আমরা যারা দুই-একবার নিজেদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েই ভাগ্যের দোহাই দিয়ে হাল ছেড়ে দিই, তারা কি পারি না মোহন সিং ওবেরয়ের জীবন থেকে শিক্ষা নিতে?

আজ বলব মোহন সিং ওবেরয়ের গল্প। জন্ম পাকিস্তানের ঝেলুম জেলার ভানাউ নামক গ্রামে, এক শিখ পরিবারে। জীবনের একদম সূচনালগ্ন থেকেই তার জীবন ছিল চরম দারিদ্র্যতার করাঘাতে পিষ্ট। বয়স যখন সবে ছয় মাস, তখনই তার জন্মদাতা পিতা পরলোক গমন করেন। আর তখন থেকেই তাকে লালন পালন ও মানুষের মত মানুষ হিসেবে বড় করে তোলার সমস্ত দায়ভার বর্তায় একা তার মায়ের কাঁধে। গ্রামীণ এক অসহায় নারীর জন্য সে ভার বহন করা চাট্টিখানি কথা ছিল না। কিন্তু তারপরও তার মা তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ব্যাপারটি নিশ্চিত করেন। অবশ্য এ ব্যাপারে আত্মীয়স্বজনদের কমবেশি সাহায্যও তিনি পান। 

গ্রামের স্কুলে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে মোহন চলে আসেন রাওয়ালপিন্ডিতে, সেখানে একটি সরকারি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকেও তিনি বেশ কৃতিত্বের সাথে ডিগ্রি সার্টিফিকেট অর্জন করেন। সদ্য কলেজ থেকে পাশ করে বেরোনো মোহনের বুকভরা ছিল রাশি রাশি স্বপ্ন। আর তিনি ছিলেন খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী একজন ব্যক্তি। ভেবেছিলেন, ডিগ্রি সার্টিফিকেটের বদৌলতে খুব তাড়াতাড়িই বেশ ভালো একটি চাকরি জুটিয়ে ফেলবেন। কিন্তু স্বপ্নচারী মোহনকে বাস্তবতার রুক্ষ জমিনে পদার্পণ করতে হয় মাত্র কয়েকদিনের মাথায়ই। তার সামনে একে একে বন্ধ হতে থাকে সম্ভাবনার প্রতিটি দ্বার। কোথাওই চাকরি জোটে না তার। 

তখন এক বন্ধুর পরামর্শে তিনি অমৃতসরে একটি টাইপিং কোর্সে যোগ দিলেন। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলেন, এই কোর্স করেও তার ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এদিকে শহরে থাকার মত টাকাপয়সাও আর খুব একটা অবশিষ্ট ছিল না তার পকেটে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ফিরে যাবেন নিজের গ্রামে, মায়ের কাছে। বাস্তবিকই তিনি ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসেন গ্রামে। 

গ্রামে ফিরলে মোহনের এমন দুরাবস্থা দেখে চমকে যান এক দূরসম্পর্কের চাচা। দেন দরবার করে তিনি মোহনকে ঢুকিয়ে দেন তার পরিচিত এক লোকের জুতো তৈরীর কারখানায়। কিন্তু মন্দভাগ্য যেন এখানেও পিছু ছাড়ে না মোহনের। তিনি যোগ দেয়ার মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় ওই কারখানাটি। আবারও মুখ নিচু করে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন তিনি। এরই মধ্যে তার জীবনে আসে এক নতুন বাঁকবদল। কলকাতায় স্থায়ীভাবে বাস করা এক পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করেন তিনি।

অবশ্য কলকাতায় বাস করলেও সেই পরিবারের আদি নিবাস আসলে মোহনদেরই গ্রামে। বিয়ের পর মোহন তার শ্যালকের সাথে পাকিস্তানের সারগন্ধায় থাকতে শুরু করে। মনে ক্ষীণ আশা, যদি কোন একটা চাকরি পাওয়া যায়। কিন্তু যতই দিন যেতে থাকে, আশার প্রদীপ ক্রমশই উজ্জ্বলতা হারাতে থাকে। আরও একবার তিনি ফিরে আসেন গ্রামে। কিন্তু এবার গ্রামে ফিরে যা দেখতে পেলেন তার জন্য তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। তাদের পুরো এলাকা আক্রান্ত হয়েছে ভয়াবহ প্লেগ রোগের কবলে। সেটি এক মহামারী রূপ ধারণ করেছে। প্রতিদিনই ডজন ডজন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে এই রোগের প্রকোপে। তার মা তাকে বলে অতিসত্ত্বর সারগন্ধায় ফিরে যেতে।

ততদিনে বারবার ব্যর্থ হতে হতে মোহন পৌঁছে গিয়েছে অবসাদগ্রস্ততার চূড়ান্ত সীমানায়। নতুন করে তিনি কিছু শুরু করবেন, সেই ইচ্ছাশক্তিও যেন আর অবশিষ্ট ছিল না তার মধ্যে। এরকমই একটা সময়ে হঠাৎ একদিন পত্রিকার পাতায় তিনি একটি বিজ্ঞাপন দেখতে পান, একটি সরকারি অফিসে জুনিয়র ক্লার্ক পদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। মোহন খুব বেশি চিন্তাভাবনা না করেই পত্রিকায় দেয়া সিমলার ঠিকানায় রওনা দিতে উদ্যত হলেন। তার পকেটে তখন ফুটো পয়সাটাও ছিল না। ঘর থেকে বেরোনোর সময় মা তার পকেটে ২৫ রুপি গুঁজে দেয়। সেটিই ছিল তার একমাত্র সম্বল। 

সিমলায় পৌঁছে সেখানকার অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হয় মোহন। এমনকি সেখানকার রাস্তাঘাটগুলোকেও তার কাছে যেন ছবির মত মনে হতে থাকে। সেই ছবির মত রাস্তা ধরে মন্ত্রমুগ্ধের মত হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎই সিসিল নামের চমৎকার একটি হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন মোহন, এবং সোজা চলে গেলেন সেই হোটেলের ম্যানেজারের কাছে। ম্যানেজার ছিলেন একজন সত্যিকারের আপাদমস্তক ভদ্রলোক। তার আচার ব্যবহারে প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয় মোহন। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে তার কাছে তুলে ধরে নিজের দুরাবস্থার কথা। তার একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডের কথাও জানাতে ভোলে না। তারপর অনুরোধ করে, যদি তাকে কোন চাকরি দেয়া যায়। ম্যানেজার ভদ্রলোকও সত্যি সত্যিই তাকে বিলিং ক্লার্ক পদে চাকরির প্রস্তাব দিয়ে বসেন।

শুরুতে বেতন ৪০ রুপি, কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তা উন্নীত হবে ৫০ রুপীতে। মোহন ভেবে দেখে, সরকারি চাকরির তুলনায় এই চাকরিটিই তার জন্য অধিক লাভজনক। তাই হাসিমুখে তিনি এই চাকরিটিই লুফে নিলেন। হোটেল কর্তৃপক্ষ তাকে থাকার জন্য আবাসিক কোয়ার্টারও বরাদ্দ দেয়, যেখানে তিনি তার স্ত্রী ইরশান দেবীকে নিয়ে বাস করতে শুরু করে। 

অনেক সাধনার পর অবশেষে ভাগ্য মোহনের দিকে মুখ তুলে চেয়েছে। এ সুযোগ তিনি কিছুতেই হাতছাড়া করতে চান না। তাই নিরলস পরিশ্রম করে যেতে থাকলেন তিনি। নিজের সামর্থ্যের শতভাগ ঢেলে দিতে থাকলেন নিজের কাজে। পাশাপাশি তিনি যে টাইপিং আর স্টেনোগ্রাফিতেও অতিশয় দক্ষ, সেটিও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই টের পেয়ে যায় হোটেলের উপর মহল। তাই তাকে বিলিং ক্লার্কের পাশাপাশি ক্যাশিয়ার আর স্টেনোগ্রাফারের কাজও দেয়া হয়। এবং এই প্রতিটি কাজই তিনি করতে থাকলেন সুনিপুণভাবে। মোহন সকল কাজ এতটাই নিখুঁতভাবে করতে থাকে যে হোটেল কর্তৃপক্ষ বারবার তার কাজে চমৎকৃত হতে থাকলো, আর তাই তার বেতনও ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এবং একটি পর্যায়ে তিনি পরিণত হলেন ওই হোটেলের অন্যতম কর্তাব্যক্তিতে। 

কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়। হোটেলটি ছিল এক ব্রিটিশ দম্পতির। কয়েকবছর পর তারা সিদ্ধান্ত নেন হোটেলটি স্থানীয় কারও কাছে বেচে দিয়ে নিজ দেশে ফিরে যাবেন। কিন্তু যার তার হাতে এতদিনের ভালোবাসা ও মমতা দিয়ে গড়ে তোলা হোটেলটি ছেড়ে যেতে তাদের মন একদমই সায় দিচ্ছিল না। ততদিনে অবশ্য তারা করিৎকর্মা মোহনের কর্মদক্ষতা আর নেতৃত্বের গুণাবলি দেখে মুগ্ধ। তাই মোহনকেই তারা প্রস্তাবটি দিয়ে বসেন, মাত্র ২৫,০০০ রুপি হলেই মোহনের কাছে বিক্রি করে দেবেন হোটেলটি। 

তখনকার দিনে ২৫,০০০ নেহাত কম নয়। মোহন ইদানিং একটু সচ্ছলতার মুখ দেখেছে বটে, কিন্তু তাও এই বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হতে তার ঢের দেরি। কিন্তু সে চিন্তা করে দেখল, এই সুযোগ হাতছাড়া করাও হবে মস্ত বড় বোকামি। তাছাড়া জীবনে বড় কিছু করতে গেলে কিছুটা ঝুঁকি তো নিতে হবেই। নইলে অবস্থার উন্নতি হবে কীভাবে! তাই গ্রামে ফিরে গিয়ে পৈতৃক সকল বিষয়সম্পত্তি বন্ধক রাখলেন তিনি। এমনকি হাত দিলেন স্ত্রীর গায়ের গহনাতেও। সব মিলিয়ে ২৫,০০০ রুপি জোগাড় করতে সমর্থ হলেন শেষমেশ। এবং এভাবেই তিনি ১৯৩৪ সালের ১৪ আগস্ট সিসিল হোটেলের মালিকে পরিণত হন। 

সেই যে মোহনের জীবনে উন্নতির শুরু হয়, এরপর থেকে তাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে তিনি কেবল উপরেই উঠেছেন, এবং ক্রমশ নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন নতুন নতুন সব মাত্রায়, সকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাত্র ২৫ রুপি পকেটে নিয়ে জীবনযুদ্ধে শেষবারের মত লড়াই করার মনোবাসনা নিয়ে ঘর ছেড়ে বের হওয়া মোহন একটা সময় গড়ে তোলে ওবেরয় গ্রুপ, বিশ্বব্যাপী ছয়টি দেশে যাদের আছে ৩৫টি বিলাসবহুল হোটেল। এবং সবমিলিয়ে ওবেরয় গ্রুপের সম্পদের পরিমাণ এখন ৭,০০০ কোটি রুপি।  

মোহন সিং ওবেরয়ের এই গল্প আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় সেই হাল ছেড়ে না দেওয়া মাকড়সার কথা, সাতবার দেয়াল বেয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়েও যে আশা ছেড়ে দেয়নি, আর তার ফল পেয়েছে অষ্টমবারে। একইভাবে মোহন সিং ওবেরয়ও প্রথম জীবনে বহুবার ব্যর্থতার বেড়াজালে বন্দি হয়েছেন। কিন্তু তিনি চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এবং একটি মাত্র সুযোগ পেতেই সেটির সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন। আর তাই তো আজ তিনি ভারতীয় হোটেল ব্যবসায় এক কিংবদন্তীতুল্য নাম। আমরা যারা দুই-একবার নিজেদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েই ভাগ্যের দোহাই দিয়ে হাল ছেড়ে দিই, তারা কি পারি না মোহন সিং ওবেরয়ের জীবন থেকে শিক্ষা নিতে?

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা