সামনে এক বড় বিপদ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য, যেখানে আমাদের টাকা থাকবে, চারপাশে ঝা চকচকে স্থাপনা থাকবে, টেকনোলজির উৎকর্ষ থাকবে, কিন্তু এরই সাথে থাকবে এক বিরাট অসুখী তরুণ জনগোষ্ঠী। এর চেয়ে লজ্জার আর কী আছে!
আমার মনে হয় সামনের ৫-৭ বছরে 'তারুণ্যের ডিপ্রেশন' বাংলাদেশে এক ভয়ংকর রূপ নেবে। আমি খুব করে চাই আমার এই আশঙ্কা পুরোপুরি মিথ্যে হোক, কিন্তু বাস্তবতা নিঃসন্দেহে অনেক অ্যালার্মিং। আমরা সবাই যদি এখনই সচেতন না হই, সামনে এক বড় বিপদ অপেক্ষা করছে যেখানে আমাদের টাকা থাকবে, চারপাশে ঝা চকচকে স্থাপনা থাকবে, টেকনোলজির উৎকর্ষ থাকবে, কিন্তু এরই সাথে থাকবে এক বিরাট অসুখী তরুণ জনগোষ্ঠী। এর চেয়ে লজ্জার আর কী আছে!
আমি বুয়েটে পড়াই প্রায় ৩.৫ বছর। এইচএসসি ১১ হতে ১৮, সকল ব্যাচেই ক্লাস নেয়া হয়েছে। নিজের বয়স কম, আর খানিকটা আড্ডাবাজ হওয়াতে ছাত্রদের সাথে বেশ ফ্রি। তাদের সাথে অনেক কথোপকথন হয়েছে, অনেকে এসেছে তাদের নিজেদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে। পুঁথিগত বিদ্যা না থাকায় কখনই তেমন সমাধান দেবার সাহস করিনি। চেষ্টা করেছি মনোযোগ দিয়ে কথা শুনতে, একটা ফ্রি এনভারনমেন্ট তৈরি করতে যাতে কিছুটা হলেও শেয়ার করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে নিজের এক্সপেরিয়েন্স শেয়ার করেছি। এর বেশি আর কীই বা করতে পারি।
তো নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখছি এমন সমস্যা দিনকে দিন একটু একটু করে বাড়ছে। বিশেষ করে আমি ফেসবুকে অনেক একটিভ থাকায় ছোটদের পোস্ট অনেক পড়া হয়। সেখানেও বেশ চোখে পড়ে ডিপ্রেশনের প্রাচুর্য। একেকজনের একেক ধরনের সমস্যা, এমন জিনিস হয়ত আপনি অনেক দেখেছেন, হয়ত সেটা আপনার কাছে সমস্যাই না। কিন্তু বিষয় তো সেটা না। আপনার কাছে আপাত 'ক্ষুদ্র' এই সমস্যাই অন্যের জীবন তছনছ করে ফেলছে। তাই এই 'ক্ষুদ্র' বিষয় বহুল আলোচনার দাবি রাখে।
আমি যখন হতাশার গল্প শুনি, পড়ি, তাদের চোখে একটা কেমন যেন চাহনি দেখতে পাই যে জীবনে সামনে আর কিছু নাই। এদের কাছে জীবন এত্ত কঠিন, এত্ত প্যাঁচালো! অনেক সময় এরা জানেও না, ঠিক কী করলে এদের ভালো লাগবে। এক আজব কনফিউশন ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায় এদের। কিন্তু বাইরের জীবন দেখলে বুঝার সম্ভাবনা কম। এক অদ্ভুত ডুয়াল পারসোনালিটি। আমার খুব ক্লোজ এক বন্ধু আছে, যার নিউজফিড জুড়ে কেবল পেসিমিস্টিক স্ট্যাটাস। যখনই সে কোনো স্ট্যাটাস দেয়, আমি বুঝি কোনও একটা কিছু হয়েছে যাতে সে বিরক্ত। আমি প্রায়ই তার সাথে এটা নিয়ে মজা করি, সেও হাসে। কিন্তু এই অভ্যাসের বদল হয়না।
যাই হোক, আমি ভাবি এই আচরণের কারণ কী? এই সিম্পল উদাহরণকে বাদ দিয়েই বলি, একজন হতাশ মানুষ আর উজ্জীবিত মানুষের মাঝেই বা পার্থক্য কী? আমার ভাষায়- জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের অনেকেরই সচেতন চিন্তার বাইরে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে, যা আমরা স্বীকারও করতে চাই না। জীবনে প্রচুর খারাপ থাকবে, আবার প্রচুর ভালো জিনিসও থাকবে। এই খারাপগুলোকে একজন কিভাবে নিচ্ছে, এটাই বড় ডিফারেন্স গড়ে দেয়।
আমি দেখেছি, কোন একটা খারাপ ঘটনায় অনেককে নিজেকে ভেঙ্গেচুরে ফেলতে, একদম গুটিয়ে নিতে। এমন এক মনোভাব নিজের মাঝে তৈরি হতে- জগতে আমার সাথেই এমন হয়, আমার জীবন তো শেষ... আমি খুব দৃঢ়ভাবেই বলতে চাই, প্লিজ ডোন্ট গেট টু হার্ড অন ইউরসেলফ। জীবনে সবসময়ই 'সুযোগ' আছে। এখানে নানান পদের, নানান ধরনের ভ্যারিয়েবল। আমরা কেবল আমাদের চেষ্টাটাই করতে পারি, এর বেশি কিছু নয়। এতে কখনও আমরা সফল হব, আবার কখনও বিফল। দুটোই মেনে নিতে হবে।
এই মেনে নেয়া নিয়ে আমার অনেক এক্সপেরিয়েন্স আছে। নিজের সৌভাগ্য যে আমি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সকল ক্ষেত্রেই অত্যন্ত মেধাবীদের মাঝে থাকবার সুযোগ পেয়েছি, তাই খুব কাছ থেকে তাদের দেখেছি। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে Attitude জিনিসটা কতটা দামী। আমাদের ফার্স্ট বয়কে দেখতাম কোনো পরীক্ষা খারাপ হলে কত সহজে একসেপ্ট করত। সুন্দর করে নিজের না পারাটা স্বীকার করত। এখানে কোনো দোষারোপ থাকত না, নিজে কতটা আনলাকি এসবের বয়ান থাকত না, থাকত শুধু সিম্পল মেনে নেয়া। আর এই মেনে নেয়া ওকে খুব নিরপেক্ষভাবে নিজের ভুলগুলো বুঝার সুযোগ করে দিত আর সেগুলোতে কাজ করে দিনশেষে ও সফল হতই।
আমাদের খুব বাজে ধারণা সফলদের জীবনে বুঝি কোন সমস্যা আসে না। তরতর করে সামনে এগিয়ে যাওয়া যেটাকে বলে। শচিন টেনডুলকার তার বইতে লিখেছে- 'জীবনে প্রতিটা ব্যাটসম্যানের এমন দিন আসবে, যখন মনে হবে তার পা সামনে ঠিক মতো এগোয় না, হাজার চেষ্টায়ও টাইমিং হয় না।' কেউই কঠিন পরীক্ষার বাইরে না। সবাইকেই এর মাঝে দিয়ে যেতে হয়। আর একেকজনের জীবন একেক রকম, তাই যতটা সম্ভব তুলনা কম করা যায়, ততই ভালো। আমাদের অভিভাবক সমাজ আমাদের মাঝে যে তুলনা, প্রতিযোগিতার যে আপাত জগত তৈরি করেছে এটা দিনশেষে কোন মিনিংই রাখে না। ট্রাস্ট মি। দিনশেষে তুমি নিজে নিজেকে কিভাবে দেখছ, কী বলছ সেটাই ম্যাটার করে।
যেহেতু, পুঁথিগত বিদ্যা নাই, তাই কোনো সমাধানকল্প আমি দিব না। খালি নিজের জীবনে বহু সংখ্যক মানুষের সাথে মেশার অভিজ্ঞতা থেকেই বলি- দয়া করে নিজেকে নিজে টেনে তুল, নিজের ব্যাপারে সৎ হও, আত্মসমালোচক হও। তোমার যদি মনে হয় তুমি সমস্যায় ভুগছ তাহলে মা-বাবাকে বল, নিজের কাছের বন্ধুকে বল। তোমার এই ফ্রি হওয়াতে সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াবে 'তোমার লোকে কী ভাববে' ভাবনা, তোমার ইগো। দয়া করে এদের ঝেটিয়ে বিদায় কর। মনে রাখবে তোমার কাছের বন্ধুও কিন্তু এর কোনো সমাধান দিতে পারবে না, এর কোনো সহজ সমাধান নেইও। কিন্তু তুমি যত নিজেকে এক্সপ্রেস করবে, তত নিজের কাছে নিজে ক্লিয়ার হবে, নিজেই নিজের পথ বের করবে।
আর তাতেও কাজ না হলে প্রফেশনাল হেল্প নাও। এতে লজ্জার কিছু নেই। কেউ যদি সমালোচনা করে, জাস্ট এড়িয়ে যাও। নিজেই নিজেকে বল mental health matters. তোমরা তরুণ, জীবনে বাঁচতে শেখ, ছোট ছোট আনন্দকে আপন করে নিতে শেখো। গান, কবিতা, লেখালেখি- যেটা করতে ভালো লাগে করো, সুস্থ, প্রতিযোগিতা বিহীন মানসিকতায় করো। কাজকে প্রচণ্ড পরিমাণ ভালবাসো। জীবনে নেগেটিভ জিনিস থাকবেই, চারপাশের পজিটিভ জিনিস দেখতে শেখো। আর সবচেয়ে বড় বিষয়- কোথাও ভুল হয়ে গেলে ইগো ভুলে বিনয়ের সাথে স্বীকার করে নাও। কোথাও ব্যর্থ হলে নিজেকে দোষারোপ না করে মেনে নাও। এতে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।
যেটাই করো, করো। নিজেকে পেসিমিজমের ঘেরাটোপ থেকে বের করো। মনে রাখবে, ডিপ্রেশন ঘেরা স্ট্যাটাসে ফেসবুকের সস্তা দুইটা লাইকের চেয়ে তুমি অনেক দামী। কোনোমতেই নিজেকে হারিয়ে ফেলা চলবে না। এই যুদ্ধে নিজেকেই নিজে এগিয়ে নিতে হবে। খালি চারপাশকে সহজ ভাবে দেখতে শিখ, নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখো- তুমি পারবেই।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন