নজরকাড়া চুক্তিতে একের পর এক দারুণ সব খেলোয়াড়কে তিনি দলে নিয়ে আসছেন, কয়েক মাস আগেও যার নামটা কেউ জানতো না, এখন সেই মারিনার স্ট্যাচু স্থাপন করতে চাইছে চেলসি সমর্থকেরা! কুইন অফ স্ট্যামফোর্ড প্রমাণ করে দিচ্ছেন, দুনিয়ার আরও অনেক কিছুর মতো ফুটবলের ট্রান্সফার মার্কেটেও অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে নারীরা...

করোনা মহামারীতে স্বভাবতই লোকসানের মুখ দেখেছে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবল। এতে ব্যতিক্রম নই বড় বড় সব জায়ান্ট ক্লাবগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থাও। খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের বেতন পরিশোধ করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে পরবর্তী মৌসুমকে সামনে রেখে 'স্যালারি কাট' এর দেন-দরবার করছে ক্লাব কতৃপক্ষগুলো৷ সুতরাং অনেকেই ভেবেছিলো, এবার ট্রান্সফার মার্কেটও বেশ ঠান্ডায় থাকবে। 

কিন্তু সবাইকে হতবাক করে একের পর এক বিগ সাইনিং এ মত্ত হয়ে উঠেছে ইংলিশ জায়ান্ট ক্লাব চেলসি এফসি। চেলসি মালিক রোমান আব্রাহমোভিচের তেলের খনির টাকায় এমনটা হওয়াটা স্বাভাবিক হতে পারে, তাচ্ছিল্য ও হাস্যরসটা বরাবরই রাইভাল সমর্থকদের থেকে এসেছে। কিন্তু এবার একাধিক বিশ্বমানের খেলোয়াড় নেয়ার পেছনে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছে এক রাশিয়ান-কানাডিয়ান মারিনা গ্রানোভস্কায়া নামে ধুরন্ধর বোর্ড ডিরেক্টরের তৎপরতা, মিডিয়ায় এমন খবর চাউর হওয়ার পরে চোখ কপালেই তুলেছে সমর্থক থেকে প্রতিপক্ষ সকলেই। কিন্তু পাদপ্রদীপের আলোতে উঠে আসা কে এই নারী মারিনা? 

মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করে, মারিনা যোগ দিয়েছিলেন রোমান আব্রাহমোভিচের ব্যাক্তিগত সহকারী হিসেবে, কর্মরত ছিলেন তেল কোম্পানিতেই। ২০০৩ সালে আব্রাহমোভিচ চেলসি ক্লাব ক্রয় করলে, তিনিও লন্ডন চলে আসেন। এর সাত বছর পর, ২০১০ সালে পাকাপাকিভাবে তাঁর আগমন ঘটে স্টামফোর্ড ব্রিজে। মূলত মালিকের একান্ত প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ট্রান্সফার প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোতে কাজ করাই তাঁর দায়িত্ব ছিল। 

এরপর দ্রুতই মারিনা নানান সিদ্ধান্তে পরিষ্কার ও শক্তিশালী ছাপ রাখা শুরু করেন। ২০১১ সালে লিভারপুল থেকে ফার্নান্দো টরেসকে ৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে ভেড়ানোর কাজটা সেড়ে নেয়া হয়েছিলো মারিনার পরমার্শেই৷ ২০১৩ সালে চেলসি বোর্ডে যোগ দেন। আর তাতেই পুরোনো অতীত ভুলে 'স্পেশাল ওয়ান' খ্যাত মরিনহোকে ফের ক্লাবে ফিরিয়ে আনতে তিনিই মালিক আবাহ্রাম-কে রাজি করিয়ে ফেলেন।

মাত্র এক বছরের মাথায় পদোন্নতিতে হয়ে উঠেন চেলসির প্রধান নির্বাহি। গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়েই ৩২ মিলিয়ন পাউন্ডে দিয়েগো কস্তাকে ভিড়িয়ে নেন যা সফল সাইনিং হিসেবেই অধিক পরিচিতি পেয়েছিলো৷ পাশাপাশি ইডেন হাজার্ড থেকে শুরু করে পুলিসিচ অবধি অসাধারণ সব সাইনিং-ও যেমন করিয়েছেন, অপরপাশে অস্কার, মোরাতা, ডেভিড লুইজ-দের মতো ফ্লপ খেলোয়াড়দেরও মার্কেটে বেশ চড়া দামেই ছেড়ে লাভ আদায় করে নিয়েছেন। 

চেলসি কোচ ফ্র‍্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের সঙ্গে মারিনা গ্র‍্যানোভস্কায়া

২০১৭ সালে স্পোর্টিং ডিরেক্টর পদ থেকে মাইকেল এমেনালো বিদায় নিলে, মোটামুটি ক্লাব চালানোর নাটাইটা মারিনার হাতেই চলে যায়। পরবর্তীতে ম্যানেজার কন্তে থেকে সারি কেউ তাঁর প্রভাব থেকে রেহাই পাইনি। এমনকি অনভিজ্ঞ ল্যাম্পার্ডকে চেলসির ডাগ আউটের দায়িত্ব তুলে দেয়ার সিদ্ধান্তও তাঁরই। 

মারিনা গ্রানোভস্কায়া পর্দার অন্তরালেই থাকতে পছন্দ করেন অত্যাধিক৷ এমনকি ক্লাব পর্যায়ের নানান অনুষ্ঠানেও তাঁর খুব একটা সরব উপস্থিতি পাওয়া যায় না৷ কিন্তু এটা তো সকলেই জানে, নাইকি কোম্পানির চেলসি চুক্তির পেছনে তাঁর ভূমিকায় প্রবল। যে চুক্তিতে ২০৩২ সাল অবধি প্রতি মৌসুমে ৬০ মিলিয়ন পাউন্ড পাবে চেলসি যার পুরোটা দিয়েই ট্রান্সফার মার্কেটে হইচই ফেলতে পারবে তারা। একইভাবে ডাচ ক্লাব 'Vittese Arnhem' এর সাথে এক ঐতিহাসিক স্ট্র‍্যাটেজিক্যাল সম্পর্ক তৈরিতে অনন্য ভূমিকা রাখেন তিনি৷ গত প্রায় দশ বছর ধরেই চেলসি নিজেদের কিছু তরুণ খেলোয়াড়কে প্রস্তুত করার লক্ষ্যে প্রতি মৌসুমে সেই ক্লাবে লোনে পাঠিয়ে থাকে। এতেই প্রতি পদক্ষেপে ক্লাব নিয়ে তাঁর দূরদর্শিতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায়। তবে নিভৃতে থাকায় মারিনার এসকল ক্যারিশমাটিক বিষয় এতোদিন ক্লাবের বাইরে ততটা নজর কাড়েনি, ভেতরের কর্মকর্তারাই বরং বেশি উপভোগ করেছেন। 

একসময় রোমান আব্রাহমোভিচকে নিয়ে ঠাট্টা হতো এভাবে যে তিনি দাম দিয়ে খেলোয়াড় কিনতে জানেন বটে, কিন্তু বিক্রি করতে জানেন না! মারিনা এই হাস্যকরকেও মোটামুটি উড়িয়ে দিয়েছেন, অন্তত ভবিষ্যতে একথা বলার আর কেউ দুঃসাহস করবে না নিশ্চয়। গত পাঁচ বছরে ট্রান্সফার মার্কেট থেকে প্রায় ৫২০ মিলিয়ন পাউন্ড আয় করেছে চেলসি, যা অন্যান্য সকল ইংলিশ ক্লাবের তুলনায় বেশি। আর ২০১৯ সালে রিয়াল মাদ্রিদের নিকট চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র একবছর আগে হাজার্ডকে বেশ ভালো দামে বিক্রি করায় মারিনা তো শিরোনামই হয়ে উঠেছিলেন কোনো কোনো মিডিয়ায়।

মাঝে দুবছরের ট্রান্সফার ব্যানে ছিল চেলসি। যার ফলে তরুণ ও হাতে থাকা খেলোয়াড় নিয়েই লড়তে হয়েছে। সুতরাং এই মৌসুমে চেলসি ট্রান্সফার মার্কেটে আটঘাট বেঁধেই নামবে তা অনুমিত থাকলেও, করোনা মহামারীর থাবায় দিনশেষে তা নিয়ে সন্দিহান ছিল অনেকে। কিন্তু ওইযে চেলসিতে একজন মারিনা আছেন, যার চুক্তি করার কৌশলগুলো নখদর্পনে। ফলে মাত্র ৩৫ মিলিয়নে আয়াক্স থেকে মিডফিল্ডার হাকিমি জিয়েচ, ৪৭ মিলিয়নে আরবি লিইপজিগ থেকে জার্মান তারকা টিমো ওয়ার্নার, ৫০ মিলিয়নে লেস্টার থেকে ফুলব্যাক চিলওয়েল-কে দলে টেনেছেন। ডিফেন্স শক্তিশালী করতে মালাং সার ও পিএসজি থেকে অভিজ্ঞ থিয়াগো সিলভা-কে ভিড়িয়েছেন ফ্রি ট্রান্সফারেই৷ 

সর্বশেষ সাইনিং বায়ার্ন লেভারকুসেন থেকে জার্মানির নতুন সেনসেশন এটাকিং মিড কাই হাভার্টজ! দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা চেলসি-লেভারকুসেন এর আলোচনা অবশেষে আলোর মুখ দেখলো। তবে সব হিসাব কষে দেখা গেলো ২০০ মিলিয়নের এই মোট ইনভেস্টমেন্টটাই এসেছে হাজার্ড আর মোরাতা-কে বিক্রয়ের অর্থ হতে, অর্থ্যাৎ চেলসির নতুন ভাবে আহামরি কোনো অর্থ বিনিয়োগের প্রয়োজনই পড়েনি। আর নেপথ্যে স্বাভাবিকভাবেই আছেন একজন মারিনা। ট্রান্সফার মার্কেটে আচমকা দারুণ ভেলকি দেখিয়ে তাই তিনি এখন সর্বত্রই আলোচিত ও প্রশংসিত হচ্ছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেস্তে গিয়েছে প্রতিপক্ষের ট্রল, বরং জায়গা করে নিয়েছে ধারাবাহিক এপ্রিশিয়েশন পোস্ট!

যে মারিনা গ্রানোভস্কায়া নামটা কয়েক মাস আগেও চেলসি ফ্যানদের কাছেও অতটা পরিচিত ছিল না, অথচ মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই রীতিমতো তাঁর 'স্ট্যাচু' স্থাপনের দাবী জানিয়েছে, চেলসির একাংশ সমর্থকেরা! প্রেমে বুঁদ হয়েছেন ফুটবলপ্রেমীরাও। ইতিমধ্যেই মারিনা-কে অনেক মিডিয়াই আধুনিক ফুটবলের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারীর তকমাটাও দিচ্ছেন। তবুও আর কিছু না হোক, অন্তত এমুহুর্তে তিনি 'কুইন অব স্টামফোর্ড ব্রিজ' হয়ে উঠেছেন সেটা আর অস্বীকারের অবকাশ নেই।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা