প্রস্টিটিউট থেকে প্রিন্সেস, তারপর খুনি; অবিশ্বাস্য এক উত্থান-পতনের গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

তার কাছে ভালোবাসা কখনোই রোমান্টিসিজম ছিল না, বরং ভালোবাসার ভান ছিল তার বেঁচে থাকার অবলম্বন। তুমুল দারিদ্রতা থেকে এই নারী নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন ফ্রান্সের এলিট সমাজে। তারপর কী এমন ঘটেছিল যে তাকে খুনি হতে হলো?
তার নাম মারগারিট এলিবার্ট। তার কাছে ভালবাসা কখনোই রোমান্টিসিজম ছিল না, বরং তার কাছে ভালভাসার ভান হলো বেঁচে থাকার অবলম্বন। তুমুল দারিদ্রতা থেকে এই নারী নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন ফ্রান্সের এলিট সমাজে, তারপর কি এমন হলো যে তাকে খুনি হতে হলো? গল্পটায় ঘুরে আসা যাক বরং।
১৮৯০ সাল। এক ক্যাব ড্রাইভারের ঘরে জন্ম নিলেন মারগারিট এলিবার্ট। মা-ও জীবিকা নির্বাহ করতেন চাকরানী ধরণের কাজ কর্ম করে। ছোট বেলায় তার দায়িত্ব ছিল ছোট ভাইকে আগলে রাখবার। কিন্তু সেই চার বছর বয়সী ভাই লরির আঘাতে এক্সিডেন্ট করে মৃত্যুবরণ করে। ফলে বাবা-মা মারগারিটকে দায়ী করে বিষেদাগার করতে শুরু করে সেই সময়। তারা মারগারিটকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেয়।
বয়স যখন ১৫, তাকে নানরা একটা বাড়িতে পাঠায় যেখানে মারগারিটকে ফাই ফরমাস খাটার কাজ করতে হয়। অনেকটা কাজের চাকরের মতো অবস্থান তার। কিন্তু পরের বছর জানাজানি হলো যে, সে প্রেগনেন্ট। এর পেছনে কোন পুরুষ দায়ী তা জানা যায় না। মারগারিট পড়ে যায় বিশাল সমস্যায়। কারণ, ইতিমধ্যে সে জন্ম দিয়ে ফেলেছে শিশুটিকে, কন্যা শিশু। সেই শিশুটিকে নানরা পাঠিয়ে দেয় ফ্রান্সের এক ফার্মে। আর মার্গারিটকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়।
জীবন বাঁচানোর তাগিদে সে সেক্স ওয়ার্কার হিসেবে নেমে পড়ে। সে খেয়াল করে দেখলো, সমাজের উঁচু শ্রেণীর লোকেদের জন্য গতর খাটালে টাকা বেশি। তাই সে ভাবে প্রস্টিটিউট হলে উচ্চ শ্রেণীরই হবে। এক বেশ্যালয়ের মালকিনের নজরে পড়ে মার্গারিট। সে মার্গারিটকে নিজের দলভুক্ত করে নেয়। মার্গারিটকে সে তার সেরা ক্লায়েন্টদের কাছে পাঠায়, তাকে এমনভাবে তৈরি করে যে বড়লোক, উচ্চপদস্থ লোকেদের কাছে তার বিশেষরকম আকর্ষণ তৈরি হয়ে যায়।
পরের বছর বয়স যখন সতেরো, মার্গারিটের সাথে পরিচয় হলো মিলারের। মিলার বেশ ধনী। সে মার্গারিটকে এতটাই পছন্দ করে যে, তাকে একটা এপার্টমেন্টই কিনে দেয় যেন তাদের গোপন সম্পর্ক আরো গোপনে চালিয়ে নেয়া যায়। মার্গারিটও এই ধনী পুরুষের অর্থ সম্পদকে ভালোবাসে। যদিও মার্গারিট এই সম্পর্কে অবৈধ বলে ভাবতে নারাজ, সে দাবি করে তারা বিয়ে করেছিল।
যাহোক, মিলারের মতোই মার্গারিট এরপর আরো বড় 'বিগ ফিশ'কে তার মোহনীয়তায় ডুবায়। ১৯১৭ সাল তখন। মার্গারিট যার কাছে যায় সে আর কেউ নয়, অস্টম প্রিন্স এডওয়ার্ড। এই প্রিন্স প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সৈন্য পরিচালনা করে ফ্রান্সে। প্রিন্সের সাথে ব্যাপক ঘনিষ্ঠতা হয় মার্গারিটের৷ মূলত প্রিন্সকে যৌনশিক্ষা দেয়ার জন্যই মার্গারিটকে তার কাছে পাঠানো হয়েছিল। মার্গারিট এই কাজের নেশায় পড়ে যায়। তার মনে বড়ই লোভ জাগে। সে ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে অনেক উপহার পায়, তাতে তার মন ভরে না। সে আরো বেশি চায়। এই কাজ তাই চালিয়ে যেতে থাকে।
এরমধ্যে সে তার প্রথম বৈধ বিয়ে করে ১৯১৯ সালে। মাত্র ছয় মাস পর এই বিয়ে ভেঙ্গে যায় এবং মার্গারিট পরিকল্পনা মতো ডিভোর্স ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা আদায় করে সেই স্বামী থেকে। মার্গারিটের জীবনের থিউরি হলো, বেঁচে থাকতে হলে বড়লোকদের সাথে সম্পর্ক করতে হবে৷ সম্পর্কের চাহিদা যার যেরকম। তবে, মার্গারিট কখনো লস প্রজেক্ট হাতে নেয় না৷ আগের ডিভোর্সের পর এবার সে জুটিয়েছে এক মিশরীয় লর্ডকে। আলি কামেল ফাহমি নামক এই আদমির সাথে বিয়ে ঠিক হয় এবং তার অনুরোধে মার্গারিট কায়রো শহরে যায়।
কিন্তু বিয়েতে মার্গারিট দুইটা শর্ত দেয় আলী কামেলকে। প্রথম কথা, তাকে ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়তে দিতে হবে। দ্বিতীয় কথা, সে চাইলে আলীকে ডিভোর্স দিতে পারবে৷ এই শর্ত মেনে নেয়া হয় কিন্তু তার বদলে মার্গারিটকে বলা হয় মুসলিম হতে হবে। মার্গারিট রাজিও হয়। কিন্তু বিয়ের পূর্ব মুহুর্তে আলী ডিভোর্স এর শর্তটা বাতিল করে দেয় এবং উলটা নিজেই চুক্তিতে উল্লেখ রাখে, সে চাইলে ভবিষ্যতে আরো বিবাহ করতে পারবে। বিয়ে হয়েও যায়, লর্ড আলী কামেলের স্ত্রী হয়ে রাজরানী বা প্রিন্সেসের মতো মর্যাদা পায় মার্গারিট।

কিন্তু সমস্যার শুরু এখানেই। আলী কামেল এই শরীরজীবি নারীকে বাধ্য স্ত্রীর মতো পেতে চাইত। সে মার্গারিটকে নিজের মতো করে চালাতে চাইত। মার্গারিট ইসলামিক নিয়মে চলবে এমন আশা করত আলী কামেল। কিন্তু যে মার্গারিট এত পুরুষের নাকে দঁড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে, স্বাধীন জীবন যাপন করেছে, যে যৌন স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, সে কেন মানবে আলী কামেলের আধিপত্য? মানেও না৷ ফলে তাদের এই বিবাহিত জীবন অসুখী হয়। তারা প্রায়ই তুমুল ঝগড়া করে৷
তাদের অসুখী জীবন লুকানো থাকে না কিছুই। মার্গারিট আলীকে কথার চোট দিয়ে অপমানিত করতে চায় সবসময়। সবাই ভেবেছিল মার্গারিট বোধহয় আরো একটা ডিভোর্সের নাটকের অবতারণা করবে। সে আগে যেভাবে ডিভোর্স নিয়ে ক্ষতিপূরণ আদায় করেছে এবারও সেরকম কিছু করবে। তাছাড়া, গুজব চালু হয়ে গেছে এমন যে আলী কামেল হোমোসেক্সুয়াল। ফলে, মার্গারিট আলী কামেলের সাথে যৌন সম্পর্ক নিয়েও খুশি ছিল না খুব একটা। তাদের মধ্যে বিবাদ চরমে ওঠে।
১৯২৩ সাল। লন্ডনের একটা প্রোগ্রামে দুইজন এটেন্ড করে হোটেলে যায়৷ সেদিন তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটির সূত্র ধরে তুমুল ঝগড়া হয়। হাতাহাতিও হয়৷ রাগ করে আলী হোটেল রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে কয়েকঘন্টার জন্য। রাতের দুইটা বাজে। তখন হোটেল রুমে তিনটা গুলির শব্দ শোনা গেল। মার্গারিট আলী কামেলকে গুলি করে. ৩২ পিস্তল দিয়ে৷ এই পিস্তলটি মার্গারিটই জোগাড় করেছে। তার পক্ষে একটা পিস্তল জোগাড় অসম্ভব কিছু নয়। কয়েকঘন্টা ভুগে লর্ড আলী কামেল শেষ পর্যন্ত মারা যায়। আর প্রিন্সেস মার্গারিটকে গ্রেপ্তার হয়ে যেতে হয় হাজতে৷
কিন্তু, ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে। প্রিন্স এডওয়ার্ডের সাথে মার্গারিটের সম্পর্কের কথা বলেছিলাম প্রথম দিকে। এই খুনের এক বছর আগে মার্গারিট প্রিন্সকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে৷ প্রিন্স এডওয়ার্ডের পাঠানো কিছু চিঠি ছিল মার্গারিটের কাছে। যখন তাদের সম্পর্ক ছিল আবেগে প্রিন্স অনেক কিছুই চিঠিতে প্রকাশ করেছিল মার্গারিটকে। সেখানে বিশ্বযুদ্ধ, রাজপরিবার সহ অনেক কিছু নিয়েই এমন কথা ছিল যা প্রকাশ পেলে ব্রিটিশ রয়েল পরিবারটির জন্য লজ্জাজনক হতো৷
মার্গারিট যখন খুনের দায়ে আদালতে বিচারের মুখোমুখি, তখন সে আবারো ব্ল্যাকমেইল গেম খেলার চেষ্টা করে। সে ভেবেছে প্রিন্স এডওয়ার্ড তাকে বাঁচাবে৷ হয়েও ছিল তাই৷ ব্রিটিশ রাজ পরিবার নিজেদের মান সম্মান বাঁচাতে চুক্তি করে৷ মার্গারিটের অতীত জীবনের কথা টানা হবে না আদালতে, কিছুই প্রকাশ্য হবে না। প্রিন্স অস্টম এডওয়ার্ডের নামও আসবে না। এর বিনিময়ে নিহত আলি কামেলকে দুশ্চরিত্র হিসেবে প্রমাণ করা হবে৷ সেটাই হয়েছে, আদালতে মার্গারিট ছাড়া পায় কোনো জেল ছাড়াই। উল্টা আলি কামেল ফাহমিকেই খারাপ হিসেবে প্রমাণ করা হয় সেখানে৷
লোকজন বিস্মিত হয়। এই রায় নিয়ে জনগণের মধ্যে আগ্রহের সীমা ছিল না। কারণ, মার্গারিটকে সবাই একজন এলিট শরীরজীবি হিসেবে চিনত, যার সাথে ব্রিটিশ রয়েল রাজপরিবারের এক প্রিন্সের সম্পর্কের কানাঘুষো তারা শুনে। ফলে কি হয় কি হয় একটা ভাব তাদের মনে। কিন্তু তারা টেরও পায়নি, বিচারের আড়ালে কি ঘটে গেছে টেবিলের তলায়। তাই তারা মার্গারিটের মুক্তিতে বেশ অবাক বনে যায়। মার্গারিট তারপর আবার ফিরে যায় সেই প্যারিসে, যেখানে শুরু সেখানেই শেষ। আশি বছর জীবিত থাকার পর শেষ হয় মার্গারিটের খেল!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন