সর্বকালের সেরা ধনী বলতে কি বিল গেটসের চেহারা চোখে ভাসছে? কিংবা ওয়ারেন বাফেট? তবে পাঠক প্রস্তুত হন একটি বিস্ময়কর গল্পে হারিয়ে যাওয়ার জন্য। যে গল্পের শুরু আফ্রিকার মালিতে...

টাকা-পয়সা যদি হাতের ময়লা হয়, তাহলে পৃথিবীতে কার হাত সবচেয়ে বেশি নোংরা হতে পারে? কেউ কেউ চিন্তা ভাবনা না করেই বলে ফেলবেন বিল গেটস। বেশ অনেকবছর ধরে তার হাত যে সবচেয়ে নোংরা মানে তার হাতেই যে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সম্পত্তির দখল এই তথ্য ফোর্বস ম্যাগাজিনের মতো জায়গাগুলোতে ফলাও করে প্রচার হয়েছে। তবে এর মধ্যে জেফ বেজোস বিল গেটসকে ছাড়িয়ে বিগত তিন বছরে শীর্ষধনীর তালিকায় এক নম্বরেই জায়গা করে নিয়েছেন, দু নম্বরে চলে গেছেন বিল গেটস। এছাড়া ওয়ারেন বাফেটের কথাও আলোচিত। তার হাতের ময়লার ব্যাপারে সন্দেহ নাই। বিনিয়োগ গুরু বলে কথা, খেলেন বুঝেশুনে। তাই টাকা পয়শার লাইনে তার অবস্থান দীর্ঘদিন ধরেই শক্তিশালী।

রথচাইল্ড পরিবারের গল্পও অনেকে শুনেছে। এই ধনী পরিবারের কথাও বেশ আলোচিত। কিন্তু কখনো চিন্তা করেছেন সর্বকালের সেরা ধনী কে হতে পারে? যার সম্পত্তির পরিমাণকে এখনো কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারেনি? যার অর্থকরি ভরি ভরি। আহা! একটু ভেবেই দেখুন না। নাকি জেফ বেজোস, বিল গেটস ছাড়া কারো নাম মাথায় আসে না? আচ্ছা একটা ক্লু দেই। সর্বকালের সেরা ধনী হিসেবে যে মানুষটা স্বীকৃত সে আফ্রিকা অঞ্চলের! আফ্রিকা ভেবেই নাক কুঁচকে ফেলবেন না। আফ্রিকার লোকজনের শুকনা দেহ আর দুস্থ অবস্থা দেখে তাদের ব্যাপারে যদি আপনার বিল্ট-ইন বিরুপ ধারণা থাকে তাহলে সেটা এই ব্যাক্তির গল্পে কিছুটা কাটান দেয়ার চেষ্টা করবো। 

লোকটার নাম মুসা। লোকজনের কাছে তার পরিচয় হচ্ছে মানসা মুসা হিসেবে। “মানসা” মানে সুলতান। মুসা ছিলেন পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির সুলতান। একারণেই মানসা খেতাব। মানসা ছাড়াও কমপক্ষে আরো ডজনখানেক উপাধি ছিল মুসার। তাকে প্রথম মুসা, মালির আমির, ওয়াংগারা খনির সম্রাট, কনকান মুসা, কানকো মুসা, মালির সিংহ, গঙ্গা মুসা সহ বিবিধ নামেও ডাকা হতো। 

আফ্রিকার মালি সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন সুন্দিয়াতা কেটা। এই কেটা নামের লোকটার নাতি মানসা মুসা জন্মগ্রহণ করেন আনুমানিক ১২৮০ সালে। ৩২ বছর বয়সে মুসা মালির সিংহাসন গ্রহণ করেন। যাকে এই মালি সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সফল শাসক বলা হয়। তার সাম্রাজ্য খুবই বিস্তৃত ছিলো। বর্তমান সময়ের মালি, আইভরি কোষ্ট, মৌরিতানিয়া, সেনেগাল, নাইজেরিয়া, গাম্বিয়া, বুর্কিনা ফাসো, গিনি, গিনিবিসাউ, চাঁদ- দেশসমূহ নিয়ে তার বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে মুসা খুব দ্রুত প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, মুসা ছিলেন ইসলাম ধর্ম প্রচারক, শিক্ষানুরাগী, বিজ্ঞানমনস্ক একজন মানুষ। এই মানুষটিই ধন সম্পদে এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠেন যে, এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সর্বকালের সবচাইতে ধনী ব্যক্তি হিসেবে তাকে ধরা হয়। 

২০১২ সালের একটি জরিপে বিশ্বের সর্বকালের সবচেয়ে ধনী ২৫ জন ব্যাক্তির তালিকা প্রকাশ করা হয়। মূল্যস্ফীতি হিসাব করে করা এই জরিপ অনুযায়ী মুসার সম্পদের পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি ডলার! এটি কত বেশি সেটা বুঝতে হলে ২০২০ সালের ফোর্বসের দেয়া  জেফ বেজোসের সম্পদের হিসাব দেখতে হবে। এ বছর জেফ বেজোসের সম্পদের পরিমাণ ১১ হাজার ৩০ কোটি ডলার। তার মানে মুসার সম্পদের পরিমাণ জেফ বেজোসের বর্তমান সম্পদ থেকেও প্রায় ৪ গুণ বেশি ছিল! 

কিন্তু কীভাবে এত সম্পদের মালিক হন মানসা মুসা? ১৪ শতকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী তিনটি অঞ্চলের একটি ছিল পশ্চিম আফ্রিকার মালি সাম্রাজ্য। এর কারণ, তামাম দুনিয়ায় যত সোনা উত্তোলন এবং লবন আহরণ হতো তার অর্ধেকটাই ছিলো মালি সাম্রাজ্যে। চিন্তা করে দেখুন, একজন মানুষের কাছে পৃথিবীর উত্তোলিত অর্ধেক স্বর্ণের মালিকানা! এই সোনা আর লবনের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে ওঠেন মানসা মুসা। এছাড়া তার যে বিশাল সাম্রাজ্য সেখান থেকে নিয়মিত খাজনা সংগ্রহ করতেন। তার সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ভূমধ্যসাগরের তীর পর্যন্ত উত্তর আফ্রিকার মধ্যবর্তী এলাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক পথ। এই পথে বাণিজ্য করতে আসা মধ্যপ্রাচ্য আর ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও রাজস্ব আদায় করতেন দক্ষ এই শাসক। এভাবেই দিনে দিনে তার সম্পদ, ঐশ্বর্য এতটাই বেড়ে যায় , যা তাকে সর্বকালের সেরা ধনী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য যথেষ্ট’র চেয়েও অনেক বেশি। 

সম্পদ অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। কিন্তু মুসার সম্পদ এবং সাম্রাজ্য দুটোই রক্ষা করার জন্য ছিল বিশাল এক বাহিনী। অনেকটা আজকের দিনের সেনাবাহিনী টাইপ। তার এই বাহিনীর সদস্য ছিলো দুই লক্ষ! যার মধ্যে ৪০ হাজার তীর চালনায় ছিলো অতি দক্ষ। এই বাহিনী নিয়ে তিনি ক্ষমতায় আরোহণের পর ২৪ টি বড় শহর ও বেশ কিছু গ্রামাঞ্চল জয় করেন। তার সাম্রাজ্যের সীমানা হয় বিস্তৃত। এত বিপুল পরিমাণ ঐশ্বর্য, বিত্ত-বিভব যার,তার চলাফেরাই হবে অন্যরকম। আসলেই তাই। মানসা মুসা এমনই বিলাসিতা দেখিয়েছেন যে, তাকে ঘিরে অনেক গল্প আছে। তার মধ্যে হজ্জ্ব করতে যাওয়ার গল্পটি সুবিদিত।

১৩২৪-২৫ সালের দিকের কথা। ওই সময় চার হাজার মাইল পেরিয়ে হজ্জ্ব করতে রওনা হয়েছেন মানসা মুসা। তবে একা নন। তার সাথে ৬০ হাজার মানুষ। যার ১২ হাজারই সেবক, যারা মানসা মুসার সেবার কাজে সার্বক্ষনিক নিয়োজিত। এই সেবকদের প্রত্যেকের হাতে ছিল চার পাউন্ডের সোনার বার। এই সফরে ছিলো ৮০ টি উট, যাদের প্রত্যেকের পিঠে ছিলো প্রায় ৩০০ পাউন্ড সোনা। মুসার স্ত্রী তার সাথে হজ্জ্বের সফরে ছিলেন এবং শুধু এই নারীর সেবার জন্যে ছিলো ৫০০ দাসী। তার পাঁচশ’র বেশি দাস শুধুমাত্র স্বর্ণ মুদ্রা, সোনার বার, খনিজ লবনসহ মূল্যবান রত্ন পাথর বহনের কাজে নিয়োজিত ছিল। মুসার এই হজ্জ্ব বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। সফরের পথে নাইজার নদী পড়ে। নদী পার হলেই সুবিশাল সাহারা মরুভূমি। এই মরুভূমি পার হতে মুসার বিশাল বহরের ৬০ দিনের মতো লাগে। এরপর তাদের সামনে পড়ে নীল নদ। নীল নদের অপর পাড়ে মিশরে মুসার সফর নামার খবর ছড়িয়ে পড়ে। দিকে দিকে মানুষ জেনে যায় এক বিশাল ধনী সুলতান তাদের মাটি দিয়ে হজ্জ্ব যাত্রায় যাবেন। লোকাল ব্যবসায়ীরা চাতুরি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয় যাতে মুসার কাছ থেকে বাড়তি পয়শা আয় করতে পারেন। মুসাও খরচ করেছেন দেদারসে। তার খরচের প্রভাব হয়েছিলো মারাত্মক। মিসরের আলেক্সান্দ্রিয়ায় মুসা এতটা বেশি পরিমাণে অর্থ এবং স্বর্ণব্যয় করেন যে এর প্রভাবে মিশরের স্বর্ণের বাজারে বিশাল মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। সেখানকার অর্থনীতিতে ধ্বস নামে। এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে এক দশক সময় লেগেছিল মিশরবাসীর! 

তার বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ কেনার প্রভাবে মিশরে স্বর্ণের বাজারে বিশাল মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়

মুসা ছিলেন একজন ধর্মপ্রচারকও। ইসলাম ধর্মকে প্রচার করতে তিনি আগে পরে অনেক কাজ করেছেন। তবে হজ্জ্বের সময়ে তার মসজিদ নির্মাণের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। কথিত আছে, দীর্ঘ এই হজ্জ্ব যাত্রার দিনগুলোতে প্রতি সপ্তাহে শুক্রবারে একটি করে মসজিদ নির্মাণ করতেন মুসা। যাত্রাপথে বিভিন্ন শহরে অসংখ্য মসজিদ নির্মাণ করেছেন তিনি। এই হজ্জ্ব যাত্রার খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যায়। সেসময়ে ইউরোপের বিভিন্ন মানচিত্র তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান আফ্রিকার মানচিত্রগুলোতে মুসার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা শুরু করলেন। মানচিত্রে মুসার হাতে প্রতীকী স্বর্ণদন্ড দেখা যেতো। 

মুসার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও আকর্ষনীয় দিকটি হচ্ছে তিনি শিক্ষা দীক্ষার ব্যাপারে খুব সচেতন ছিলেন। সেসময়কার প্রেক্ষাপটে এরকম একজন শাসক যিনি আবার কিনা অর্থ সম্পদে প্রকান্ড, শিক্ষার দিকে খেয়াল করবেন এমনটা আসলেই বিরল। তার নিরলস চেষ্টায় মালি হয়ে ওঠে আফ্রিকার শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। মুসা একটি লাইব্রেরি করেছিলেন। এটি যেনতেন লাইব্রেরি নয়। তখনকার দিনে সারা পৃথিবীতে যত বইয়ের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল তারপ্রায় সবগুলোরই একটি করে কপি ছিল এই লাইব্রেরিতে! মুসা তার বিখ্যাত হজ্জ্ব যাত্রা থেকে ফেরার পথে একটি ব্যতিক্রমধর্মী কাজ করেছিলেন। উট বোঝাই করে চিকিৎসা, জোতির্বিদ্যা, দর্শন, ভূগোল, ইতিহাস, গণিত এবং আইন বিষয়ে প্রচুর বই নিয়ে আসেন। এছাড়া মক্কার সবচেয়ে মেধাবী ও সেরা গণিতবিদ, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী ও স্থাপত্যবিদদেরকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছিলেন মালিতে।

মালির তিম্বাকতু শহরকে বৃত্তিপ্রাপ্ত মুসলিমদের শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত করেন এই সম্রাট। এখানে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তিম্বাকতু বিশ্ববিদ্যালয়। এ কারণে, অনেক মুসলিম দেশ থেকেই তখন ছাত্রছাত্রীরা মালিতে আসতে চাইতো। একইসঙ্গে শহরটি বাণিজ্য এবং সংস্কৃতি চর্চার একটি কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়। এছাড়া তখনকার অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সানকোর বিশ্ববিদ্যালয় তিনি প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে যান। এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ২৫ হাজার শিক্ষার্থী পড়ার সুযোগ পান। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির পর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ছিল সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ বই সংগ্রহের দিক থেকে। 

একজন সম্পদশালী মানুষকে আপনি কেন মনে রাখবেন? শুধু একজন মানুষের অশেষ অর্থ আছে এই কারণে তাকে মনে রাখার কিছু নেই। কিন্তু, কেউ যদি অর্থ দিয়ে অর্থপূর্ণ কিছু করে যায়,সেই কাজকে নিশ্চয়ই স্মরণ করা যায়। ইতিহাসও নিশ্চয়ই তেমনটা পছন্দ করে। এ কারণে, মানসা মুসা নামক পশ্চিম আফ্রিকার বিশাল সাম্রাজ্যের এক সুলতানের প্রাসাদ, প্রতিপত্তি আজ বিলীন। নেই মানসা মুসার দেহ। কিন্তু ঠিকই আছে তার রেখে যাওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, লাইব্রেরিগুলো। যে প্রতিষ্ঠানে আজও আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করতে পারছে, যে মসজিদ গুলোতে এখনো সেখানকার মানুষ স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় নামাজ ও প্রার্থনা করে, যে লাইব্রেরিগুলো এখনো বাতিঘর হয়ে পথ দেখাচ্ছে হাজার হাজার মানুষকে। 

আজকের ক্ষুদা-দারিদ্র-অভাবের গল্পের শহর আফ্রিকার এক ভিন্ন গল্পের নায়ক হয়ে থাকা মানসা মুসা ২৫ বছর ক্ষমতায় থেকে মৃত্যুবরণ করেন। পৃথিবীর সবচাইতে ধনী মানুষের তকমা তাকে মৃত্যু থেকে বাঁচাতে পারেনি, তবে তার ব্যাতিক্রমধর্মী কাজ তাকে অমর করে রাখবে ইতিহাসে, সে কথা তো বলাই যায়! 

বিজনেস ইনসাইডার অবলম্বনে


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা