ট্রান্সফার সাগা অফ লিওনেল মেসি: সাজানো নাটক, নাকি আত্মত্যাগের বলি?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
আপনারা 'কাপুরুষ মেসি', 'অভিনেতা মেসি'কে দেখেন। আমি দেখি শান্তশিষ্ট মানুষটার প্রতিবাদী এক ভাবমূর্তি, ক্লাবে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েও তিনি জোর গলায় উচ্চারণ করেন সভাপতির মিথ্যাচার, ম্যানেজমেন্টের অব্যস্থাপনা আর পরিকল্পনাহীন আচরণ নিয়ে...
লিওনেল মেসি থেকে গেলেন। বার্সেলোনার জার্সিতে আরও একটা বছর দেখা যাবে তাকে, সেটা গতকাল রাতেই জেনে গেছেন সবাই। বার্সেলোনাও তাদের অফিসিয়াল ইন্সটাগ্রাম ও টুইটার অ্যাকাউন্টে জানিয়ে দিয়েছে, মেসি থাকছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবাই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে এখন, কেউ মেসির সিদ্ধান্তে স্বস্তি প্রকাশ করছেন, কেউবা বলছেন গোটাটাই ছিল নাটক। বায়ার্নের কাছে বিধ্বস্ত হওয়ার দায় এড়াতে, অথবা বেতন বাড়াতেই এসব ধান্ধা। কিন্ত গোল ডটকমের সঙ্গে মেসির আঠারো মিনিটের সাক্ষাৎকারটা দেখে অন্তত পুরো ব্যাপারটাকে নাটক বলতে পারছি না, বলা সম্ভবও না হয়তো।
মেসি নিজেই বলেছেন, বার্সা ছাড়ার ব্যাপারে ক্লাব প্রেসিডেন্ট এবং বোর্ড কর্তাদের তিনি আগেই জানিয়েছিলেন। বার্তামেউ তাকে নিশ্চিত করেছিলেন, মৌসুম শেষে ক্লাব ছাড়ার সিদ্ধান্ত মেসির হাতেই থাকবে। মেসি বিশ্বাস করতেন, ক্লাব ছাড়ার এবং নতুন চ্যালেঞ্জ নেয়ার এটাই সেরা সময়। বার্সেলোনা তার আঁতুড়ঘর, এখানেই তিনি ক্যারিয়ার শেষ করতে চেয়েছেন। কিন্ত গত কয়েক বছরে বড় মঞ্চে বা বিগ ম্যাচে বারবার দলের ভেঙ্গে পড়া দেখতে দেখতে মেসি বুঝতে পেরেছিলেন, দলের খোলনলচে না বদলালে সফলতা আসবে না। সেই বদলের আবশ্যিক একটা অংশ- তার সরে যাওয়া। বার্সেলোনায় থাকলে তার ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সেও উন্নতি আসবে না, সেটা ভেবেই নতুন করে কোথাও ঘর বাঁধার চ্যালেঞ্জটা নিতে চাইছিলেন মেসি।
অথচ বাধ সাধলেন ক্লাব প্রেসিডেন্ট। চুক্তির শর্ত দেখিয়ে তিনি আটকে রাখলেন মেসিকে, জোর খাটালেন কাগজে লেখা কিছু শব্দ আর বাক্যের সম্ভারকে। অথচ মেসির সাথে বার্সেলোনার সম্পর্কটা কখনও কাগজে-কলমের ছিল না, ছিল আত্মার, ছিল হৃদয়ের। কুড়ি বছর আগে বার্সার টেকনিক্যাল ডিরেক্টর একটা টিস্যু পেপারের ওপর তেরো বছরের এক কিশোরের স্বাক্ষর নিয়ে তাকে ক্লাবের ইউথ অ্যাকাডেমিতে সাইন করিয়েছিলেন, সেদিন থেকেই তো লিওনেল মেসি নামটা বার্সেলোনার। অথচ সেই ক্লাবের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে কেমন ব্যবহার পেলেন মেসি?
বিশ্বসেরা ফুটবলারের মুখেই শোনা যাক সেটা- “সারা বছর আমি প্রেসিডেন্টকে বলে এসেছি যে আমি চলে যেতে চাই, ক্যারিয়ারের নতুন লক্ষ্য ঠিক করার এবং নতুন পথে যাওয়ার সময় এসেছে। তিনি সব সময় বলেছেন, ‘আমরা পরে কথা বলব, এখন না; এটা-সেটা’ কিন্তু বলেননি। প্রেসিডেন্ট আসলেই কী বলেছেন তা আমাকে পরিষ্কার করেননি। বছরটা ছিল খুবই কঠিন। অনুশীলনে, ম্যাচে এবং ড্রেসিংরুমে আমি প্রচুর ভুগেছি। সবকিছুই আমার জন্যে ছিল কঠিন। এরপর একটা সময় আসে যখন আমি নতুন লক্ষ্য স্থির করি। আমি এটা প্রেসিডেন্টকে বলেছিলাম, আর প্রেসিডেন্ট সবসময় বলেছেন যে আমি থাকব নাকি যাব, এ বিষয়ে মৌসুম শেষে সিদ্ধান্ত নিতে পারব এবং শেষ পর্যন্ত তিনি কথা রাখেননি।”
অনেকেই বায়ার্ন ম্যাচের দিকে আঙুল তুলেছেন, ৮-২ ব্যবধানে বিধ্বস্ত হবার পরেই নাকি মেসি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ক্লাব ছাড়ার। গোল ডটকমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মেসি নিশ্চিত করেই বলেছেন, বার্সেলোনা ছাড়ার সিদ্ধান্ত তার এই মৌসুমের শুরুতেই নেয়া, সেটার সঙ্গে বায়ার্ন ম্যাচের সংযোগ ছিল না। কে জানে, সেটা হয়তো কফিনের শেষ পেরেক হিসেবে কাজ করেছে, কিন্ত মেসি বলেছেন, একটা ম্যাচ বাজেভাবে হারের কারণে ক্লাব ছাড়ার কথা তিনি কখনও মাথায় আনবেন না। বরং মেসি তার ক্লাব ছাড়তে চাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন দীর্ঘদিনের অব্যস্থাপনা আর অপেশাদার আচরণকেই।
“আমার সিদ্ধান্তটা বায়ার্ন ম্যাচের ফলাফলের কারণে ছিল না। অনেক কারণেই আমি চলে যেতে চেয়েছিলাম। সবসময় বলেছি, আমি এখানে ক্যারিয়ার শেষ করতে চাই এবং এখানেই থাকতে চাই। আমি সবকিছু জেতার মতো একটা প্রকল্প চেয়েছিলাম, শিরোপা জিততে চেয়েছিলাম, বার্সেলোনার শ্রেষ্ঠত্ব অব্যাহত রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সত্যিটা হলো, এখানে অনেক দিন ধরে তেমন কোনো প্রকল্প, পরিকল্পনা নেই। তারা (ক্লাব কর্তৃপক্ষ) আমাদের ধোঁকা দিয়েছে এবং কোনো রকমে কাজ চালিয়ে নিয়েছে। আগেও যা বলেছি, আমি সবসময় আমার পরিবার ও ক্লাবের ভালোর কথা ভেবেছি, সেটা মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছি।”
আরেকটা জিনিস মেসিকে কষ্ট দিয়েছে ভীষণ, তার বিরুদ্ধে চালানো অপপ্রচারগুলো। মেসি বার্সেলোনার ঘরের ছেলে, বার্সেলোনা আর মেসি দুটো সমার্থক শব্দের মতোই। সেই মানুষটার বিরুদ্ধে কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়েছেন, মেসি বার্সেলোনায় সুখী নন, তিনি আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছেন, নিজের পছন্দের কোরাম গড়ে এর বাইরে থাকা ফুটবলারদের দলে সুযোগ দিতে চান না- এরকম কথাও প্রচার করা হয়েছে। এগুলো ক্লাবের সঙ্গে জড়িত লোকজনই করেছে, স্প্যানিশ পুলিশের অভিযোগ ক্লাব প্রেসিডেন্ট বার্তামেউ নিজেই এসব অপপ্রচারের সঙ্গে জড়িত। মেসি রাখঢাক না রেখে কথা বলেছেন এসব নিয়েও-
“আমার বিরুদ্ধে যে খবরগুলি প্রকাশিত হয়েছে, আমাকে তা প্রচণ্ড কষ্ট দিয়েছে, বিশেষ করে মিথ্যা খবরগুলি। তারা ভেবেছিল নিজের লাভের জন্য আমি বার্সার বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে যাব। এ ধরনের কাজ আমি কখনোই করব না। আবারও বলছি, আমি চলে যেতে চেয়েছিলাম এবং এটা আমার অধিকার। কারণ চুক্তিতেই ছিল, আমাকে ছেড়ে দেওয়া যায়। ফুটবলের দুনিয়াটা খুব কঠিন এবং এখানে অনেক কপট মানুষ আছে। এই কদিনে যা হলো, এসব আমাকে সাহায্য করেছে কপটদের চিনতে, যাদের সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল ভিন্ন। ক্লাবের প্রতি আমার ভালোবাসা প্রশ্নবিদ্ধ করাটা আমাকে আহত করেছে। আরও কতদিন থাকি বা না থাকি, সেটা কোনো ব্যাপার নয়। বার্সার প্রতি আমার ভালোবাসা কখনও বদলাবে না।”
হ্যাঁ, মেসি পারতেন আইনি লড়াইয়ে যেতে, সেই রাস্তাটা শেষ অব্দি খোলা ছিল তার সামনে। বার্সা ম্যানেজমেন্ট যখন চুক্তির শর্ত দেখিয়ে তাকে আটকে রাখতে চাইছে, তখন বিষয়টাকে আদালতে নেয়ার অধিকার তার ছিল। কিন্ত মেসি সেই পথে হাঁটতে চাননি। বাকিদের কাছে বার্সেলোনা একটা ফুটবল ক্লাব, মেসির কাছে নিজের ঘর, এই ক্লাবটা তাকে বিশ্বসেরা ফুটবলার বানিয়েছে, রোজারিও থেকে অসুস্থ অবস্থায় তুলে এনে তার চিকিৎসা করেছে, লা মাসিয়ার অ্যাকাডেমিটা তাকে আজকের এই জায়গায় এনেছে। বার্সেলোনা না থাকলে তিনি কখনও মেসি হতে পারতেন না।
বাবা-মায়ের ঋণ নাকি শোধ করা যায় না, বার্সেলোনার ঋণও তো মেসি শোধ করতে পারবেন না কখনও। সেই কৃতজ্ঞতাবোধটা মেসির মধ্যে আছে, অসাধু কিছু কর্মকর্তার কারণে গোটা ক্লাবটাকে কাঠগড়ায় নেয়ার কথা তিনি ভাবতেই পারেন না। পরিবারের সঙ্গে মনমালিন্য হলে আপনি হয়তো আলাদা বাসা নেবেন, তার আগে চেষ্টা করবেন মানিয়ে নেয়ার; আদালতে নিশ্চয়ই নিয়ে যাবেন না তাদের? বার্সেলোনাও মেসির কাছে পরিবার, আর তাই ইচ্ছে না থাকলেও তিনি ত্যাগ স্বীকার করেছেন, স্বেচ্ছায় হার মেনে নিয়েছেন এই দ্বন্দ্বে।
মেসি জানেন, এই একটা মৌসুম তিনি খুশি থাকবেন না, মন খুলে খেলতে পারবেন না, মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে একটা 'কিন্ত' থেকে যাবে কোথাও, ইচ্ছের বিরুদ্ধে অনেক কিছুই করতে হবে। সেসব মাথায় রেখেই মেসি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন থেকে যাওয়ার, নিজেকে এক বছরের জন্য ক্লাবের চাহিদার কাছে বিলিয়ে দেয়ার। এই সিদ্ধান্তটার মাধ্যমে মেসি নিজের ক্যারিয়ার থেকে একটা বছর বিসর্জন দিয়ে দিলেন বললে একটুও ভুল হবে না। ক্লাবের জন্য নিজেকেই নিজে বলি দিলেন তিনি, এরচেয়ে বড় আত্মত্যাগ আর কি হতে পারে, আমার জানা নেই।
গোটা ঘটনাক্রমে কেউ কেউ 'অভিনেতা মেসি'কে আবিস্কার করে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। আমি মেসির চেহারায় ঢাকা বিষাদটা দেখি। যে বিষাদের সবটা নিজের জন্য নয়, সেখানে ক্লাবের জন্য দুশ্চিন্তাও আছে। একদিন মেসি থাকবেন না, এই ম্যানেজমেন্ট থাকবে না, বার্সেলোনা ক্লাবটা থাকবে। চোখের সামনে 'মোর দ্যান এ ক্লাব' হিসেবে পরিচিত ক্লাবটার সবগুলো স্তম্ভ ভেঙে পড়তে দেখে মেসি স্থির থাকতে পারেন না। তিনি প্রতিবাদ করেন, ক্লাবে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েও তিনি জোর গলায় উচ্চারণ করেন সভাপতির মিথ্যাচার, ম্যানেজমেন্টের অব্যস্থাপনা আর পরিকল্পনাহীন আচরণ নিয়ে। আপনারা 'কাপুরুষ মেসি'কে দেখেন, অথচ আমি শান্তশিষ্ট মানুষটার মধ্যে হঠাৎ করে প্রতিবাদী একটা ভাবমূর্তি আবিস্কার করি, তাকে 'অভিনেতা' বলতে আমার তাই বিবেকে বাঁধে বড্ড...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন