মাত্র ২৫ বছর বয়সেই হায়দ্রাবাদের ক্ষমতা পান এই শাসক। দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে তিনি শাসন করেন ভারতের বৃহত্তম এই রাজ্যটিকে। সেই সময়ে তার মতো ধনী গোটা বিশ্বে আর কেউ ছিলেন না...

রূপকথার বইয়ের হলদেটে পৃষ্ঠা আমাদের ছোটবেলা থেকেই বুঝিয়ে এসেছে, আগের যুগের মানুষের অঢেল ধনসম্পদ ছিলো। রাজারাজড়াদের ছিলো বাড়াবাড়ি রকমের অর্থবিত্ত। যদিও সময়ের ফেরে বর্তমানে সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। তবুও মাঝেমধ্যে যখন দুই একজন তৎকালীন বিত্তবান মানুষের ঐশ্বর্যের সুলুকসন্ধান আমরা পাই, চমকে উঠি। সেরকমই একজন ছিলেন,  হায়দ্রাবাদের শেষ নিজাম, মীর ওসমান আলী খান বাহাদুর, সপ্তম আসাফ জাহ। 

মীর ওসমান আলী খান, সপ্তম আসাফ জাহ ২৫ বছর বয়সে হায়দ্রাবাদের সিংহাসনে বসেন এবং  ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি শাসন করেন হায়দ্রাবাদকে। তবে তার শাসনামলে 'শাসক' পরিচয়কে ছাপিয়ে তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত হন 'বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিত্তশালী' হিসেবে। ১৯৩৭ সালের টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদেও আসে তার নাম; বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে৷

প্রশ্ন উঠতে পারে, এত ধনসম্পদের মালিক হলেন কীভাবে তিনি? এর পেছনে প্রথম কারণটি ভৌগোলিক। তৎকালীন সময়ে হায়দ্রাবাদ ছিলো বিশ্বের একমাত্র হীরা সরবরাহকারী এলাকা। এছাড়াও হায়দ্রাবাদের মোট আয়তন ছিল ৮৬,০০০ বর্গ মাইল (২২৩,০০০ কি.মি.)। এই বিশাল রাজ্যের পুরোটা জুড়েই ছিলো মীর ওসমান আলী খান, সপ্তম আসাফ জাহ এর শাসন। এ রাজ্যটি ভারতের স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ শাসিত রাজ্যগুলির ভেতরে ছিল বৃহত্তম।

তাকে ডাকা হতো  হায়দ্রাবাদের নিজাম মহামান্য অধিপতি (হিজ এক্সলটেড হাইনেস) হিসাবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তার রত্নাগারে সোনাদানা ছিলো ৫৪.৯ মিলিয়ন পাউন্ডের। সবমিলিয়ে তার মোট সম্পত্তি ছিলো ১৫০.৪ মিলিয়ন ডলার। বর্তমান সময়ে যা ২৩৬ বিলিয়ন ডলারের সমান। এছাড়াও নিজামের রত্নাগারে ছিলো একটি বড় হীরা, যেটির নাম- জ্যাকব ডায়মন্ড। রানী এলিজাবেথের বিয়েতেও তিনি অঢেল অলঙ্কার উপহার দিয়েছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো একটি নেকলেস, যেটি 'হায়দ্রাবাদের নিজামের নেকলেস' নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায়। 

তার শাসনামলে তিনি যে শুধু অর্থবিত্তেরই মালিক হয়েছেন, এমনটি সত্যি নয় মোটেই। তিনি বেশ কিছু জনকল্যাণমুখী কাজও করেছিলেন। তার শাসনামলেই হায়দ্রাবাদে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়। রেলপথ, সড়কপথ ও বিমানপথেরও আমূল পরিবর্তন হয়। এছাড়াও অজস্র বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারী প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ব্যাংক, এয়ারপোর্ট নির্মিত হয় তার শাসনামলে। বন্যা প্রতিরোধের জন্যে জলাধারও নির্মাণ করেন তিনি। তার এসব কাজের জন্যে তাকে 'আধুনিক হায়দ্রাবাদের স্থপতি' হিসেবেও সম্মান করা হতো।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেও তিনি মানুষকে সেবা করার ধারা অব্যাহত রাখেন। তিনি নিজাম অর্থোপেডিক হাসপাতাল নির্মাণ করেছিলেন,  যেটির বর্তমান নাম- নিজাম'স ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস (এনআইএম)। এছাড়াও তিনি তার বেশ কিছু জমি জনকল্যানমূলক কাজের জন্যে সরকারকে নামমাত্র মূল্যে ইজারা দিয়ে দিয়েছিলেন। 

জানা যায়, মীর ওসমান আলী খান, সপ্তম আসাফ জাহ'র সম্মানে ২১ বার তোপধ্বনি করা হতো। এটি ছিলো এমন এক বিরল সম্মান, যা ব্রিটিশ রাজত্বে পাঁচজন মাত্র যুবরাজ পেতেন। 

সাতচল্লিশ এর দেশভাগের এক বছর পরেই, অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে, ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দ্রাবাদ রাজ্য আক্রমণ করে এবং দখল করে নেয়। পতন ঘটে ৩৭ বছর ধরে শাসন চলে আসা এক শাসকের। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে, মীর ওসমান আলী খান মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ভারত সরকার রাষ্ট্রীয় শোকও ঘোষণা করেছিলো। অর্থাৎ যথোপযুক্ত সম্মান নিয়েই তিনি প্রয়াত হয়েছিলেন চিরতরে। 

সভাসদদের সাথে নিজাম মীর ওসমান আলী! 

মীর ওসমান আলী খান, সপ্তম আসাফ জাহ শুধুমাত্র যে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনী ছিলেন, তা নয়। তিনি ছিলেন সমাজ-সংস্কারক, ন্যায়বিচারক ও একজন দক্ষ শাসকও। নানামুখী ষড়যন্ত্রে বিপর্যস্ত হয়ে ক্ষমতা ছাড়ার আগপর্যন্ত তার শাসনামলে স্বস্তি পেয়েছিলো হায়দ্রাবাদের স্থানীয় অধিবাসীরা। সে হিসেবে এখনো তিনি জীবিত, তার নানা অবদানের মধ্য দিয়ে, যেগুলোকে বিনম্রচিত্তে স্মরণ করে সবাই। সে সাথে মনে পড়ে যায়, বহু পঠিত সেই লাইনটিও-

কীর্তিমানের মৃত্যু নাই... 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা