প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে সব রাঘববোয়ালদের সাথে আছে তার ছবি। কখনও সেনা কর্মকর্তা, কখনও সচিব, আবার কখনও আওয়ামী লিগের নেতা হিসেবে পরিচয় দিতো সে। প্রতারণার জাল বিছিয়ে কয়েক বছরের মধ্যে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে সাহেদ। কে এই সাহেদ? কীভাবে করলো সে এত কিছু?
রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাবের অভিযানের পর দেশের আলোচিত চরিত্রের নাম এখন মোহাম্মদ সাহেদ। রিজেন্ট গ্রুপ এবং রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান হিসেবে যিনি মন্ত্রী-এমপিদের নাম ভাঙিয়ে, মানুষকে ঠকিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে প্রতিটা মন্ত্রী-এমপির সঙ্গে তার ছবি আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই বাটপারটাই টেলিভিশন টকশোতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে গলাবাজী করতো, স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা কিংবা ক্যাসিনো কাণ্ড নিয়ে প্রচুর নীতিকথা শোনানো মোহাম্মদ সাহেদের কীর্তিগুলো এখন বেরিয়ে আসছে একে একে, অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, কিভাবে দুই নম্বুরী করে, তেলবাজি আর ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে পুকুরচুরি করে সম্পদের পাহাড় গড়েছে অসাধু এই লোক।
পত্রপত্রিকায় এখন তার বহুমুখী প্রতারণার খবর জানা যাচ্ছে। প্রতারণার জন্য সে একাধিক নাম ব্যবহার করতো, কখনো মেজর ইফতেকার আহম্মেদ চৌধুরী, কর্ণেল ইফতেকার আহম্মেদ চৌধুরী, কখনো মেজর শাহেদ করিম হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতো। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রে তার আসল নাম শাহেদ করিম লেখা। সে একাধিক ন্যাশনাল আইডি কার্ড ব্যবহার করতো বলেও জানা যাচ্ছে এখন।
সাতক্ষীরা জেলার এক নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও প্রতারণা বাটপারি করে আজ শত শত কোটি টাকার মালিক। বিএনপি সরকারের আমলে রাজাকার মীর কাসেম আলী ও গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সাথে সর্ম্পক গড়ে তাদের মাধ্যমে তারেক জিয়ার হাওয়া ভবনের কর্তাব্যক্তিদের একজন হয়ে উঠেছিল সে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জেল খেটেছিল প্রতারণার দায়ে, ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে সে জেল থেকে বের হয়ে উঠে পড়েছে আওয়ামী লিগের নৌকায়।
জেল থেকে বের হয়ে সাহেদ ২০১১ সালে ধানমন্ডির ১৫ নং রোডে এমএলএম কোম্পানী বিডিএস ক্লিক ওয়ান নামে বাটপারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করে ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। সেই সময় নিজেকে সে মেজর ইফতেখার করিম চৌধুরী হিসেবে পরিচয় দিতো সবার কাছে। প্রতারক সাহেদ বুঝে গিয়েছিল, আমাদের সমাজে সেনা কর্মকর্তাদের গ্রহণযোগ্যতা মারাত্মক পর্যায়ের, আর তাই সেই ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করেই কার্যসিদ্ধি করতো সে। তার বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় ২টি মামলা, বরিশালে একটি মামলা, বিডিএস কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরির নামে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রতারণার কারনে উত্তরা থানায় ৮টি মামলাসহ রাজধানীতে ৩২টি মামলা রয়েছে।
প্রায় একই সময়ে সে মার্কেন্টাইল কো- অপারেটিভ ব্যাংকের বিমানবন্দর শাখা থেকে তিন কোটি টাকা লোন নেয়, সেখানে সে নিজেকে কর্ণেল (অব.) পরিচয় দিয়ে কাগজপত্র জমা দিয়েছিল। এটা নিয়ে আদালতে ২টি মামলা চলমান আছে। নিজেকে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও কর্তা ব্যক্তিদের কাছের লোক পরিচয় দিয়ে থাকে সে। প্রকাশ্যে অনেক মন্ত্রীর নাম ব্যবহার করেই মানুষকে হুমকি দিয়ে থাকে। আবার কারো কারো কাছে সাহেদ নিজেকে আওয়ামী লিগের প্রেসিডিয়াম কমিটির মেম্বার হিসেবেও পরিচয় দিয়েছে, সাতক্ষীরা থেকে ২০১৯ নির্বাচনে মনোনয়ন নেবে বলেও দাবী করেছিল।অনেকের কাছে।
তার গাড়ীতে ভিভিআইপি ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড, অবৈধ ওয়ারল্যাস সেট লাগানো থাকতো, আর সঙ্গে থাকতো অস্ত্রসহ তিনজন বডিগার্ড। একারনে সাধারণত পুলিশ তার গাড়ী থামাবার সাহস পেতো না। নিজেকে কখনো মেজর, কর্ণেল, সচিব, এমনকি ৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রীর এডিসি হিসেবেও পরিচয় দিতো সে। দিনে প্রতারণা করে রাতের বেলায় হাজির হতো টেলিভিশন টকশোতে, তখন তার মুখে ফুটতো কেবলই নীতিকথা। আওয়ামী লিগ সরকারের সমালোচনাকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করতো সাহেদ, তার কথা শুনে মনে হতো, শেখ হাসিনার চেয়েও বড় আওয়ামী লিগার বুঝি সে!
রিজেন্ট হাসপাতালের পাশাপাশি প্রতারণার টাকায় এই লোক উত্তরা পশ্চিম থানার পাশে গড়ে তুলেছে রিজেন্ট কলেজ ও ইউনির্ভাসিটি, আরকেসিএস মাইক্রোক্রেডিট ও কর্মসংস্থান সোসাইটি যদিও এর একটিরও কোন বৈধ লাইসেন্স নেই। আর অনুমোদনহীন আরকেসিএস মাইক্রোক্রেডিট ও কর্মসংস্থান সোসাইটির ১২টি শাখা করে হাজার হাজার সদস্যদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।
এর আগে সে ভুয়া শিপিংয়ের ব্যবসা করেছে, সেই ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামেই সাধারন মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে মেরে দিয়েছে। ভিজিটিং কার্ডে সে নিজেকে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় দেয়। লাইসেন্স করা পিস্তল আছে তার। অভিযোগ আছে, সাহেদের অফিসে নাকি লাঠিসোটা রাখা হয়। এমনিক তার অফিসের ভেতরে একটি টর্চার সেল আছে বলেও খবর প্রকাশ করেছে কেউ কেউ।
সবকিছু ম্যানেজ করে এতসব বেআইনী কার্যক্রম চালানো, রিজেন্টের মতো হাসপাতাল পরিচালনা, এত এত মানুষকে ঠকানো, নানা পরিচয় মেন্টেইন করে বিভ্রান্ত করা- এসব তো মুখের কথা নয়। মোহাম্মদ সাহেদ নামের ধুরন্ধর ব্যক্তিটি এই কাজই করে আসছেন বছরের পর বছর ধরে। কাজেই তিনি যে ভীষণ কর্মপটু, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এখানেই কিন্ত তার প্রতিভার শেষ নয়, হাসপাতালে র্যাব অভিযান চালাতে পারে, এমন আশংকায় অভিযানের দুইদিন আগেই তিনি থানায় গিয়ে জিডি করেছেন, বলেছেন, তার সুনাম নষ্ট করার জন্য নাকি কে বা কারা তার নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করছেন!
প্রথম আলোর খবরে পড়লাম, মোহাম্মদ সাহেদ নিজেকে নির্দোষ দাবী করে তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সেটা অবশ্য যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজম বা সাঈদীও করেছে, সব অপরাধীই করে। সাহেদ সাহেব বলেছেন, তিনি ভুয়া পরীক্ষার ব্যাপারে কিছুই জানেন না। তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। এ নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। তার বাটপারির লেভেলটা কোথায়, ভাবুন একবার!
এ তো গেল সাহেদনামা। এত কীর্তির পরেও এখনও ধরা পড়েনি সে। তবে যেভাবে আলোচনায় এসেছে এই লোক, তাতে পালিয়ে বাঁচাটা তার জন্য কষ্টকর হবে। ধরা হয়তো সে পড়বে। কয়েক মাস জেল খেটে সবকিছু ম্যানেজ করে অসুস্থতার অজুহাতে চলে যাবে পিজি হাসপাতালে, সেখানে ভিআইপি বেডে শুয়ে দেশী মুরগীর রান চিবিয়ে খাবে। আমরা সব ভুলে যাব, যেভাবে সবকিছু ভুলে যাই।
এদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৃতীয় শ্রেনীর কর্মী আবজাল পনেরোশো কোটি টাকার মালিক হয়ে যায়, পাপিয়া-সম্রাট-জি কে শামীমরা ক্যাসিনো ব্যবসা করে হাজার হাজার কোটি টাকা কামায়, এরা ধরা পড়লে আমরা অবাক হই। অথচ প্রশ্ন তুলি না, কার ছত্রছায়ায়, কাদেরকে ম্যানেজ করে এরা বছরের পর বছর এই সম্পদের পাহাড় বানিয়েছিল, কিভাবে এরা টিকে ছিল এতদিন। এদেশে জজ মিয়া বা জাহালমরা বিনা দোষে জেল খাটে, লিমনরা র্যাবের গুলিতে পা হারায়- অথচ মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়ায় সাহেদের মতো অপরাধীরা...
তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- চ্যানেল ২৪, প্রথম আলো, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন