মেরিনা তাবাসসুম: জেসিন্ডা আরদার্ন-সারাহ গিলবার্টদের সাথে উচ্চারিত হয় যে বাঙালির নাম!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
কেমন লাগবে ভাবতে যখন শুনবেন ব্রিটিশ ভ্যাক্সিনোলজিস্ট সারাহ গিলবার্ট (যাকে নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে তুমুল মাতামাতি চলছে), নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরদার্ন, ব্রিটিশ ঐতিহাসিক এবং পরিবেশবিদ স্যার ডেভিড ফ্রেডরিক এ্যাটেনবার্গ, সাউথ কোরিয়ার 'প্যারাসাইট'খ্যাত অস্কারজয়ী পরিচালক বং জুন হো এর সাথে একজন বাংলাদেশির নাম উচ্চারিত হতে কোনো ফোরামে, কোনো তালিকায়?
ভালো লাগবে না? ভালো লাগতে বাধ্য। বুকের ভেতরে কোথায় যেন প্রজাপতির নাচনও হয় এরকম সংবাদে। তবু সত্যি হলো, আমরা এইরকম মানুষগুলোর খোঁজ রাখি না। তাঁরা তাদের মতো দেশকে স্বাবলম্বী করে যান, দেশের মুখ ক্রমশ উজ্বল করে যান, আমরা তাদের খবর রাখতেও ভুলে যাই। সেরকমই এক মানুষের গল্প আজ। যার নাম- মেরিনা তাবাসসুম। পেশায় স্থপতি। যিনি বাংলাদেশকে গর্বিত করে যাচ্ছেন প্রতিদিনই।
ব্রিটেনের একটি বিখ্যাত মাসিক পত্রিকার নাম 'প্রসপেক্ট'। সেই পত্রিকায় তারা সম্প্রতি একটি তালিকা করেছেন, 'করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সেরা ৫০ জন চিন্তাবিদ' শিরোনামে। সেই তালিকায় উপরোল্লিখিত জ্বলজ্বল তারকাদের সাথে রয়েছে আমাদের মেরিনা তাবাসসুমেরও নাম।
কেন 'প্রসপেক্ট' এর তালিকায় মেরিনা তাবাসসুমের নাম এলো সে নিয়ে বলার আগে একটু ইতিহাসের অলিগলিতে যাওয়ার প্রয়োজন আছে বৈকি। আপাতত ঘুরে আসা যাক অতীত থেকে।
মেরিনার পরিবার দেশভাগের সময় ভারত থেকে বাংলাদেশে আসেন। মেরিনার জন্ম ঢাকাতে। হলিক্রস গার্লস স্কুল এণ্ড কলেজে এবং তারপর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশোনা শেষ করেন তিনি ১৯৯৪ সালে। এরপরে বছরখানেক তিনি কাজ করেন রিয়েল এস্টেট এর প্রজেক্টগুলোতে। যার সবই ছিলো কমার্শিয়াল। 'স্থাপত্যশিল্প' নামক জিনিসটির ছিঁটেফোঁটাও ছিলো না এই কাজগুলোতে।
বছরখানেক পরেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এরকম ফরমায়েশি, কর্মাশিয়াল কাজ করবেন না আর। এরকম সস্তা, বাজারি কাজ করার জন্যে তিনি স্থাপত্যবিদ্যা শেখেননি। তখন তিনি নিজ উদ্যোগে শুরু করেন প্র্যাকটিস, গড়ে তোলেন এমটিএ (মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস)। বিল্ডিংকেও যে জল, বায়ু, আলো, প্রকৃতির সাথে এক মেলবন্ধনে এনে ফেলা যায়, সেটা তিনি উপলব্ধি করেন। তারই ফলশ্রুতিতে 'কোয়াইন্টেসেনশিয়াল" অর্থাৎ প্রকৃতির উপাদানগুলোকে একত্রিত করে বিভিন্ন বিল্ডিং এর ডিজাইন করা শুরু করেন তিনি।
একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন-
যেকোনো ভবনেরই প্রাণ আছে। আপনি যখন ঐ ভবনটিকে প্রকৃতি, মানুষ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি মিলে বানাবেন, দেখবেন নির্মানটি আপনার সাথে কথা বলবে। আপনি উপলব্ধি করবেন নির্মানের প্রাণশক্তি! প্রাণের প্রাচুর্য।
ঠিক এ কারণেই, এই চিন্তাভাবনার কারণেই "প্রসপেক্ট" তাদের এই তালিকায় স্থান দিয়েছে মেরিনা তাবাসসুমকে। যেখানে গড়পড়তা যেকোনো নির্মানই হয়ে যায় প্রকৃতির সাথে একরকম রেষারেষি করে, সেখানে প্রকৃতি-স্থাপনার বন্ধন তো এক আবহমান দ্বৈরথেরই অবসান! এই অসাধারণ চিন্তাভাবনাই করে এসেছেন মেরিনা তাবাসসুম। প্রথম থেকেই।
মেরিনা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ঢাকার "বাইতুর রউফ মসজিদ" এর নকশা এবং নির্মানের জন্যে। ঢাকার উত্তরে দক্ষিণখান এলাকায় নিজের দাদীর দেয়া জমিতে তিনি বাইতুর রউফ মসজিদটি নির্মাণ করেন। আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনাকে তিনি রূপান্তরিত করেন প্রকৃতি ও কৃত্রিমতার ছিমছাম এক সেতুবন্ধন ঘটিয়ে। তাঁর অসাধারণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এই স্থাপত্যকাজটি সম্মানজনক "আগা খান এ্যাওয়ার্ড" পায় ২০১৬ সালে। তাছাড়া মেরিনার নাম যুক্ত আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-স্তম্ভের সাথেও। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নির্মানকাজের সাথেও যুক্ত তাঁর নাম৷ এই জাদুঘর নির্মানের পেছনে যে দু’জন নকশাবিদ রয়েছে, তার মধ্যে তিনি একজন। অন্যজন হলেন স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী। অসাধারণ সব কাজের কারণে তিনি পেয়েছেন দেশি বিদেশি অজস্র এ্যাওয়ার্ড। অসংখ্য প্রতিযোগিতায় জিতেছেন পুরস্কারও।
শুধু স্থপতি পরিচয়েই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি। যুক্ত আছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক এ শিক্ষকতার সাথে। তাছাড়া ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস এবং নেদারল্যান্ডসের ডেল্ফট ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতেও তিনি যুক্ত শিক্ষক হিসেবে। এছাড়াও অজস্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়মিতই বিভিন্ন কোর্স করাচ্ছেন তিনি। শিক্ষকতা পেশায় কেন আসা, সে প্রশ্নের উত্তরে হাসিমুখে জবাব-
স্বার্থপর চিন্তাভাবনা থেকেই শিক্ষকতা করা। কারণ আমি জানি না অনেক কিছুই। সেগুলো জানার জন্যেই এই পেশায় আসা।
এছাড়া তিনি বেঙ্গল ইন্সটিটিউট ফর আর্কিটেকচার এর ডিরেক্টর অব একাডেমিক প্রোগ্রাম হিসেবে কাজ করছেন ২০১৫ সাল থেকে।।
তিনি ঘুরেছেন ইউরোপে আমেরিকা সহ বড় বড় জায়গায়। স্থায়ীভাবেই থাকতে পারেন এদের মধ্যে যেকোনো স্থানেই। কিন্তু তাও তিনি বেছে নিয়েছেন বাংলাদেশকে। বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছেন কারণ তিনি মনে করেন, স্থাপত্যকলায় এ দেশ পিছিয়ে আছে অনেক। কম খরচে এখানে সুন্দর সুন্দর আবাসস্থল করা সম্ভব। তিনি সে জন্যেই কাজ করে যাচ্ছেন৷ তৃনমূল পর্যায়ে কীভাবে অল্প খরচে শক্তপোক্ত ভবন বানানো সম্ভব সে নিয়েও চলছে তার গবেষণা। নিয়মিতই।
মেরিনা তাবাসসুম জানান, 'স্থপতি' সংজ্ঞাটা খুব বড়৷ টাকা কামানোর জন্যে অথবা গ্ল্যামার বাড়ানোর জন্যে এ পেশায় আসা উচিত না কারো। যদি কেউ আসতেই চায়, তবে তাকে আসতে হবে- কাজকে ভালোবেসে। তাহলেই 'স্থাপত্যশিল্প' নতুন নতুন বৈচিত্র্য দেখবে। তাছাড়া তিনি বিশ্বাস করেন, যেকোনো স্থাপত্যেরই শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে হয়। তাই এমনভাবে কোনো ভবন নির্মান করা উচিত, যাতে করে সেখানে প্রাণরসের প্রাচুর্য থাকতে পারে। ভবন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে। এরকম সুন্দর চিন্তাভাবনা, অসাধারণ সব নির্মান এবং মানুষের জন্যে ভাবা, সবার ওপরে দেশকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করানো নিজের কাজ দিয়ে... মেরিনা তাবাসসুম সবকিছুর যোগফলেই এ দেশের রত্ন।
এরকম অজস্র হীরে-জহরত ছড়িয়ে আছে এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তাদের সম্পর্কে নিয়মিত জানা এবং বাঙ্গালী হিসেবে গর্বিত হওয়ার দায় আমাদেরও রয়েছে। এভাবেই নিয়মিত ভালো কাজগুলোর মূল্যায়ন করা উচিত আমাদের। সেসাথে চর্চা করা উচিত মেধাবী মানুষদের কাজকর্ম নিয়েও। এরকমভাবে গঠনমূলক আলোচনা, যথাযোগ্য প্রশংসার ভালো একটি সংস্কৃতি শুরু করতে পারলে, সামনে যে আরো অগুনতি মেধাবী মুখ পাবো আমরা, সে বলাই বাহুল্য৷
-
* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে