মাত্র ষোলো বছর বয়সে বিনা অপরাধে 'সন্ত্রাসী' ট্যাগ নিয়ে নিসারকে যেতে হলো জেলে। সে সাথে অভিযুক্ত হলেন বড়ভাইও। সব অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করে নিসার যখন বের হলেন বাইরে, তখন পেরিয়ে গেছে তেইশটি বছর...

আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আমাদের শাসকেরা শাসনযন্ত্রের খুব বড় বড় দায়িত্বে থাকেন। সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে তারা দুই একটা ছোটখাটো ভুল করেও ফেলেন। তাদের কাছে হয়তো এ ভুলগুলো কিছুই না। কারণ তাদের তো বড় বড় সব কাজ। দুয়েকটা 'পান থেকে চুন খসা' ভুল হতেই পারে। কিন্তু যাদের জীবনের সাথে এই ভুলগুলো করা হয়, তারা কি কোনোরকম প্রতিকার পায়? প্রশাসকদের নির্দোষ ভুলে এই মানুষগুলোর জীবন কি 'তাসের ঘর' হয়ে যায় না? 

এ গল্প নিসারের। ভারত-শাসিত কাশ্মিরের বাসিন্দা সে। গল্পের শুরু আজ থেকে তেইশ বছর আগে। ১৯৯৬ সালে। নিসার তখন অল্পবয়সী এক কিশোর। কিশোর নিসার একদিন নেপালে যায়। তাদের কলোনির একজন ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে বকেয়া ভাড়া আদায় করার জন্যে। ভাড়াটিয়া টাকা জোগাড় করার জন্যে দুইদিন সময় নেয় নিসারের থেকে। নিসারও তাই দুইদিনের জন্যে নেপালে থেকে যায়। পরের দিন সকালে সে একটা কাজে বের হয় ঘর থেকে। সেই কাজে যাওয়ার আগেই পুলিশ রাস্তাতেই আটকায় নিসারকে। 

পুলিশ নিসারকে একটা ছবি দেখিয়ে জানতে চায়, এই ছবির মানুষটিকে সে চেনে কি না।কাকতালীয়ভাবে ওই ছবিটা ছিলো কলোনির সেই ভাড়াটিয়ার, যার জন্যে নিসারের দুই দিনের অপেক্ষা। নিসারও সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়। এরপরেই পুলিশ গ্রেফতার করে তাকে। জানা যায়, দুইটা বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাতে পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে তাকে গ্রেফতার করছে। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লীতে। দিল্লীতে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে যখন তাকে একটা অন্ধকার ঘরে নেওয়া হয়, নিসার দেখতে পায়, সেখানে তার বড়ভাই ইফতিয়ারও আছে। জানতে পারা যায়, বড় ভাইকেও বোমা বিস্ফোরণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এদের সাথে আরো কয়েকজনকেও গ্রেফতার করা হয় একই অভিযোগে। 

পুরো পরিবারের উপর যেন নেমে আসে দীর্ঘশ্বাস। ঘরের শক্তসমর্থ দুই ছেলে জেলে আটক, তাদের মামলা লড়া, সমাজের বক্রদৃষ্টি মোকাবেলা করা... নিসার আর ইফতিয়ারের পরিবারের যুদ্ধটাও কম ছিলো না। 

শুরু হয় আরেক টালবাহানা। এদের মামলার চার্জশিট দিতে দিতে পুলিশের পাঁচ বছর লেগে যায়। এরপর জেলে ১৪ বছর কাটানোর পর দিল্লির এক আদালত নিসার এবং কাশ্মীরের দুই অভিযুক্তকে ফাঁসির সাজা দেয়। ইফতিয়ারসহ কয়েকজনকে দেয়া হয় খালাস। পরবর্তীতে নিসারের রায়ের বিপরীতে আপিল করা হয়। আপিলের দুই বছর পরে এসে নিসারকে ছেড়ে দেওয়া হয়। 

তবে সমস্যা তখনো পিছু ছাড়েনি। নিসার ছাড়া পাওয়ার পরে রাজস্থানে আরেকটা বোমা বিস্ফোরণের মামলায় তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। আদালয়ে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়। এই রায়ের বিরুদ্ধেও হাইকোর্টে আপিল করে নিসারের পরিবার। গতবছরে এসে নিসারসহ বেশকয়েকজন অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস দেয় আদালত৷ তাদেরকে অভিযুক্ত প্রমাণ করার মতন কোনো সাক্ষীসাবুদ, নথিপত্র ছিলো না পুলিশের হাতে। 

জেল, নিসারের জীবন থেকে কেটে নিয়েছে তেইশটি বছর! 

ভাইকে জেল থেকে ছাড়াতে গিয়ে ইফতেখার নিজে হারিয়েছেন তার চাকরী। পরিবারসূত্রে তাদের ছিলো কাশ্মিরী শালের ব্যবসা। সেই ব্যবসাও অনেকদিন ধরে বন্ধ। বলতে গেলে, পুরো পরিবারটাই একরকম সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছে। অথচ কেউ কি বলতে পারেন, কী দোষ ছিলো এই পরিবারের? এই দুটি ছেলের? এই যে নিসার নামের ছেলেটি তার জীবন থেকে তেইশটি বছর খুইয়ে ফেললো, তাকে কী ক্ষতিপূরণ দেবে প্রশাসন? কতটুকু ক্ষতিপূরণ যথেষ্ট হবে? একটা পরিবার যে ধুলোয় মিশে গেলো প্রায়, সেটার জন্যেও বা কাকে দায়ী করা উচিত হবে? প্রশাসনকে, আদালতের দীর্ঘসূত্রিতাকে? পুলিশের জবাবদিহিতাবিহীন যথেচ্ছাচারকে? নাকি, নিসার ও ইফতিয়ার এর ভাগ্যকে? 

অবশ্য রাষ্ট্রের বড় বড় বিষয়ের তুলনায় এগুলো তো নগন্য ধূলিকণা মাত্র। রাষ্ট্রের মাথাদের এতকিছু ভাবলে কি চলে?

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা