সৈয়দ আশরাফ বা সোহেল তাজের সঙ্গে মোহাম্মদ নাসিমের পার্থক্য যেখানে
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
একটা মানুষের চার দশকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার, কয়েক দফায় মন্ত্রী ছিলেন, গুরুত্বপূর্ণ সব মন্ত্রণালয় সামলেছেন। তবুও দল মত নির্বিশেষে কেন সবাই বলছে না যে, লোকটা বড় ভালো ছিলেন, তার মতো রাজনীতিবিদের খুব দরকার... কেন বলুন তো?
দল-মত নির্বিশেষে এখনও মানুষ সোহেল তাজকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। ঘোরতর বিএনপি সাপোর্টার লোকটাও মানে, সোহেল তাজের আবার রাজনীতিতে আসা উচিত। নিরপেক্ষ ভাবধারার যারা, তারা বলে, উনি নিজে নতুন পার্টি না খুললে আওয়ামী লীগেই ফিরে আসুক। অভিমান কেটে যাক। আওয়ামী লীগে এত এত তেলবাজদের ভীড়ে, শেখ হাসিনার পাশে সোহেল তাজের মতো বিশ্বস্ত মানুষের খুব দরকার।
সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুর পরেও আমি আওয়ামী বিরোধী প্যানেলে শোকের ছায়া দেখেছি। যারা আওয়ামী লীগকে পছন্দ করেন না, তারাও আশরাফকে পছন্দ করতেন, তাকে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে মানতেন। সৈয়দ আশরাফকে নিয়ে বিরোধীরা নোংরামি করেছে কম, বরং জীবিত অবস্থায় আশরাফের চরিত্র নিয়ে মিথ্যাচার করে নোংরামিতে মেতেছিল তার দলেরই একাংশ। আশরাফ সারাদিন নেশার ঘোরে থাকেন, পার্টির দায়িত্ব পালন করেন না, মন্ত্রণালয়ে সময় দেন না, নেত্রী তার ওপর বিরক্ত- এসব অপপ্রচার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা চালায়নি, চালিয়েছিল একই তাঁবুর লোকেরাই। কারণ তাদের একটা এজেন্ডা ছিল, সেই এজেন্ডা সফলও হয়েছিল।
পঁচাত্তরে জেল হত্যাকান্ডে শহীদ হওয়া জাতীয় চার নেতাতর একজন কামরুজ্জামান। তার ছেলে খায়রুজ্জামান লিটন জাতীয় রাজনীতিতে সেভাবে অবস্থান গড়তে পারেননি, রাজশাহীতেই থিতু হয়েছেন। সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নিজের এলাকায় তিনি জনপ্রিয়, ভাবমূর্তি নিয়েও তেমন প্রশ্ন নেই, রাজশাহীতে তিনি কাজ করেছেন, এখনও করছেন। রাজশাহী শহরটা তার হাত ধরেই বদলাচ্ছে, এই শহর নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। সবচেয়ে বড় কথা, রাজশাহীর মানুষ তাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে।
এলাকার মানুষের ভালোবাসা মোহাম্মদ নাসিমও পেয়েছেন। কিন্ত তিনি একজন জাতীয় রাজনীতিবিদ, স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সামলেছেন, কাজেই তার জনপ্রিয়তাকে বিচার করতে গেলে গোটা দেশের মানচিত্রে হিসেব কষতে হবে। দেশের মানুষের ভালোবাসায় কতটা সিক্ত হতে পেরেছিলেন প্রয়াত এই রাজনীতিবিদ?
জাতীয় চার নেতার একজন সন্তান তিনি, তার মৃত্যুতে আওয়ামী ঘরানার বাইরে শোকের ছায়া নেই কেন? ফেসবুকে গালাগালি বা নোংরামির কথা বাদ দিলাম, এগুলো যারা করে, তারা করবেই। ওই ১-২% কে হিসেবের বাইরে রেখেই বলি। একটা মানুষের চার দশকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার, কয়েক দফায় মন্ত্রী ছিলেন, গুরুত্বপূর্ণ সব মন্ত্রণালয় সামলেছেন। তবুও দল মত নির্বিশেষে কেন মানুষ বলছে না যে, লোকটা বড় ভালো ছিলেন, তার মতো রাজনীতিবিদের খুব দরকার... কেন বলুন তো?
বর্ণাঢ্য একটা রাজনৈতিক জীবন ছিল মোহাম্মদ নাসিমের, সেই পাকিস্তান আমলেই বাবা এম মনসুর আলির সঙ্গে জেল খেটেছেন তিনি। রাজপথের নেতা ছিলেন, টানা সাংসদ হয়েছেন, মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, বিরোধী দলের সাংসদ থাকা অবস্থায় আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের মার খেয়েছেন, দলের জন্য তার ত্যাগ অপরিসীম, এমন ক্যারিয়ার গ্রাফ বাংলাদেশের ইতিহাসে খুব বেশি রাজনীতিবিদের পাওয়া যাবে না। আওয়ামী লীগ তার মূল্যায়নও করেছে। তবুও কেন তিনি দলের নেতা রয়ে গেলেন, জনগনের নেতা হতে পারলেন না?
কারণ ২০১৪-২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থাকা অবস্থায় দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামো ভেঙে পড়েছে। সীমাহীন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়েছে এই মন্ত্রণালয়। কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহ সহ সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতির অন্ধকার ছায়া গ্রাস করেছে। অপারেশন থিয়েটারের পর্দার দাম উঠেছে ৩৭ লাখ টাকা, কোটি কোটি টাকায় নষ্ট বা অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে, যেগুলো চালানোর মতো লোকবলও হাসপাতালগুলোতে নেই। এই যে করোনাকালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এমন ভঙ্গুর দশা, আইসিইউ নেই, অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই, করোনার উপসর্গ নিয়ে রোগীরা বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন- এগুলো তো এসব দুর্নীতিরই ফল।
দুই নম্বুরি করে স্বাস্থ্য বিভাগের তৃতীয় শ্রেনীর কর্মচারী আবজাল দেড় হাজার কোটি টাকা সম্পদের মালিক হয়েছে, আরও কতশত আবজালের খোঁজ তো আমরা জানিই না। এসবের দায়ভার মোহাম্মদ নাসিম এড়িয়ে যেতে পারবেন না, দেশের মানুষ বিরক্ত হয়েছে, তাদের মন থেকে ভালোবাসা উঠে গেছে। জাতীয় চার নেতার একজনের সন্তান এবং রাজপথের রাজনীতিবিদ হিসেবে সৈয়দ আশরাফ বা সোহেল তাজরা যেভাবে নিজেদের ভাবমূর্তি পরিচ্ছন্ন রাখতে পেরেছিলেন, নাসিম সেটা পারেননি, অধীনস্থদের বাঁধভাঙা অনাচার তিনি সামলাতে ব্যর্থ হয়েছেন। আর তাই বঞ্চিত হয়েছেন জনগনের ভালোবাসা থেকেও।
মোহাম্মদ নাসিম চলে গেছেন সব ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে। যেখানে গেছেন, সেখানে তিনি যেন ভালো থাকেন, শান্তিতে থাকেন, সেই প্রার্থনা করি। তার মৃত্যুতে আফসোস শুধু এটাই, তিনি আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে বিদায় নিলেন। বাবার মতো 'সার্বজনীন নেতা' হতে পারলেন না। সৈয়দ আশরাফ বা সোহেল তাজের মতো সর্বজনের ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া হলো না তার। নাসিমের জীবনী থেকে কি বাকীরা কিছু শিখবেন? মনে হয় না। কারণ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা তো এটাই- ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না...