শরীরে তো কম কাঁটাছেড়া হয়নি। একের পর এক সার্জারি সামলে ফিরে এসেছেন আরও উদ্যম নিয়ে। আর এই করোনা মাশরাফিকে হারিয়ে দেবে? এও কি সম্ভব?

মাশরাফি, আপনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন- খবরটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো আঘাত করেনি আমাকে। এরকম কিছু যে ঘটতে পারে, সেটা তো জানা ছিলই। বরং আরও আগেই যে ভাইরাসটা আপনার শরীরে প্রবেশ করেনি, সেটাই অবাক করার মতো। করোনাকালে যেভাবে আপনি নিজের এলাকায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, এখনও দিয়ে যাচ্ছেন, তাতে ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়াটা তো খুবই সহজ ব্যপার ছিল! 

করোনাভাইরাস ছড়ানোর পর থেকে 'ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র' শব্দটা খুব বেশি শোনা যাচ্ছে। করোনা মোকাবেলায় যারা একদম সরাসরি কাজ করছেন, তারাই এই ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র। এই তালিকায় ডাক্তার-নার্সরা আছেন, আছেন পুলিশ সদস্যরাও। দিনরাত এক করে কেউ রোগীদের সেবা দিচ্ছেন, কেউবা লকডাউনে মানুষকে ঘরে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টায় নেমেছেন। 

এই তালিকায় আপনার নামটা কেউ বলে না মাশরাফি। অথচ আপনিও তো করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরের যোদ্ধা হয়েই লড়ে গেছেন পুরোটা সময় জুড়ে। জাতীয় সংসদের আর কয়জন এমপি আপনার মতো ছুটে বেড়িয়েছে এলাকাজুড়ে, একের পর এক দরকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নিজের এলাকার ডাক্তার-পুলিশ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ- সবার নিরাপত্তারর জন্য আপনার মতো কাজ করেছে, এরকম একজনের নাম বলতে পারবে কেউ? 

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

এই ক্রান্তিকালে দেশের সাড়ে তিনশো সাংসদের মধ্যে সবচেয়ে কর্মঠ আর উদ্যমী রূপে আবির্ভূত হতে দেখা গেছে আপনাকেই! এলাকার দুঃস্থ মানুষের জন্যে নিজের ফাউন্ডেশন থেকে খাবার আর ত্রাণের ব্যবস্থা করেছেন আপনি, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন নিজ উদ্যোগে। কখনও আবার ফোন পেয়ে নিজেই খাবার নিয়ে ছুটে গেছেন। নড়াইল সদর হাসপাতালের প্রবেশদ্বারেই স্থাপন করেছেন জীবাণুনাশক গেট। একইরকম গেট স্থাপন করা হয়েছে পুলিশদের জন্যেও। করোনার স্যাম্পল সংগ্রহের জন্য স্পেশাল বুথ স্থাপন করা হয়েছে নড়াইলে, ঢাকার বাইরে স্যাম্পল সংগ্রহের এমন সিকিউরড সিস্টেম দেশের আর কোথাও দেখা যায়নি। 

চিকিৎসকদের সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে আপনি নড়াইলের হাসপাতালে স্থাপন করেছেন ‘ডক্টরস সেফটি চেম্বার’। পিপিই, হ্যান্ড স্যানিজার যখন যা প্রয়োজন হচ্ছে তাও বিলি করছেন আপনি। ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময় পাঁচ মিনিট ধরে তেল দেয়ার নাটক না করে সরাসরি পয়েন্টে চলে গেছেন, নিজের এলাকায় কি নেই, কি লাগবে সেসব জানিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং আপনার প্রশংসা করে বলেছেন, 'আমাদের মাশরাফি তো ভালো কাজ করছে!' কই, সাড়ে তিনশো সাংসদের মধ্যে আর কারো প্রশংসায় এভাবে পঞ্চমুখ হতে তো আমরা দেখলাম না প্রধানমন্ত্রীকে। 

লকডাউনের মাঝে সময়মতো বোরো ধান কাটা যাবে কিনা, এই ভেবে কৃষকরা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিলেন, কারণ দিনমজুর পাওয়া যাচ্ছিল না। জায়গায় জায়গায় আওয়ামী লিগের অতি-উৎসাহী নেতা-কর্মীরা ধান কাটার নাম করে শো-অফ কর‍তে নেমে যখন ফসলের বারোটা বাজাচ্ছিল, তখন আপনি কৃষি মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে নড়াইলে এনেছেন হারভেস্টর মেশিন, যেটা দিয়ে অল্প সময়ে বিশাল এলাকার ফসল কেটে ফেলা যায়। আপনি একটা ডাক দিলে হাজার হাজার মানুষ ধান কাটতে ছুটে যেতো, অথচ হুজুগে না মেতে আপনি কাজের কাজটা করেছেন বরাবর। 

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মাশরাফি

শুধু তো রাজনৈতিক অবস্থান থেকে নয়, ব্যক্তিগতভাবেও আপনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন করোনার বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে। আপনার এলাকায় কেউ খাবারের সমস্যায় আছে, খোঁজ পেয়ে আপনি নিজেই মোটরসাইকেলে করে ছুট লাগিয়েছেন, পেছনে চাল-ডাল-তেলের বস্তা। নিজের প্রতিষ্ঠিত নড়াইল ফাউন্ডেশনকে কাজে লাগিয়েছেন পুরোপুরি, করোনায় দুর্গতদের সাহায্য করবেন বলে দেড়যুগের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী ব্রেসলেটটা নিলামে তুলেছেন। সেই ব্রেসলেট ৪২ লাখ টাকায় কিনে আবার আপনাকেই ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে, এদেশের মানুষ আপনাকে কি পরিমাণ ভালোবাসে, তার ছোট্ট একটা নমুনা হয়ে আছে এই ঘটনাটা। আপনি দেশের মানুষের কাছে দোয়া চেয়েছেন, আপনার দোয়া চাইতে হয় মাশরাফি? কোটি কোটি মানুষের দোয়া তো আপনার সঙ্গে নিরন্তর জুড়ে আছে! 

মনে আছে মাশরাফি, আপনি যখন রাজনীতিতে আসার ঘোষণা দিলেন, ইলেকশন করবেন বলে মনোনয়ন নিলেন- কি তীব্র সমালোচনার মধ্যে দিয়ে আপনাকে যেতে হয়েছিল! কি বিচ্ছিরি ভাষায় আপনাকে আক্রমণ করা হয়েছিল! আপনি বারবার আশ্বস্ত করেছেন সবাইকে, বলেছেন, আপনি মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছা থেকেই রাজনীতিতে এসেছেন, রাজনীতির নোংরা কাদায় ডুবে যাওয়ার জন্য নয়। অথচ একটা পক্ষ সেটা কানেই তোলেনি, তারা নোংরামিতে মেতেছে। 

বিশ্বকাপে আপনি ব্যর্থ হলেন বল হাতে, দল খারাপ করলো- আপনি হয়ে গেলেন গণশত্রু। সবাই তখন জ্যোতিষী হয়ে গেল, তারা তো আগেই বলেছিল, রাজনীতিতে এলে মাশরাফি ক্রিকেটে মন দিতে পারবেন না! আপনি সব ব্যথা, সব আক্রমণ সয়ে নিলেন, টু শব্দটিও করলেন না। এক ডাক্তারকে শোকজ করা নিয়েও কত কাহিনী হলো, আপনার দিকে তেড়ে গেল একদল, অথচ পরে যখন জানা গেল সেই ডাক্তারের বদলি ঠেকিয়েছেন আপনিই, তখন কেউ এসে একবার স্যরি বললো না। 

করোনাকালে সবচেয়ে কর্মঠ সাংসদ হিসেবে মাঠে ছিলেন মাশরাফিই

এদেশের মানুষ অকৃতজ্ঞ, এরা আপনাকে ডিজার্ভ করে না মাশরাফি। হাজার হাজার কোটি কালো টাকার মালিকেরা এমপি হলে কারো সমস্যা হয় না, মানব পাচারকারীদের এদেশের মানুষ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে, আর আপনার মতো পরিচ্ছন্ন ইমেজের কেউ রাজনীতিতে এলে 'জাত গেল জাত গেল' বলে রব তোলে! আপনি যতোই কাজ করুন, কলিজাটা খুলে প্লেটে করে এনে দিন, এরা মুখে দিয়ে বলবে লবন কম হয়েছে। এদেশের জন্য দুর্নীতিবাজ, ভূমিদস্যু আর অকর্মণ্য লোকজনই জনপ্রতিনিধি হিসেবে ঠিক আছে, আপনি এই ভীড়ে আসলেও বেমানান। 

মাশরাফি, আপনাকে নিয়ে আমার একটুও দুশ্চিন্তা হয় না। আপনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তো কি হয়েছে? এতগুলো ইনজুরি, সার্জারি যাকে এক চুল বাঁকা করতে পারলো না, সামান্য করোনা তার আর কি করবে! আমি জানি আপনি দারুণভাবে কামব্যাক করবেন, ক্যারিয়ারে প্রতিটাবার যেভাবে করেছেন, কলার উঁচিয়ে, আগুয়ান ভঙ্গিমায়। জীবনের সব দ্বৈরথে আপনি মাথা উঁচু করে লড়েছেন, এখানেও লড়বেন, জিতে ফিরবেন। মাশরাফির প্রতিশব্দ যে আমাদের চোখে বিজয়ী, সেটা তো আমরা ভুলে যাইনি...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা