কুমিল্লা শহরে 'মাতৃভাণ্ডার' লেখা যতগুলো সাইনবোর্ড দেখবেন, এত মানুষও গোটা কুমিল্লায় নেই! এগুলোর কোনোটাই কিন্ত আসল নয়। হাজারো নকল দোকানের ভীড়ে তাহলে 'আসল' মাতৃভাণ্ডারের সন্ধান পাওয়া যাবে কীভাবে?
ঢাকা থেকে কুমিল্লা শহরে যাওয়ার পথে 'মাতৃভাণ্ডার' নামের যতগুলো রসমালাইয়ের দোকান চোখে পড়বে, এত মানুষও কুমিল্লায় আছে কিনা সন্দেহ! একদম কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে শুরু করে শহরের আনাচে কানাচে, সব জায়গায় দেখা মিলবে এই নামের, এমনকি মাতৃভাণ্ডার নামের হাইওয়ে রেস্টুরেন্টও আছে ভুরি ভুরি।
তবে সব মাতৃভাণ্ডারের আগেই দেখবেন, একদম ছোট করে 'আদি', 'নিউ', 'আসল', 'অতুল', 'রিয়াল' ইত্যাদি লেখা। ঘটনা হচ্ছে, মাতৃভাণ্ডারের ব্র্যান্ডভ্যালুকে কাজে লাগিয়ে যত্রতত্র এই নামে দোকান খুলে বসে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে এদের সবাই। এতসব নকল মাতৃভাণ্ডারের ভীড়ে আদি ও অকৃত্রিম মাতৃভাণ্ডার খুঁজে বের করাটা আসলেই একটু কঠিণ কাজ।
আসল মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই চেখে দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরে। কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে, ওপরে মাঝারি সাইজের একটা ব্যানারে লেখা আছে- 'মাতৃভাণ্ডার'। কালিবাড়ির ঠিক উল্টোপাশে টিনশেড দেয়া দোকানটা দেখে শুরুতে হয়তো ধন্ধ লাগতে পারে মনে, ভুল জায়গায় চলে এলাম নাকি! কিন্ত দোকানের সামনে দুই মিনিট দাঁড়ালেই বুঝে যাবেন, জায়গা ঠিকই আছে। সারাদিন ক্রেতাদের ভীড় লেগে থাকে এখানে, দেরী করে এসে অনেকে খালিহাতেও ফিরে যান, এমনই চাহিদা এই দোকানের রসমালাইয়ের!
মাতৃভাণ্ডার থেকে প্রতিদিন প্রায় চার-পাঁচ হাজার কেজি রসমালাই বিক্রি হয়। প্রতি কেজি রসমালাইয়ের দাম ২৬০ টাকা করে রাখা হয়। একজন ক্রেতা একইসঙ্গে পাঁচ কেজির বেশি রসমালাই কিনতে পারেন না। কেউ যাতে এই মাতৃভান্ডারের মিষ্টি নিয়ে অন্য কোথাও বিক্রি বা সরবরাহ করতে না পারেন, তাই এই ব্যবস্থা। দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন শত শত লোকজন আসেন, মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই কিনবেন বলে। কুমিল্লা এলে তো লোকজনের 'মাস্ট টু ডু' লিস্টে মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই আলাদাভাবেই লেখা থাকে।
মাতৃভাণ্ডারের রসমালাইয়ের স্বাদের রহস্যটা এখনও অজানা। শোনা যায়, এক মণ দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন ক্ষীর তৈরি করে তাতে ছোট ছোট দানার শুকনো মিষ্টি দিয়ে ১৪ কেজি রসমালাই তৈরি করা হয়। দুধের পরিমাণ কমবেশি হলে আসল স্বাদটা আর থাকে না। কিন্ত এই রেসিপি তো বাকীরাও অনুসরণ করতে পারেন, তাদের রসমালাইয়ের স্বাদ কেন তাহলে মাতৃভাণ্ডারের ধারেকাছেও থাকে না? এই।প্রশ্নের উত্তরটা মাতৃভাণ্ডারের কেউ দিতে চাইবেন না, এটাই তো স্বাভাবিক!
আজ থেকে প্রায় নব্বই বছর আগে যাত্রা শুরু হয়েছিল মাতৃভাণ্ডারের। প্রয়াত ফণীন্দ্র সেন এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। প্রথম দিকে এই দোকানে চা-নাশতা সবই বিক্রি হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে চাহিদা বেড়ে গেলে শুধু মিষ্টির দোকান হিসেবেই এটি প্রতিষ্ঠা পায়। বিশেষ করে রসমালাইয়ের জন্য মাতৃভান্ডারের নাম ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের অঞ্চল এমনকি সারা দেশে। এখন ফনীন্দ্র সেনের ছেলে শংকর সেনগুপ্তই মাতৃভাণ্ডার চালাচ্ছেন।
শহরজুড়ে একই নামে হাজার হাজার দোকান, তাতে অবশ্য মাতৃভাণ্ডারের কর্তাব্যক্তিদের কোন মাথাব্যথা নেই। তাদের কথা হচ্ছে, যার যেভাবে খুশি ব্যবসা করছে, করুক। আমরা নিজেরাই ব্যবসা করে কুলিয়ে উঠতে পারছি না, এত বিক্রির পরেও প্রতিদিন শত শত মানুষকে খালিহাতে ফিরতে হচ্ছে!
বগুড়ার দই, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, চট্টগ্রামের মেজবান, খুলনার চুইঝাল, চাঁদপুরের ইলিশ, সিলেটের সাতকড়া, মুক্তাগাছার মণ্ডা, টাঙ্গাইলের চমচম, চাঁপাই নবাবগঞ্জের আম কিংবা কুমিল্লার রসমালাই- বাঙালির ভোজন ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে আছে নামগুলো। তবে সব রসমালাই নয়, কুমিল্লাকে প্রসিদ্ধি এনে দিয়েছে মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই। আর তাই মাতৃভাণ্ডারের নাম ব্যবহার করে কেউ যেন ভোক্তাদের সাথে প্রতারণা করতে না পারেন, মানুষকে ঠকাতে না পারেন, সেদিকে সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজর রাখাটা খুব দরকার।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন