গতকাল জাতিসংঘ কমিশনে অনুষ্ঠিত এক ভোট প্রক্রিয়ায় বেশীরভাগ দেশ গাঁজাকে মারাত্মক ক্ষতিকারক নেশাদ্রব্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার পক্ষে রায় দেয়। সায়েন্টিফিকলি এর কিছু উপকারিতাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যে কিছু বলার জো নেই! তবে আমি বাকি অর্ধেকের গল্পটা লিখছি...

গাঁজা, ম্যারিওয়ানা (marijuana), পট- যে নামেই ডাকেন, তাকে নিয়ে আমাদের জেনারেশনে বেশ হইচই চলে। গাঁজা বলতে ক্যানাবিস স্যাটিভা (Cannabis sativa) প্রজাতির শুকানো পাতা, ফুল, শেকড়, এবং বীজকে বোঝায়। এই উদ্ভিদে ডেল্টা ৯ টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল (THC) নামক নেশাজাত দ্রব্যসহ অন্যান্য যৌগ উপস্থিত থাকে। আগে এটা কেবলই মাদকদ্রব্য বা নেশার বস্তু ছিল। আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, আমার স্পষ্ট মনে আছে ম্যারিওয়ানা নিয়ে মাদকদ্রব্য বিষয়ক রচনায় পড়েছি। তবে বর্তমানে পৃথিবীর অনেক দেশেই চিকিৎসার কাজে গাঁজা ব্যবহৃত হচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে আরো অনেক দেশে ব্যবহার শুরু হবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। এমনকি গতকাল জাতিসংঘ কমিশনে অনুষ্ঠিত এক ভোট প্রক্রিয়ায় বেশীরভাগ দেশ গাঁজাকে মারাত্মক ক্ষতিকারক নেশাদ্রব্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার পক্ষেও রায় দেয়

সায়েন্টিফিকলি এর কিছু উপকারিতাকে সেবনকারীরা এমনভাবে উপস্থাপন করেন আজকাল যে কিছু বলার জো নেই! তবে তারা সায়েন্সের যে অংশটুকু তাদের সাথে মেলে, সেই অর্ধেকটুকু বলেন আর বাকি অর্ধেকটুকু চেপে যান। আমি বাকি অর্ধেকের গল্পটা লিখছি।

গাঁজা সাধারণত সিগারেটের মতো এর পোড়া ধোঁয়ার নিঃশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়। 'ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান' ১০৮ জন ব্যক্তির উপর তাদের এক গবেষণার পর জানায়, অনেকে গাঁজাকে কম নেশার দ্রব্য বললেও এটি অন্যান্য নেশা থেকেও তীব্র এবং কঠিন হয়। এ গবেষণার প্রধান এবং নিউরোসাইন্টিস্ট হেটজেগ বলেন- এই পরীক্ষা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, গাঁজা মস্তিষ্ককে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে একে সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করা কঠিন হয়ে যায় এবং মানুষের ব্যবহারের উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং মানুষকে কীভাবে মূল্যায়ন করতে হবে সেই বোধ থেকে দূরে সরিয়ে আনে। এই ধোঁয়া সবসময় খারাপ মনে নাও হতে পারে, কিন্তু এটি আপনার রক্তনালীর উপর প্রভাব বিস্তার করে। “আমেরিকান হার্ট ফেডারেশন” থেকে বলা হয় এটি ক্যানসার রোগের কারণ

তবে ভাববেন না আমি ক্যানসার রোগের দোহাই দিয়ে কাউকে গাঁজা থেকে দূরে আসতে বলছি। আমি এর আগের ঘটনাগুলো নিয়ে কথা বলব, যা হয়তো অনেকেই জেনেও যা জানার ভান করে আসছেন। 

বর্তমানে পৃথিবীর অনেক দেশেই চিকিৎসার কাজে গাঁজা ব্যবহৃত হচ্ছে

নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির সায়েন্টিস্টরা এক গবেষণা করে বলেছেন, যারা সময়ই গাঁজা সেবন করে থাকে তারা 'শর্ট টাইম মেমরি লস' রোগে আক্রান্ত। এই মেমরি লস হিন্দি সিনেমার আমিরের মত শর্ট টাইমের না হলেও স্বাভাবিক মানুষের থেকে বেশ অনেকখানিই শর্ট! এরা যখন গাঁজা সেবন করে, সে সময় থেকে বেশখানিকটা সময় পর্যন্ত এদের মেমোরি প্রচণ্ড তুখোড় থাকে। কিন্তু সেই সাময়িক সময়টা কেটে যাওয়ার পর থেকে আস্তে আস্তে তারা তাদের মস্তিকের অনেককিছু ভুলতে শুরু করে। এবং এমন এক অবস্থা আসে যখন কোন পড়া কিংবা গুরুত্বপূর্ন জিনিষ মনে রাখার জন্য তাদের গাঁজা সেবন করাটা বাধ্যতামূলক হয়ে যায়, যা ব্যতীত তাদের মস্তিষ্ক ঠিকমত কাজ করে না। 

বৈজ্ঞানিক ভাষায় গাঁজার ক্ষতিকারক প্রভাব:

শর্ট টার্ম ইফেক্ট: গাঁজার ধোঁয়া পান করার সাথে সাথে THC আমাদের ফুসফুসের মাধ্যমে দ্রুত রক্তে মিশ্রিত হতে শুরু করে। রক্ত প্রবাহ একে বহন করে ব্রেইনের এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে নিয়ে যায়। আমাদের শরীর THC দ্রুত গ্রহণ করতে পারে না বলে মোটামুটি ৩০ মিনিট পর এর প্রভাব অনুভব করা যায়। THC কয়েকটি নির্দিষ্ট কোষের উপর কাজ করে। আমাদের কয়েকটি ইন্দ্রিয়কে মাত্রাতিরিক্ত সক্রিয় করে দেয়। যার ফলে আমরা

  • গাঢ় রঙ দেখতে পাই
  • সময়জ্ঞান ঠিকভাবে কাজ করে না
  • মুড পালটে যায়
  • শরীরের উপর নিয়ন্ত্রন হারাই
  • কোনকিছু ভাবা বা মনে করা কঠিন হয়ে যায়

লং টার্ম ইফেক্ট: অল্প বয়সে গাঁজা সেবন শুরু করলে মস্তিষ্কের বিকাশের উপর প্রভাব পড়ে। গাঁজা সেবনের ফলে মস্তিষ্কে নিউরনের প্রয়োজনীয় সংযোগ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়, ফলে এটি ভাবনা, মেমরি, এবং কোনকিছু শিখার ক্ষমতা ইত্যাদি কমিয়ে দেয়। গাঁজার এই ক্ষতিগুলো অনেক দিন পর্যন্ত- এমনকি সারা জীবন স্থায়ী হতে পারে। শরীরের উপর গাঁজার প্রভাব-

  • নিঃশ্বাসে সমস্যা: যে কোন ধরনের ধুঁয়া পান করার ফলাফল খুবই মারাত্মক। শুধুমাত্র ফুসফুসের কথা বিবেচনা করলে সিগারেট এবং গাঁজা সমান ক্ষতিকর। ধূমপানের ক্ষতিকর দিক নতুন করে বলার কিছু নেই।
  • হৃদস্পন্দনের হার বৃদ্ধি: গাঁজা সেবনের ৩ ঘন্টা পর মানুষের হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পায়। এর ফলে হার্ট-এটাক হবার সম্ভাবনা থাকে, আর যাদের আগে থেকে হৃদরোগ আছে, তাদের তো কথাই নেই।
  • গর্ভাবস্থায় গাজা সেবন: গর্ভাবস্থায় গাঁজা সেবনের ফলে বাচ্চার মানসিক এবং শারীরিক দিক থেকে মারাত্মক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।

মানসিক এবং জীবনের উপর প্রভাব- গাঁজা সেবন কিছু লং টার্ম মানসিক সমস্যা সৃষ্টির পেছনে দায়ী। যেমন- ক্ষণস্থায়ী হ্যালুসিনেশন হওয়া, আশেপাশের মানুষের উপর অত্যধিক এবং অযৌক্তিক অবিশ্বাস জন্মানো। তাছাড়া আরও অনেক ধরনের মানসিক সমস্যা একজন গাঁজা সেবকের মাঝে লক্ষ্য করা যায়। যেমন- বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, আত্মঘাতী ভাবনা ইত্যাদি। এই নিয়ে গবেষণা চলছে এখনো। সকলের জন্যে সমান না হলেও, অল্প বয়েসিদের জন্য গাঁজা অত্যধিক আসক্তি সৃষ্টি করে। (বাস্তবতা থেকে পালাতে পালাতে একটা সময় মানুষের এটা ছাড়া থাকতে কষ্ট হয়।) 

গাঁজা সেবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলে এটি ছাড়া থাকতে সেবনকারীর কষ্ট হয়

গাঁজা ত্যাগ করার পর কী কী সমস্যা দেখা দিতে পারে? 

আপনি যত সময়ব্যাপী গাঁজা সেবন করবেন, এটা ত্যাগ করা তত কঠিন হয়ে পরবে। এর ফলে নিম্নোক্ত জটিলতা দেখা দিতে পারে।

  • খিটখিটে মেজাজ
  • অনিদ্রা
  • খাবারে অরুচি
  • উদ্বেগ
  • গাঁজার প্রতি তীব্র আকর্ষণ

গাঁজা সেবনের পর আপনি হালকা, চিন্তামুক্ত অনুভব করবেন ঠিকই, তবে এই চিন্তামুক্তির সাথে সাথে পরবর্তি জীবনের জন্য আপনি একগাদা চিন্তা কিনে আনবেন! কীভাবে? খুব সহজ কথায় বলি... 

আপনি যখন নিজেকে হালকা করার জন্য, চিন্তা থেকে দূরে রাখার জন্য গাঁজা নিচ্ছেন, ঠিক সেই সময় আপনার স্বাভাবিক ব্রেন তার চিন্তা করার ক্ষমতা একটু একটু করে হারিয়ে ফেলছে এবং আপনি যখন গাঁজাতে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন আপনার ব্রেন তখন পুরোপুরি কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। আপনার নিজের তখন চিন্তা করার, নিজের চিন্তাশক্তি কাজে লাগিয়ে কাজ করার ক্ষমতা একেবারে কমে যাবে এবং আপনি নেশা করে পরে থাকবেন, নিজের ভালো বোঝার মতো বুদ্ধিও তখন কাজ করবে না। এটা কি চিন্তামুক্তি করতে গিয়ে বিশাল চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে না? 

যারা গাঁজা খাওয়াকে স্টাইল ভাবছেন, খাচ্ছেন, তারা একবার নিজেদের পরিবর্তনগুলো নিয়ে ভাবুন, দেখুন ঠিকভাবে ভাবতে পারেন কিনা আদৌ, তারপর কী করবেন, কী খাবেন, কী করবেন না সেটা আপনাদের উপর। একটু ভাবুন প্লিজ!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা