায় নিজের দেশেই নিহত হয়েছেন তিনি, তেহরানের কাছে দামাভান্দ কাউন্টির আবসার্ড এলাকায় এই হামলার ঘটনা ঘটেছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনার পরপরই এই হামলার জন্য পরোক্ষভাবে ইসরায়েল এবং মোসাদকে দায়ী করেছেন। মোহসেন ফাখরিজাদেহ অনেক বছর ধরেই পরাশক্তিগুলোর রাডারে ছিলেন, এর আগেও তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর চোখে তিনিই ছিলেন ইরানের পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হবার প্রধান পরিকল্পনাকারী। 

গতকাল শুক্রবার ইরানের রাজধানী তেহরানের কাছে তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে প্রথমে বোমা হামলা চালানো হয়, এরপর গুলি করা হয়। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, হামলার শিকার হওয়ায় হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান মোহসেন ফাখরিজাদেহ। সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তার গাড়ি লক্ষ করে হামলা চালায়। এ সময় তার দেহরক্ষী ও সন্ত্রাসীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে গুরুতর আহত হন ফাখরিজাদেহ। ঘটনাস্থলে পরিত্যক্ত গাড়ির ধ্বংসাবশেষ, রক্ত ও বুলেটের খোসা পাওয়া গেছে, বোমা হামলার আলামতও মিলেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। 

তিন থেকে চারজন সন্ত্রাসীর একটি দল এই হামলা চালিয়েছে। বোমা হামলা চালিয়ে গাড়ি থামানোর পর গুলি করা হয়েছে বিজ্ঞানীর গাড়ি লক্ষ্য করে। তার নিরাপত্তারক্ষীদের পাল্টা গুলিতে আততায়ীরাও নিহত হয়েছে, তবে এর আগে তাদের বুলেট গিয়ে আঘাত করেছে ফাখরিজাদেহ'র শরীরে। দ্রুত তাকে উদ্ধার করে নিকটস্থ হাসপাতালে নেয়া হয়, তবে চিকিৎসকদের খুব বেশি সময় দিতে পারেননি তিনি, রক্তক্ষরণে শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তার আঘাতও ছিল গুরুতর। হাসপাতালে নেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাখরিজাদেহ'র মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে ইরানের সংবাদ সংস্থাগুলো। 

হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি

ফখরিযাদেহ ছিলেন সর্বাধিক খ্যাতিমান ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী এবং অভিজাত ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কোরের সিনিয়র অফিসার। ইরানের পরমানু অস্ত্রের অধিকারী হওয়ার পুরো সময়টায় তিনিই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিশ্বমোড়লদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির যে কর্মসূচি ইরান চালিয়েছে, সেটার প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন ফাখরিজাদেহ। ইরানের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে সরাসরি রিপোর্ট করতেন তিনি। 

২০১৫ সালে নিউইয়র্ক টাইমস ফাখরিজাদেহকে তুলনা করেছিল জে রবার্ট ওপেনহেইমারের সাথে, এই পদার্থবিজ্ঞানী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ম্যানহাটন প্রকল্পের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তৈরি করেছিলেন প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র। পশ্চিমা দেশগুলো এবং তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মোহসেন ফাখরিজাদেহকে নিজেদের টার্গেট বানিয়ে রেখেছে অনেক আগে থেকেই। কারন তারা জানতো, ফাখরিজাদেহকে শেষ করে দেয়া গেলে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের কর্মসূচি বড়সড় একটা ধাক্কা খাবে। তাকে হত্যার চেষ্টাও কয়েক দফায় করা হয়েছে, কিন্ত সেগুলো ব্যর্থ হয়েছে প্রতিবার। 

ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ২০১০ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে দেশটির চারজন বিজ্ঞানীকে এরকম গুপ্তহামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রতিবারই ইসরায়েলকে দায়ী করেছে ইরান। ফাখরিজাদেহ'র ঘটনাতেও ইসরায়েলের দিকেই আঙুল তুলেছে তারা। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, সন্ত্রাসীরা আজ ইরানের এক বিশিষ্ট বিজ্ঞানীকে হত্যা করল। এই হত্যাকাণ্ড কাপুরুষোচিত। এতে ইসরায়েলে যুক্ত থাকার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এই হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নেয়া হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছে ইরান। আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সামরিক উপদেষ্টা হোসেইন দেঘান বলেছেন, এই হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের ওপর বজ্রের মতো 'আঘাত হানা' হবে।

এখানেই হামলা চালানো হয় ফাখরিজাদেহ এর ওপর

ফাখরিযাদের হত্যার ঘটনা নিয়ে ইসরায়েল এখনও কোন মন্তব্য করেনি। তবে ইরানের এই বিজ্ঞানী যে ইসরায়েল এবং মোসাদের রাডারে ছিলেন, সেটা নিশ্চিত। ২০১৮ সালে ইসরায়েল বলেছিল তাদের হাতে যেসব গোপন নথিপত্র আছে সেগুলো অনুয়ায়ী ইরানের পরমাণু কর্মসূচির প্রধান রূপকার হচ্ছেন ফাখরিজাদে। তার নেতৃত্বেই ইরানের পরমাণু কর্মসূচি গড়ে উঠেছে। এমনকি ২০১৮ সালের সেই প্রেজেন্টেশনে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর কণ্ঠেও শোনা গিয়েছিল ফাখরিজাদে'র নাম,  নেতানিয়াহু বলেছিলেন "ওই নামটা (ফাখরিজাদে) আমাদেরকে মনে রাখতে হবে।" কাজেই এই হামলার ঘটনার সঙ্গে ইসরায়েলের যোগসূত্র খোঁজাটা একেবারে অবান্তর নয়। 

ইরান সম্প্রতি নতুন করে পারমাণবিক কর্মসূচি শুরুর পর ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বাড়িয়েছে। এ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব উদ্বেগও প্রকাশ করছে। এদিকে ট্রাম্পের রাজত্ব শেষ হয়ে বাইডেন যুগ আসছে আমেরিকায়, বাইডেন ক্ষমতায় এলে ইরানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক খানিকটা স্বাভাবিল হবে বলে অনেকের অভিমত। এর মধ্যেই এমন হামলার ঘটনা ঘটলো, কাজেই এই হত্যাকান্ড মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিকে আবারও অশান্ত করে তুলতে পারে। ইরান এখন কি পদক্ষেপ নেয়, সেটার ওপরেই নির্ভর করবে অনেক কিছু...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা