একজন মেহরান করিমী নাসেরি এবং আঠারো বছর এয়ারপোর্টে থাকার গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
এই মানুষটা একটানা আঠারোটা বছর কাটিয়েছিলেন এয়ারপোর্টে। তার জীবনকাহিনী নিয়ে স্টিভেন স্পিলবার্গ বানিয়েছেন সিনেমাও। কিন্ত কেন তাকে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল?
দ্য টার্মিনাল। হলিউড মুভিপ্রেমীদের কাছে নামটি নিশ্চয়ই চেনা চেনা ঠেকছে? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, ২০০৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত আমেরিকান কমেডি-ড্রামাটির কথাই বলছি, যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শক্তিশালী অভিনেতা টম হ্যাংকস।
এই ছবির কাহিনী আবর্তিত হয়েছিল এক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে, যে নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে আটকা পড়ে। কেননা তাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকার দেয়া হচ্ছিল না। আর সামরিক অভ্যুত্থান চলতে থাকায় সে তার নিজের দেশেও ফিরে যেতে পারছিল না। ২০০৪ সালের ১৮ জুন মুক্তিপ্রাপ্ত, ১২৮ মিনিটের এবং ৬০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের এই ছবিটি সমালোচক মহলে যেমন প্রশংসিত হয় এর অন্তর্নিহিত বার্তার কারণে, তেমনি দারুণ ব্যবসাসফলও হয়; বিশ্বব্যাপী আয় করে ২১৯.৪ মিলিয়ন ডলার।
যারা ছবিটি দেখেছেন, তারা ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই নস্টালজিক হয়ে পড়েছেন, হাতড়ে বেড়াচ্ছেন ছবিটি দেখার সুখস্মৃতি। আর যারা এখনও ছবিটি দেখেননি, অবশ্যই এটিকে রাখতে পারেন আপনাদের ওয়াচ-লিস্টে। সময়ের অপচয় যে হবে না, সে কথা আগেভাগেই বলে দেয়া যায়।
এখন এই ছবিটির ব্যাপারে এমন একটি তথ্য আপনাদের সামনে হাজির করব, যা চমকে দিতে পারে অনেককেই। যারা ভেবেছিলেন এ ছবির কাহিনী নিছকই লেখক-পরিচালকের মস্তিষ্কপ্রসূত এবং কাল্পনিক, তারা কিন্তু একদমই ঠিক নন। এই ছবিটি নির্মিত হয়েছিল একটি সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে। আর টম হ্যাংকস যেই চরিত্রটিতে রূপদান করেছিলেন, সেই চরিত্রটি সরাসরি অনুপ্রাণিত মেহরান করিমী নাসেরি নামক এক ভাগ্যাহত ইরানি ব্যক্তির দ্বারা। আজ আপনাদেরকে শোনাব এই জনৈক নাসেরিরই জীবনবৃত্তান্ত।
নাসেরির জন্ম ১৯৪২ সালে, ইরানের মসজিদ সুলেমানে। ১৯৭৩ সালে তিনি যুগোস্লাভ স্টাডিজ বিষয়ে পড়াশোনার জন্য ইউনিভার্সিটি অফ ব্র্যাডফোর্ডে ভর্তি হন, এবং তিন বছর যুক্তরাজ্যে বাস করেন। পড়াশোনা শেষে তিনি আবার নিজ দেশ ইরানে ফিরে আসেন। সেই সময়টিতে ইরানে শাহদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছিল, এবং নাসেরিও সেই আন্দোলনে যোগদান করেন।
এর ফলে তাকে ইরান সরকার নির্বাসন দন্ড দিলে তিনি বেশ কিছু দেশে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেন। অধিকাংশ দেশের সরকারের কাছ থেকেই তিনি প্রত্যাখ্যাত হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বেলজিয়ামস্থ 'ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস' কর্তৃক শরনার্থীর মর্যাদা লাভ করেন। এর ফলে নাসেরি বেশ কিছু ইউরোপীয় রাষ্ট্রে বসবাসের যোগ্যতা অর্জন করেন। তাই তিনি যুক্তরাজ্যে বসবাসের মনস্থির করেন এবং ১৯৮৮ সালে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন।
কিন্তু পথিমধ্যে তিনি তার কাগজপত্র হারিয়ে ফেলেন, আর তার ব্রিফকেসও চুরি যায়। যদিও তিনি দাবি করেছিলেন তার মা স্কটল্যান্ডে একজন সেবিকার কাজ করতেন, কিন্তু সে দাবির স্বপক্ষে জোরালো কোন তথ্য-প্রমাণ দিতে তিনি ব্যর্থ হন। খুব স্বাভাবিকভাবেই, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সাথে না থাকায় ব্রিটিশ ইমিগ্রেশন অফিসাররা তাকে সেদেশে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। তাই তাকে অবিলম্বে ফ্রান্সে চলে যেতে হয়। কিন্তু ফ্রান্সে গিয়েও যখন কোন কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হন, তখন পুলিশের হাতে তিনি গ্রেপ্তার হন।
যদিও তিনি বৈধভাবেই সেদেশে প্রবেশ করেছিলেন এবং তারপর কোন বৈধ কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হন, আর তার নিজ দেশে ফিরে যাবারও কোন রাস্তা খোলা ছিল না, তাই তার থাকার মতো স্রেফ একটি জায়গাই অবশিষ্ট ছিল। সেটি হলো টার্মিনাল ১ এর ডিপার্চার লাউঞ্জ! ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ফরাসী আদালত এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে খুবই একরোখা অবস্থান বজায় রাখেন - নাসেরিকে এয়ারপোর্ট থেকে বিতাড়িত করা যাবে না, কেননা তিনি সেখানে বৈধভাবেই প্রবেশ করেছিলেন। আবার তাকে ফ্রান্সের অভ্যন্তরেও প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না, কেননা সেজন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তার সাথে ছিল না।
এরই মাঝে, ফরাসী মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী ক্রিস্টিয়ান ব্যুরগেট নাসেরির ব্রিফকেসটি খুঁজে পান, এবং সেটি নাসেরির কাছে হস্তান্তর করেন। কিন্তু তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো সেটির ভিতর ছিল না। নাসেরি কয়েকবার চেষ্টাও চালিয়েছিলেন বেলজিয়ামে গিয়ে কাগজপত্র নবায়নের। কিন্তু সেটি করা যেত কেবলমাত্র তখনই, যদি কিনা নাসেরি স্বশরীরে সেখানে উপস্থিত থাকতেন।
কিন্তু সেটি তো আর নাসেরির পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া বেলজিয়ামের শরনার্থী আইন বলে- কোন শরনার্থী যদি একবার স্বেচ্ছায় সে দেশ ত্যাগ করে, তবে পুনরায় সে আর ফিরে আসতে পারবে না। কিন্তু কেবলমাত্র নাসেরির জন্য বেলজিয়ান অফিসিয়ালরা ১৯৯৫ সালে সে আইনে রদবদল করেন, যাতে তারা নাসেরিকে তাদের দেশে ফিরে আসার অনুমতি দিতে পারেন।
তবে পাশাপাশি তারা একটি শর্তও জুড়ে দেন- নাসেরি কেবলমাত্র তবেই বেলজিয়ামে ফিরে আসতে পারবেন যদি তিনি একজন সমাজকর্মীর তত্ত্বাবধানে স্থায়ীভাবে সেখানে বাস করতে শুরু করেন। নাসেরির এই প্রস্তাব মনঃপূত হয়নি। কারণ তখনও তিনি ছিলেন নিজের জীবনের ব্যাপারে প্রচন্ড রকমের উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তিনি তখনও স্বপ্ন দেখতেন, একদিন সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে, আর তিনি স্বাধীনভাবে যুক্তরাজ্যে নিজের নতুন জীবন শুরু করতে পারবেন। এবং সেজন্য তিনি ফ্রান্সের এয়ারপোর্টে থেকে যাওয়াকেই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন।
এয়ারপোর্ট থাকাকালীন সময়গুলি কিন্তু নাসেরি নষ্ট করছিলেন না। তিনি প্রতিদিন টার্মিনালের দরজার পাশে তার লাগেজ সাথে নিয়ে বসে থাকতেন, এবং সময় কাটাতেন বই কিংবা সংবাদপত্র পড়ে, অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যায়ন করে, ডায়েরী লিখে, এয়ারপোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলে। এই বন্ধুরাই তাকে খাদ্য সরবরাহ করতেন। সব মিলিয়ে নাসেরি বেশ একটি 'স্বাভাবিক' জীবনই যাপন করছিলেন।
নাসেরির এই অসাধারণ জীবনকাহিনী জানতে পেরে ড্রিমওয়ার্কস নামক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান তার কাছে যায়, এবং তার জীবনকাহিনী অবলম্বনে ছবি নির্মাণের অনুমতি নেয়। তাদের কাছে নিজ জীবনকাহিনীর স্বত্ত্ব নাসেরি বিক্রি করেন আড়াই লক্ষ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে। পরবর্তীতে এই কাহিনী অবলম্বনেই স্পিলবার্গ পরিচালনা করেন দ্য টার্মিনাল ছবিটি, এবং ২০০৪ সালে তা বিশ্বব্যাপী মুক্তি পায়।
২০০৬ সালের দিকে নাসেরি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন, এবং তখন তাকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সেটিই ছিল দীর্ঘ ১৮ বছরের মধ্যে নাসেরির প্রথমবারের মতো এয়ারপোর্টের বাইরের জীবনে পা রাখা। এরপর ২০০৭ সালে তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে ফরাসী রেডক্রস তার দেখভালের দায়িত্ব নেয়। কয়েক মাস পর তাকে প্যারিসের একটি দাতব্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। ২০০৮ সাল থেকে নাসেরি প্যারিসেই একটি আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করে আসছেন।
তথ্যসূত্র- দ্য ভিন্টেজনিউজ