নতুন বছর, কিন্তু পুরনো সেই দৃশ্যপট। লাশের মিছিল যেন থামছেই না। অভাবের তাগিদে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে যাওয়া আমাদের কর্মীরা লাশ হয়ে ফিরছেন। মনে হচ্ছে, মরুভূমির শকুনদের কাছে মানুষ না খাবার পাঠাচ্ছি আমরা। লাশের মিছিল আর কত বড় হলে ভাঙবে আমাদের নীরবতা?

২০২০ সালের প্রথম ৪৪ দিনে মধ্যপ্রাচ্য থেকে লাশ হয়ে ফিরেছেন ৪০৯ জন বাংলাদেশি কর্মী। সরকারি হিসাবে গত এক দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২৭ হাজার ৬৬২ জন প্রবাসী শ্রমিকের লাশ দেশে ফেরত এসেছে। ২০১৯ সালেও তিন হাজার ৬৫৮ জনের মরদেহ ফিরেছে দেশে। অর্থাৎ গত বছর প্রতিদিন গড়ে ১০ জনের বেশি প্রবাসীর লাশ এসেছে। এই লাশের মিছিলে অধিকাংশ জায়গা জুড়ে আছেন হচ্ছেন নারী কর্মীরা। সন্তান, স্বামী, সংসার রেখে যখন একজন নারী অচেনা একটি দেশে দুইটি পয়সা রোজগার করতে যায় তখন নিশ্চয়ই লাশ হয়ে ফিরে আসার কথা কল্পনাও করে না। অথচ সেই একই নির্মম পরিণতি মেনে নিতে হচ্ছে অসংখ্য নির্যাতিত গৃহকর্মীদের।

মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সবচেয়ে বর্বর হচ্ছে সৌদির নাগরিকেরা। সৌদি আরবের পিশাচগুলো যখন আমাদের দেশ থেকে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়া নারীদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালায়, তাদের ধর্ষণ করে, হাত পা ভেঙে দেয়, একেকটা মেয়েকে মানসিক ভারসাম্যহীন করে ছাড়ে, তখনও আমাদের দেশের একদল লোক এই অমানুষ জানোয়ারগুলোর হয়ে সাফাই গায়, কারণ তারা সৌদির নাগরিক, তারা নাকি এসব অপরাধ করেও চ্যালচ্যালায়ে বেহেশতে চলে যাবে! কেউ কেউ তো দাবী করে, সব নাকি ইহুদি-নাসারাদের বানানো মিডিয়ার ষড়যন্ত্র, আদতে এরকম কিছু ঘটেইনি! নবীর দেশের লোকজন নাকি কোনভাবেই এমন অপকর্ম করতেই পারে না! যুক্তি শুনে মনে হয়, এদেরকে মাটি দিয়ে বানানোর সময় স্রষ্টা বোধহয় ইচ্ছে করেই মস্তিস্কের জায়গায় খানিকটা গোবর ঢেলে দিয়েছিলেন। নইলে এসব কথাবার্তা মাথায় আসে কি করে? 

ধরে নিন একদিন জানতে পারলেন, আপনার মা, বোন কিংবা স্ত্রী অমানুষিক নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের শিকার হয়ে পালিয়ে এসেছেন কর্মক্ষেত্র থেকে, কিংবা তাদের উদ্ধার করে আনা হয়েছে সংকটাপন্ন অবস্থায়! কেমন লাগবে আপনার?  তবে আমাদের মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য বলেছিলেন, বাংলাদেশি গৃহকর্মীরা সবাই ভালো আছেন। এই লাশের মিছিল তার চোখে পড়েনি অবশ্য। খুব সহজ একটি প্রশ্ন- আপনার নিজের মা, বোন, স্ত্রী, মেয়ে কাউকে কি এইভাবে কাজ করতে পাঠাবেন? যদি নিশ্চিন্তে নিজের বাড়ির মেয়েটিকে কোথাও কাজে না পাঠাতে পারেন তবে কিভাবে গরীব অসহায় পরিবারের মেয়েদেরকে ছিনিমিনি খেলার সুযোগ করে দিচ্ছেন।

তবুও মধ্যপ্রাচ্যের পথে বাংলাদেশি কর্মীদের লাইন  

আমাদের দেশের রিক্রুটিং এজেন্সি কিংবা দালালেরা যে খুব একটা সাধু তাও না। মোটা বেতনের মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে, কোনমতে গোঁজামিল দিয়ে এই মানুষগুলোকে অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেয় তারাই। অনেকে হয়তো বলবেন, এই অবস্থা জেনেও তাহলে কর্মীরা কেন প্রবাসে যাচ্ছে? এর উত্তর খুব সহজ, কিন্তু বাস্তবতা খুব কঠিন। এই মানুষগুলো নিজের দেশে বিকল্প কোনো পথ পাচ্ছে না। নিরুপায় হয়েই ভিনদেশে অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়াচ্ছে।  

আমাদের অর্থনীতির চাকা ঘুরে যাদের আয় দিয়ে, তাদের জন্য একটু কার্যকরী পররাষ্ট্রনীতি কি আমরা প্রয়োগ করতে পারি না? আমরা না হয় সাধারণ মানুষ, অভিযোগ ছাড়া তেমন কিছু করবার নেই। ইস্যু আসে ইস্যু যায়, ইস্যুর ভিড়ে আমাদের মানবতাও ভেসে যায়। এই দেশের নীতিনির্ধারকেরাও কি আমাদের মতোই অসহায়? তাদের কি কিছুই করবার নেই? জানি এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে না। শুধু লাশ মিলবে লাশ।  

তথ্যসূত্রঃ কালের কন্ঠ 

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা