মক্কা-মদীনা, এমনকি মসজিদ উল আকসার মতো জায়গায় জামাতে নামাজ পড়া বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্ত আমরা তো ধর্ম পালনে বাকীদের চেয়ে আলাদা, কুয়েত মসজিদে না এসে বাড়িতে নামাজ পড়তে বলেছে তো কি হয়েছে, ওরা কি আমাদের চেয়ে বড় মুসলমান?

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, গাধা পানি খায়, কিন্ত ঘোলা করে খায়। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কাজ দেখে সেই প্রবাদটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। দেশে করোনাভাইরাস মোটামুটি আতঙ্কে রূপ নেয়ার পর আজ তারা মসজিদ-মন্দির-প্যাগোডা-গীর্জা সব জায়গায় প্রার্থনা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে, ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ঘরে নামাজ পড়তে বলেছে। প্রজ্ঞাপন জারী করেই বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত শুধু মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন এবং খতিবরাই শুধু মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারবেন। যে কাজটা আরও তিন সপ্তাহ আগে করার কথা ছিল, সেটা আজ করতে সক্ষম হলো ধর্ম মন্ত্রণালয়। কিন্ত প্রশ্ন একটাই- চোর পালানোর পরে আস্তাবলে তালা দিয়ে আসলে কতটা লাভ হবে?

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়েছে মার্চের আট তারিখে। আজ এপ্রিলের ছয় তারিখ, মাঝখানে তিনটি শুক্রবার গেছে, মানুষজন গণহারে জড়ো হয়ে তিনবার জুমার নামাজ আদায় করেছে মসজিদে। করোনাভাইরাস ঠেকানোর জন্যে সবচেয়ে জরুরী যেটা, সেটা হচ্ছে সোশ্যাল গ্যাদারিং কমিয়ে দেয়া, মানুষজনকে এক জায়গায় জড়ো হতে না দেয়া। কারণ ভাইরাস এক মানবদেহ থেকে আরেক মানবদেহে খুব দ্রুত ছড়াতে পারে।

বিশ্বের সব দেশ সেজন্যে লকডাউনের পথে হেঁটেছে, মক্কা-মদীনা, এমনকি মসজিদ উল আকসার মতো জায়গায় জামাতে নামাজ পড়া বন্ধ হয়ে গেছে, কুয়েতের মসজিদ থেকে আজানের সময় ‘হাইয়া আলাস সালাহ’ এর পরিবর্তে বলা হয়েছে ‘আস সালাতু ফি বাইয়্যুতিকুম’, অর্থাৎ আপনারা নামাজ ঘরে বসেই আদায় করে নিন। অনান্য দেশেও গীর্জা-প্যাগোডা-মন্দির বন্ধ হয়েছে। কারণ কোরিয়া বা ভিয়েতনামের মতো জায়গায় গীর্জার জমায়েতে একজনের শরীর থেকে ভাইরাস ছড়িয়েছে শত শত মানুষের শরীরে, ইরানে মসজিদ আর মাজার থেকে করোনাভাইরাস ভয়াবহ আকার নিয়েছে, ভারতেও তাবলিগ জামাতের মারকাজে করোনা পজিটিভ একজনের মাধ্যমে শত শত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

কিন্ত আমরা তো ধর্ম পালনে বাকীদের চেয়ে আলাদা, কুয়েত মসজিদে না এসে বাড়িতে নামাজ পড়তে বলেছে তো কি হয়েছে, ওরা কি আমাদের চেয়ে বড় মুসলমান? আমরা নামাজ মসজিদে গিয়েই পড়ব, যে যাই বলুক, মসজিদে নামাজ পড়লে আল্লাহর রহমত পাওয়া যাবে, মসজিদে করোনা ঢুকতে পারে না- এরকম হচ্ছে আমাদের দেশের লাখ লাখ মানুষের মানসিকতা। সরকারও এদের বিরুদ্ধে গিয়ে কঠোর কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে এসে ইমামরা জোর গলায় বলেছেন, পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেলেও মসজিদে জামাত বন্ধ হবে না। 

মাইকিং করে জানানো হচ্ছে সরকারী সিদ্ধান্তের কথা

এই যে একরোখা আচরণ, এটা তো কোন সেন্সিবল মানুষের কাজ না। সরকারও যে এদের কাছে একরকম বশ্যতা স্বীকার করে হার্ডলাইনে যেতে পারলো না বা গেল না, সেটা সরকারের ব্যর্থতা। জামাতে নামাজ পড়ার চেয়ে মানুষের জীবন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে সিদ্ধান্তটা আরও তিন সপ্তাহ আগে নেয়ার কথা ছিল, সেটা তো বাধ্য হয়ে আজ নিতেই হলো। মাঝের এই সময়টায় কতগুলো মানুষের মধ্যে জামাতে নামাজ পড়ার কারণে ভাইরাসটা ছড়িয়েছে, সেই পরিসংখ্যান কে বের করবে? হার্ডলাইনে না যাওয়ায় ক্ষতিটা কার হলো? সরকার যে একটা আপোষের রাস্তায় হাঁটল, তাতে কি ভোট ব্যাংক বাড়বে, নাকি লাশের সংখ্যা কমবে? 

মিরপুরের টোলারবাগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল ভদ্রলোক তো মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েই করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে তার পরিবারের দাবী। কারণ বাসা আর মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও তিনি যেতেন না। কেরাণীগঞ্জে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত একজন জুমার নামাজে গিয়েছেন বলে পুরো এলাকা লকডাউন করা হয়েছে। এই ক্ষতিগুলোর হিসেব করবে কে? এখনও কি ‘মসজিদে করোনা ঢুকতে পারে না’ টাইপের বদ্ধমূল ধারণায় বিশ্বাস করবে লোকজন?

জাতিগতভাবেই আমাদের ঘাড়ের রগ একটা একটু বাঁকা থাকে। আমরা সহজে কিছু শুনতে চাই না, কিছু মানতে চাই না, নিজেদের বুঝটাকেই আমরা সবার ওপরে রাখি। আমরা প্রচণ্ড উদাসীনও, নইলে হার্ডলাইনে যাওয়ার কথা ছিল অনেক আগেই, রোগীর সংখ্যা তিনের গুণিতক মেনে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে সরকার পাত্তা দেয়নি। এখন যখন সোশ্যাল ট্রান্সমিশন শুরু হয়ে গেছে, দ্বিগুণ-তিনগুণ করে প্রতিদিন বাড়ছে রোগীর সংখ্যা, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর চেহারাটা পাণ্ডুর হয়ে গেছে, তখন ধর্ম মন্ত্রণালয় তড়িঘড়ি করে জামাতে নামাজ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ এই সিদ্ধান্তটাই তিন সপ্তাহ আগে নিলে, সেইসঙ্গে লকডাউনটা ঠিকঠাক মতোন করা গেলে করোনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটা নগণ্য পর্যায়েই থাকতো। এই দেরীর মাশুল বাংলাদেশকে কতগুলো লাশের মাধ্যমে দিতে হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা