যে 'ভদ্রলোক' তাজমহলই বিক্রি করে দিয়েছিলেন তিন তিনবার!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

তাজমহলই তিনবার বিক্রি করেছিলেন এই লোকটা, দিল্লির লালকেল্লা বিক্রি করেছেন দু’বার, রাষ্ট্রপতি ভবনও রেহাই পায়নি! আরেকবার তো মন্ত্রী-সাংসদ সমেত নাকী বিক্রি করে দিয়েছিলেন খোদ সংসদ ভবনই!
তাজমহল কিনবেন নাকি? কিংবা আগ্রার বিখ্যাত রেডফোর্ট? কলকাতার ঐতিহ্য ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কিংবা ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনও কিনতে পারেন; নগদ নারায়ণ ঢাললে সবই নিতে পারেন নিজের করে! পাগল ভাবছেন তো? ইন্টারনেটের এই যুগে এসব আজগুবি চিন্তাভাবনা কতোটা কল্পনাপ্রসূত সেটা ভেবে মুচকি হাসিও পেতে পারে। লেখাটা পড়ার সময় হাসিটা গায়েব হয়ে যাবে কথা দিচ্ছি।
শাহজাহানের অমর কীর্তি একবার নয়, দু’বার নয়, তিন তিনবার বিক্রি হয়েছে! বিক্রি হয়েছে লালকেল্লা, রাষ্ট্রপতি ভবন; একবার তো সাংসদপরিবেষ্টিত সংসদ ভবনও বিক্রি হয়ে গেছে! অবাক লাগছে? আরো অবাক হবেন, যখন জানবেন এসব কেনা-বেচার নেপথ্যে ছিলেন একজনমাত্র ব্যক্তি! পুলিশের খাতায় পরিচিতি নটবরলাল হিসেবে; ভালো নাম মিথিলেশ কুমার শ্রীবাস্তব।
১৯১২ সালটা দুনিয়ার ইতিহাসে বিখ্যাত টাইটানিক নামের জাহাজের ডুবে যাওয়ার জন্য। ৬০হাজার টন এবং ২৭৫ মিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট জাহাজটি তৈরীতে খরচ হয়েছিলো ৭৫ লাখ ডলার, প্রায় হাজার তিনেক যাত্রী এবং ক্রু নিয়ে আইসবার্গের সাথে ধাক্কা খেয়ে আটলান্টিক সাগরে ডুবে গিয়েছিলো বিশালাকৃতির এই প্রমোদতরী। সে বছরই বিহারের সিওয়ান জেলার বানগাঁ গ্রামে ধরাধামের আলো দেখলেন মিথিলেশ। বিখ্যাত এক ঘটনার বছরে জন্ম নেয়াতেই হয়তো নিজের কীর্তিকলাপে বিখ্যাত হবার বাসনা উঁকি দিয়েছিলো মনে, কে জানে!
ঘটনায় ফিরি- আমেরিকান এক দম্পতি মধুচন্দ্রিমায় এসেছেন ভারতে, দাঁড়িয়ে আছেন সম্রাট শাহজাহানের প্রেমের অপূর্ব নিদর্শন তাজমহলের সামনে। সেখানেই সরকারী কর্মকর্তা সেজে তাদের কাছে পুরো তাজমহলটি বিক্রির প্রস্তাব দেন মিথিলেশ। নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে কথার জাল বোনেন সূচারুভাবে। সরকারী কোষাগার প্রায় খালি, প্রচুর টাকা দরকার তাদের, এই মূহুর্তে তাজমহলের মতো এসব শ্বেতহস্তীর রক্ষণাবেক্ষণ করার মতো টাকা সরকারের কাছে নেই- এমন একটা মনগড়া কাহিনী বানালেন।

অল্পদিনের মধ্যেই বিক্রির জন্যে নিলামে উঠবে হয়তো সব কিছু, এই কাজে সরকারী নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করলেন মিথিলেশ। জানালেন, তাকে সামান্য কিছু মুনাফা দিলে নিলামে ওঠার আগেই নিজের প্রভাব খাটিয়ে কাগজপত্র করে জায়গাটা এই দম্পতির নামে করে দিতে পারবেন তিনি। মিথিলেশের চতুর কথাবার্তা আর অনর্গল ইংরেজীতে মুগ্ধ হলেন আমেরিকান দম্পতি, বিশেষ করে স্বামী ভদ্রলোক।
বিশ্বসংসার তন্নতন্ন করে একশো আটটি নীলপদ্ম এনেও নারীর মন পাওয়া যায় না, আর এ তো হাতের মুঠোয় তাজমহল ধরা দিচ্ছে, তাও জলের দরে! সপ্তাখানেকের মধ্যেই আগ্রার এক রেস্টুরেন্টে মিথিলেশের সাথে দু-তিনবার সাক্ষাৎ হলো তাদের, কাগজপত্রও হাতে পেলেন বেশ কিছু; সরকারী দপ্তরের সীলমোহর সমেত। অবশ্য এগুলো জোগাড় করতে প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে দাবী করে বেশ কিছু অর্থও গছিয়ে নিয়েছেন মিথিলেশ, তাতে কী! হাতে ধরা দিচ্ছে দুনিয়ার সপ্তাশ্চর্যের একটি- তাজমহল; টাকা তো অল্পবিস্তর যাবেই!
আমেরিকান দম্পতির ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে, তাই তাগাদা দেয়া হলো মিথিলেশকে। তিনদিনের সময় চেয়ে নিয়ে টাকার ব্যবস্থা করতে বললো সে, এরমধ্যে সব গুছিয়ে আনবে সে কথা দিলো। টাকার অঙ্কটা জানা যায়নি, সত্তরের দশকে লাখ দশেক রূপীর কম হওয়ার কথা নয় সেটা; এখনকার হিসেবে দশ কোটিই ধরুন প্রায়! যথাসময়ে টাকার ব্যবস্থা হলো, তাজমহলের সামনেই হলো লেনদেন, চুক্তির অর্ধেক টাকা পরিশোধ করেছিলেন বলে পরে জানান যুগল।
টাকা নিয়ে সই-সাবুদ সম্পন্ন করা হলো, সম্পত্তি বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে দুইদিন পর তাজমহলের সামনেই আসতে বলে বিদায় নিলেন শ্রীবাস্তব সাহেব। প্রত্নতাত্ত্বিক মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও হাজির থাকবেন সেদিন- এমনটাই জানিয়েছিলেন মিথিলেশ। দু’দিন পর স্বামী-স্ত্রী টের পেলেন কতো বড়ো জালিয়াতের পাল্লায় পড়েছিলেন তারা; থানা-পুলিশ-মিডিয়া জানানোই সার হলো, টাকা নিয়ে মিথিলেশ কুমার শ্রীবাস্তব, ওরফে নটবরলাল ততোক্ষণে হাওয়া!
এটা তো কেবল একটা গল্প, এরপরে এক তাজমহলই আরো দুই দুইবার বিক্রি করেছিলেন তিনি, আলাদা কায়দায়। দিল্লির লালকেল্লা বিক্রি করেছেন দু’বার, রাষ্ট্রপতি ভবন বিক্রি করবেন বলে স্বল্প অঙ্কের একটা দাও মেরেছিলেন এক মারোয়াড়ী ব্যবসায়ীর পিঠে। একবার তো মন্ত্রী-সাংসদ সমেত নাকী বিক্রি করে দিয়েছিলেন খোদ সংসদ ভবনই!
দেখতে আর পাঁচজন সাধারণ লোকের মতোই ছিলেন, যৌবনে আইন ব্যবসাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন; কথা দিয়ে মন ভোলাতে ছিলেন ওস্তাদ। অপরাধজীবনের হাতেখড়ি হয়েছিলো ছোটবেলাতেই, গ্রামের এক লোকের ব্যাংক চেক চুরি করে স্বাক্ষর নকল করে এক হাজার রূপী মেরে দিয়েছিলেন। সেটাই ছিলো শুরু।
অন্যের স্বাক্ষর হুবহু নকল করায় দারুণ প্রতিভা ছিলো এই লোকের, আম্বানী-বিড়লাদের মতো রাঘববোয়াল ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত আতঙ্কে থাকতেন, কখন তাদের স্বাক্ষর জাল করে টাকাপয়সা মেরে দেয় এই ঘাঘু ঠগ! ধীরুভাই আম্বানীর স্বাক্ষর জাল করে ব্যাংক থেকে টাকা আত্মসাতের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে! ডন সিনেমায় শাহরুখ খানকে খুঁজছিল এগারো দেশের পুলিশ, আর ভারতের আটটি রাজ্যের পুলিশ হন্যে হয়ে লেগে ছিলো নটবরলালের পেছনে।
অন্তত শ’খানেক মামলা ঝুলছিলো ঘাড়ের ওপর, সর্বমোট সাজা হয়েছিলো ১১৩ বছরের। কিন্ত এই বান্দাকে আটকে রাখে এমন সাধ্য কার! নতুন নতুন কৌশলে জেল থেকে পালাতেন তিনি, একেকবার একেক উপায়ে। একবারও পুরো সাজা খাটার রেকর্ড নেই তার। তবুও বিভিন্ন সময়ে ধরা পড়েছেন, জীবনের বিশটি বছর কাটাতে হয়েছে জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। কিন্ত চরিত্র ঠিক হয়নি, বেরিয়েই আবার লোক ঠকানোর মিশনে নেমেছেন নতুন উদ্যমে।

১৯৯৭ সালে দিল্লির রাজা জুয়েলার্সে এক মন্ত্রীর এপিএসের পরিচয় দিয়ে ঠগবাজী করার সময় হাতেনাতে গ্রেফতার হন। বয়স তখন চুরাশি; সবাই ভেবেছিলো এটাই বুঝি শেষ, এবার জেলে গেলে লাশ হয়েই বেরুবেন। কিন্ত নিজের ভাগ্যরেখা মিথিলেশ সম্ভবত নিজেই লিখেছিলেন; ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না, হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেন- এই লোকটা কিনা পুলিশ ভ্যান থেকে বেমালুম গায়েব হয়ে গেলেন!
কানপুর জেল থেকে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্স হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় ঘটলো এই অভাবনীয় ঘটনা। মিথিলেশের চেহারাও আর কোথাও দেখেনি কেউ। লোকচক্ষুর অন্তরালে কেমন আছেন, বেঁচে আছেন কিনা আদৌ, কে জানে! পরিবার থেকে দাবী করা হয়েছিলো সে বছরই মারা গেছেন মিথিলেশ, যদিও তার আইনজীবির দাবী ২০০৯ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন এই প্রতারক।
এত কীর্তিকলাপের পরেও মিথিলেশ তার এলাকার লোকজনের কাছে ছিলেন চরম জনপ্রিয়, বিভিন্ন জায়গায় লোক ঠকিয়ে আনা টাকাপয়সার বেশীরভাগই নাকী বিলিয়ে দিতেন নিজের শহরের গরীবদের মাঝে। একই ব্যক্তির মধ্যে খেলা করতো ডক্টর জেকিল এন্ড হাইড; কারো কাছে মিথিলেশ ছিলেন ঠগ-প্রতারক, কারো কাছে রবিনহুড। গ্রামের লোকজন চেষ্টা করেছিলেন তার মূর্তি বানিয়ে গ্রামের প্রবেশপথে রাখতে, প্রশাসনের বাধায় সেটা সম্ভব হয়নি যদিও।
পুলিশের খাতায় আনসলভড কেস হিসেবেই বেঁচে আছেন নটবরলাল, এখনও ভারতে জোচ্চুরীর প্রতীক হিসেবে তার নামটাই উচ্চারিত হয়, যদিও সেটা ঘৃণাসহকারে। সর্বকালের সেরা জোচ্চুরীর তালিকা কেউ করলে নটবর খুব সহজেই সেরাদের কাতারে থাকবেন, তাতে সন্দেহ নেই বিন্দুমাত্র।
যুগের পর যুগ ধরে সাধারণ লোকজনের পাশাপাশি ঘাঘু পুলিশ অফিসারদের ঘোল খাইয়ে চোখে ধুলো দিয়ে হাওয়া হয়ে যাওয়া এই লোকটার কীর্তিকলাপ নিয়ে বলিউডে সিনেমা হয়েছে বেশ ক’টি। 'মিস্টার নটবরলাল' নামের সিনেমার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বিগ বি-অমিতাভ বচ্চন, আর হালের ইমরান হাশমী অভিনীত সিনেমাটির নাম ছিলো 'রাজা নটবরলাল'।
তাজমহল থেকে সংসদ ভবন অন্যের হাতে গছিয়ে দিয়ে তাদের পকেট খালি করতে জুড়ি ছিলো না যার, বিদেশী একটা পর্যটক দলের কাছে পাঁচশোর বেশী সাংসদসহ সংসদভবন পুরোটা বিক্রি করে দেয়া সেই লোকটাকে ভুলে যায়নি ভারতের মানুষ। বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার এতোগুলো বছর পরেও মিথিলেশ বা তার কার্যকলাপ নিয়ে আলাপ আলোচনা কম হয় না; কোথাও না থেকেও তাই মিথিলেশ কুমার শ্রীবাস্তব বিচরণ করেন লোকের ঠোঁটের ডগায়, মাথার ভেতর জমে থাকা প্রশ্নে!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন