মিশন সেভ বাংলাদেশ: আমাদের এগিয়ে চলার গল্প
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
কথায় কথায়, উঠতে বসতে আমরা কর্পোরেটদের গালি দেই। যেন সব সমস্যার গোড়া তারাই। কিন্তু করোনার এই দুঃসময়ে বাংলাদেশের কর্পোরেটরা যে অনন্য এক উদ্যোগ নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, সে গল্প কজন জানি আমরা?
তিনজন মানুষের একটা সাধারণ কনফারেন্স কল থেকে শুরু হয়েছিল অসাধারণ একটা উদ্যোগের, লতাগুল্ম থেকে যেটা ডালপালা ছড়িয়ে পরিণত হয়েছে বটবৃক্ষে, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, অসহায় মানুষকে সাহায্য করার এই উদ্যোগটার নাম 'মিশন সেভ বাংলাদেশ'। করোনার প্রকোপে বিপন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন অসহায় মানুষকে সাহায্য করার জন্য ব্যক্তি উদ্যোগে শুরু হওয়া একটা একটা প্ল্যাটফর্ম ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে, অর্জন করেছে বিশালতা, একে একে কর্পোরেট জায়ান্টরা এসে জড়ো হয়েছে এখানে, মাশরাফি বিন মুর্তজা থেকে সাকিব আল হাসান কিংবা ইলিয়াস কাঞ্চন- আর্ত মানবতার ডাকে সবাই এসে দাঁড়িয়েছেন এক ছাতার নিচে, বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের হাত- সেই চমৎকার জার্নিটার নামই 'মিশন সেভ বাংলাদেশ!'
যেভাবে হলো শুরু
শুরুটা হয়েছিল লকডাউনের মধ্যে ঝুঁকির মুখে পড়া দিনমজুর মানুষজনকে সাহায্য করার জন্যে। তখনও কোন প্ল্যাটফর্মের জন্ম হয়নি। অসহায় মানুষের পাশে কিভাবে দাঁড়ানো যায়- এ নিয়ে আলোচনা করছিলেন আদনান ইমতিয়াজ, তাজদিন হাসান ও ইমরান কাদির। সেখান থেকেই তারা শুরু করলেন মিশন সেভ বাংলাদেশের কাজ। এই লড়াইয়ে তাদের পাশে এসে দাঁড়ালো দেশের শীর্ষস্থানীয় দুই সংবাদ মাধ্যম সমকাল, ও ‘ডেইলি স্টার’ এবং সেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘সেবা ডট এক্সওয়াইজেড’।
মার্চ মাসের তেইশ তারিখে আলাপের শুরুটা হয়েছিল তিনজনের মধ্যে। ছাব্বিশ তারিখ থেকে সাধারণ ছুটি শুরু হবার গুঞ্জন বাতাসে ভাসছে তখন। দুই হাজার শ্রমজীবী মানুষকে অন্তত দশ দিনের খাবার কিনে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তারা, সেটার জন্যে প্রায় বিশ লক্ষ টাকার প্রয়োজন- অথচ হাতে সময় আছে মাত্র তিনদিন! এর মধ্যে এই বড় অঙ্কের টাকা ম্যানেজ করা যাবে তো? যোগাযোগ করা হলো কর্পোরেট হাউজগুলোর সঙ্গে। কেউ রাজী হলো, একদম নতুন উদ্যোগ হওয়ায় কারো তরফ থেকে আবার সাড়া মিললো না। মার্চের তেইশ তারিখে উদ্যোগটা নেয়া হয়েছিল, ২৬ তারিখ থেকে সাধারণ ছুটি শুরু হবার কথা- ছাব্বিশ তারিখে দেখা গেল বাইশ লক্ষ টাকা জোগাড় হয়ে গেছে!
এটাই সাহস যোগালো উদ্যোক্তাদের। ডেইলি স্টার, সমকাল এবং সেবা ডট এক্সওয়াইজেড এর হাত ধরে যে জার্নিটা শুরু হয়েছিল, সেখানে একে একে যুক্ত হতে থাকলো আরও অজস্র নাম। জন্ম হলো 'মিশন সেভ বাংলাদেশ'- এর। ব্র্যান্ডগুলো এই দুর্যোগের সময়ে পেলো ভরসা করার মতো একটা জায়গা, যেখানে দাঁড়িয়ে মানুষের জন্য কাজ করা যায়, কারণ কর্পোরেট হাউজগুলোর পক্ষে তো স্বেচ্ছাসেবক ম্যানেজ করে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব নয়।
এক মাস, কোটি টাকার গল্প
মার্চের তেইশ তারিখে শুরু হওয়া উদ্যোগটা কতটা সফল হয়েছে, কি পরিমাণ সাড়া পেয়েছে- সেটা জানার জন্যে প্রথম এক মাসের পরিসংখ্যানে চোখ বুলালেই হবে। এই সময়ের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে মিশন সেভ বাংলাদেশ প্রায় এক কোটি টাকা অর্থমূল্যেরও বেশি সাহায্য করেছে অসহায় মানুষকে। ত্রিশ দিন আগে জন্ম নেয়া একটা প্ল্যাটফর্মের জন্য এত বিশাল অঙ্কের ফান্ড রেইজ করা কিংবা সেটা মানুষের সাহায্যে ব্যয় করাটা বাংলাদেশের বাস্তবতায় অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার- সেটাই করে দেখিয়েছে মিশন সেভ বাংলাদেশ। রমজান শুরু হবার আগেই তারা অজস্র পরিবারের ইফতার ও সেহেরি'র খাবারের যোগান দিয়েছে। ঢাকা শহরের অনেকগুলো স্থান জীবাণুমুক্ত করা হয়েছে মিশন সেভ বাংলাদেশের উদ্যোগে।
তারকার হাট
সময় গড়িয়েছে, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি মিশন সেভ বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বিভিন্ন অঙ্গনের জনপ্রিয় তারকারাও। দেশের মানুষের এই বিপদে সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, তিনি গঠন করেছেন 'সাকিব আল হাসান ফাউন্ডেশন', সেই প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করেছেন মিশন সেভ বাংলাদেশের সঙ্গে। মাশরাফির নড়াইল এক্সপ্রেসকে যুক্ত করা হয়েছে, চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন যুক্ত হয়েছেন ব্যক্তিগতভাবে। এর বাইরেও শত শত অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়েছে এই প্ল্যাটফর্মে- লক্ষ্য একটাই, অসহায় নিরন্ন মানুষকে সাহায্য করা।
টুকরো টুকরো মন ভালো করার গল্প
অফিস-আদালত-গণপরিবহন সব বন্ধ। নিম্নবিত্ত মানুষের জন্যে ত্রাণ নিয়ে ছুটছে অজস্র স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। বিপাকে পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি হয়তো চাকরি হারিয়েছেন, কিংবা বেতন আটকে আছে, এদিকে বাড়িওয়ালা চাপ দিচ্ছে বাসা ভাড়া দেয়ার জন্য। পকেটে টাকা নেই, বাসায় বাজার নেই, কারো কাছে সাহায্য চাওয়ার মতো অবস্থাও নেই, আত্মসম্মানের কথা ভেবে ত্রাণের জন্য কোথাও লাইনেও দাঁড়াতে পারেন না তারা- এই মানুষগুলোর চেয়ে অসহায় অবস্থায় করোনা আর কাউকে ফেলেনি।
মিশন সেভ বাংলাদেশ এমন সব পরিবারের খোঁজ করেছে, তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার বাইরে মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন এক পরিবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় রোজগার হারিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন, চুলা জ্বলছিল না ঘরে। তাদের জন্যে পাঠানো হয়েছে খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী। আরেক জায়গায় পরিবারের কর্তা চাকরি হারানোয় অসহায় অবস্থায় পতিত হয়েছিল এক পরিবার, দুটো দিন কেবল শুকনো খাবারের ওপর কোনভাবে টিকে ছিলেন তারা। মিশন সেভ বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে পরিবারটি, তাদের জন্যেও পাঠানো হয়েছে প্রয়োজনীয় সামগ্রী। মন ভালো করে দেয়ার এমন অজস্র গল্প জমা হয়েছে গত দুই মাসে।
প্রাপ্তির খেরোখাতা
মে মাসের ২৩ তারিখ পর্যন্ত মিশন সেভ বাংলাদেশের উদ্যোগে ১ কোটি ৬১ লাখ টাকার বেশি দান গ্রহণ করা হয়েছে। মোট ৫৩৪ জন দাতা (ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান) মিলে এই টাকাটা দান করেছেন। মোট ১১২১৮টি পরিবারকে খাবার দেয়া হয়েছে গত দুই মাস ধরে। পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষ খাবার পেয়েছেন। ৪০৪টি পরিবার পুরো এক মাস ধরে সেহেরি ও ইফতার পেয়েছে। ৫১৩টি পরিবারকে দেয়া হয়েছে ঈদ উপহার। ঢাকার বাইরেও ১৪টি জেলাশহরে খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
দুই মাসে মিশন সেভ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ১৬টি হ্যান্ড ওয়াশিং বেসিন স্থাপন করা হয়েছে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে। ৪৮১টি এলাকা ডিজইনফেক্ট করা হয়েছে। ৯১০০টি মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে। ৭টি এলাকায় ১৭০টিরও বেশি দোকানের সামনে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্যে সাদা কালি দিয়ে মার্ক করে দাঁড়ানোর জায়গা এঁকে দেয়া হয়েছে। এর বাইরেও ডাক্তারদের জন্যে পিপিই সরবরাহ, রোগীদের জন্যে ভেন্টিলেটর স্থাপন নিয়ে কাজ করছে এই প্ল্যাটফর্ম। করোনার ক্রান্তিকাল শেষ হয়ে গেলে অর্থনৈতিক ভঙ্গুর অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীরা যাতে অনুদান ও ঋণ সহায়তা পান সেজন্য টেলিকম অপারেটর রবি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসি কে সাথে নিয়ে ৪০ কোটি টাকার মুলধন সহায়তা তহবিল গঠন করা হয়েছে।
ত্রাণ পৌঁছানোর পরিবহন খরচ কমানোর জন্য চারটি পণ্য সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিশন সেভ বাংলাদেশ সমন্বয় করেছে, লজিস্টিক ও পরিবহন সুবিধা ব্যবহারের জন্য। তাদের ওই সহায়তায় পরিবহন ও সেবা পৌছে দেওয়ার কাজটা নুন্যতম খরচে করা সম্ভব হয়েছে। বিদ্যানন্দের সঙ্গেও কিছু জায়গায় যৌথভাবে কাজ করছে তারা। স্বেচ্ছসেবকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে, সাবধান থেকে কাজ করার চেষ্টা করেছে সবাই। স্বচ্ছতার জায়গাটা নিশ্চিত রাখতে তারা ‘আরনেস্ট এন্ড ইয়ং’কে আয়-ব্যয় নিরীক্ষার কাজে যুক্ত করেছেন। প্রত্যেক দিন কত টাকার ফান্ড এসেছে, কী কী কাজ হয়েছে- সেসবের বিস্তারিত বিবরণ আপডেট করা হচ্ছে মিশন সেভ বাংলাদেশের ফেসবুক পেজ এবং ওয়েবসাইটে।
মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য- এই গান বিমূর্ত হয়ে উঠেছে করোনার দুঃসময়ে। অনেকে যেখানে মানুষকে জিম্মি করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে, সেখানে কিছু মানুষ নিঃস্বার্থভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে, নিজেরাই সাহায্যের জন্যে প্ল্যাটফর্ম তৈরী করেছে, করোনা কেটে গেলে কি ব্যবস্থা নিতে হবে- সেটাও ভাবছে তারা। মিশন সেভ বাংলাদেশ এই বার্তাটা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে যে- করোনার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধটা সবার, সবাইকেই এখানে লড়তে হবে একসঙ্গে। কর্পোরেট দুনিয়া আর সাধারণ মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধনের অসাধারণ এক গল্প লিখে ফেলেছে মিশন সেভ বাংলাদেশ। দুই মাস বয়েসী একটা সংস্থার জন্যে এটা বিশাল এক অর্জন। সব খারাপেই নাকি ভালো কিছু থাকে। করোনাভাইরাসের এই দুঃসময়ে আমাদের প্রাপ্তি বিদ্যানন্দ বা মিশন সেভ বাংলাদেশের মতো এই উদ্যোগগুলোই, যারা আমাদের আশায় বুক বাঁধতে শেখায়, স্বপ্ন দেখার সাহস যোগায়...