আওয়ামী লীগের কিছু নেতা যখন ধান কাটার নামে সার্কাস চালু করেছেন, ক্যামেরাম্যান আর শ'খানে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ক্ষেতে নেমে ফসলের বারোটা বাজাচ্ছেন, মাশরাফি তখন নিজের এলাকার কৃষকদের জন্যে নিয়ে এসেছেন হারভেস্টর মেশিন...
সরকারী দলের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে এমপিরা যখন ক্ষেতে নেমে ধান কাটার সার্কাসে মেতেছেন, তখন মাশরাফি বিন মুর্তজা তার এলাকার কৃষকদের জন্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে হারভেস্টর মেশিন নিয়ে এসেছেন। চারটা হারভেস্টর মেশিন চেয়েছেন মাশরাফি, এর মধ্যে একটা ইতিমধ্যেই নড়াইলে পৌঁছে গেছে, বকি তিনটাও কয়েকদিনের মধ্যেই পৌঁছে যাবে। হারভেস্টার মেশিনে এক ঘণ্টায় কয়েক বিঘা ধান কাটা সম্ভব। এই মেশিন দিয়ে ধান কেটে মাড়াই করে একবারে বস্তাবন্দিও করে ফেলা যায়।
করোনায় পুরো দেশ অঘোষিত লকডাউনের মুখে পড়েছে। ক্ষেতের ধান কাটার জন্যে দিনমজুর পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। পাকা ফসল নষ্ট হচ্ছে মাঠে, এমনটা অব্যহত থাকলে আগামী মৌসুমে খাদ্যসংকট তৈরী হবার আশঙ্কা আছে। প্রধানমন্ত্রী কয়েকদিন আগে তার বক্তৃতায় আহবান জানিয়ে বলেছিলেন, ছাত্রদের যেহেতু এখন স্কুল-কলেজ বন্ধ, তারা যেন মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে কৃষকদের পাশে দাঁড়ায়, মাঠের ফসল তোলায় সাহায্য করে।
প্রধানমন্ত্রীর সেই আহবানের পরে ছাত্রলীগ উদ্যোগী হয়েছে অনেক জায়গায়, বিনা পারিশ্রমিকে দল বেঁধে কৃষকের ক্ষেতের ফসল কেটে দেয়ার খবর এসেছে পত্রিকায়। এইটুকু পর্যন্ত ঘটনাটা ঠিক ছিল। কিন্ত অতি উৎসাহী মানুষের তো অভাব নেই। প্রধানমন্ত্রীর সুনজরে আসার জন্যে এই মাঠে নেমে ধান কাটাটাকেই হাতিয়ার বানাতে চাইলেন সরকারী দলের অনেক নেতা। শুরু হলো সার্কাস। সেই মিছিলে যোগ দিয়েছেন কিছু সরকারী কর্মচারীও!
সরকারী দলের নেতা-কর্মীরা দলবেঁধে ক্ষেতে নেমে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে সংসদ সদস্যও আছেন! সাংসদ মহোদয় কাস্তে হাতে ধান কাটার পোজ দিচ্ছেন, আর চারপাশে ঘিরে চ্যালাচামুন্ডারা ভীড় করছে, ছবি তুলছে, ফেসবুক লাইভে আসছে, প্রফেশনাল ক্যামেরাম্যান ভাড়া করে আনা হচ্ছে, ডকুমেন্টরি বানানো হবে, করোনার দিনগুলিতে কিভাবে নেতাজী গণমানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, কীভাবে কৃষকের ধান মাঠ থেকে কেটে নিয়ে গোলায় তুলে দিয়েছেন!
অথচ এত কাণ্ডের মাঝখানে বেচারা কৃষকেরই মাথায় হাত। নেতা আর তার সঙ্গে আসা শ'খানেক সাঙ্গোপাঙ্গ মিলে ইচ্ছেমতো জমি মাড়িয়ে ফসলের বারোটা বাজিয়েছে, কোথাও তো আবার পাকা ধান না পেয়ে কাঁচা ধান কেটে ফেলার খবরও পাওয়া গেছে। কিন্ত বাধা দেয়ার কোন উপায় নেই, কিছু বললেই বিপদ! নিজের ক্ষেতের একপাশে বিরস বদনে দাঁড়িয়ে কৃষক এই নাটক দেখেছেন, আর কিছু করার ছিল না তার।
দেড় বছর আগে মাশরাফি যখন নির্বাচন করার ঘোষণা দিলেন, বাঙালি তখন দুটো দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একদল।মানতেই পারছিল না, কেন মাশরাফি রাজনীতিতে আসবেন, কেন গায়ে কাদা লাগাবেন! মাশরাফি অনেকবার আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন যে, তিনি মানুষের জন্যে কাজ করতেই রাজনীতিতে আসছেন, তার ওপরে যেন ভরসা রাখা হয়, তাকে যেন একটু সময় দেয়া হয়। কিন্ত কে শোনে কার কথা? মাশরাফিকে জাতীয় ভিলেন বানানোর চেষ্টা একপক্ষের লোক গত দেড় বছর ধরেই করছে, ভবিষ্যতেও করবে।
অথচ করোনার এই দিনগুলোতে দেশের সাড়ে তিনশো সাংসদের মধ্যে সবচেয়ে কর্মঠ আর উদ্যমী রূপে আবির্ভূত হতে দেখা গেছে মাশরাফিকেই! এলাকার দুঃস্থ মানুষের জন্যে নিজের ফাউন্ডেশন থেকে খাবার আর ত্রাণের ব্যবস্থা করেছেন, অসহায় মানুষের অয়াশে দাঁড়িয়েছেন নিজ উদ্যোগে। কখনও আবার ফোন পেয়ে নিজেই খাবার নিয়ে ছুটে গেছেন। নড়াইল সদর হাসপাতালের প্রবেশদ্বারেই স্থাপন করেছেন জীবাণুনাশক গেট। একইরকম গেট স্থাপন করা হচ্ছে পুলিশদের জন্যেও।
চিকিৎসকদের সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে ওই হাসাপাতালেই স্থাপন করেছেন ‘ডক্টরস সেফটি চেম্বার’। পিপিই, হ্যান্ড স্যানিজার যখন যা প্রয়োজন হচ্ছে তাও বিলি করছেন মাশরাফি। ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময় পাঁচ মিনিট ধরর তেল দেয়ার নাটক না করে সরাসরি পয়েন্টে চলে যাচ্ছেন, তার এলাকায় কি নেই, কি লাগবে সেসব জানিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং তার প্রশংসা করে বলেছেন, 'আমাদের মাশরাফি তো ভালো কাজ করছে!'
জ্বী, মাশরাফি ভালো কাজ করছেন, এই ভালো কাজ করার জন্যেই আপনাদের গালি খেয়ে তিনি রাজনীতিতে এসেছেন, এমপি হয়েছেন। চাইলে মাশরাফিও তার বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে ক্ষেতে নেমে যেতে পারতেন, ধান কাটতে পারতেন। ভক্তরা সেসব ছবি শেয়ার দিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতো। কিন্ত তিনি জানেন, একজন এমপির কাজ মাঠে নেমে ধান কাটা নয়, কৃষক যাতে কোন বিড়ম্বনা ছাড়াই ঘরে ফসল তুলতে পারেন, সেটার ব্যবস্থা করা। সেজন্যেই তিনি হারভেস্টর মেশিনের ব্যবস্থা করেছেন। সেই মেশিন রিসিভ করাফ সময়ও তিনি ছিলেন না, মেশিনের চালকের আসনে বসে ফুটেজ খাওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা তিনি করেননি।
মাশরাফি রাজনীতিকে বদলে দিতে রাজনীতিতে এসেছেন, ময়লা পরিস্কার করতে কাদায় নেমেছেন। বাকীদের সঙ্গে এখানেই তার পার্থক্য... তবে তাতে আমাদের কী? আমরা তো সেই একই গান গাইব- মাশরাফি রাজনীতিতে না এলেও পারতেন!