বলিউডে শুরুতে তাকে ডাকা হতো অপয়া। সেখান থেকে হয়েছেন বলিউডের সবচেয়ে পারিশ্রমিকের নায়িকা। বহু মানু্ষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। আবার ফিরে এসেছেন। হারেননি কখনো। হারার চেষ্টাও করেননি।

পরিচালক ইমতিয়াজ আলী তখনও সিনেমাজগতে অত কেউকেটা কেউ না। নতুন একটি সিনেমা করবেন। সে নিয়েই তোড়জোড় চলছে। এরকমই এক সময়ে এক প্রতিবেশি এসে খবর দিলেন- 'আমাদের বাসায় এক গেস্ট এসেছে। এসে একটু দেখে যান।' ইমতিয়াজ আলী গেলেন প্রতিবেশির পিছুপিছু। অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে দূর থেকে দেখলেন, কে একজন মাটিতে বসে ট্যাপ থেকে পানি খাচ্ছে। ইমতিয়াজ আলী প্রথম ধাক্কা খেলেন তাঁকে যখন কাছ থেকে দেখলেন। যিনি এভাবে ঘরের আটপৌরে সদস্যরা মতন ট্যাপ থেকে পানি খাচ্ছেন, তিনি আর কেউ না। তিনি মনীষা কৈরালা। নাইন্টিজের বলিউড যারা নিয়মিত ফলো করতেন, তাদের স্বপ্নের নায়িকা! চেহারা, অভিনয়, বিতর্ক দিয়ে যিনি বরাবরই ছিলেন আলোচনার লাইমলাইটে।

যদিও বলিউডে রাজত্ব করেছেন ইচ্ছেমত, তবে তিনি ভারতের মেয়ে সেই অর্থে নন। জন্ম নেপালে। চেহারার মধ্যে অল্প অল্প নেপালি স্নিগ্ধ ভাব রয়েছে বলেই অন্যসব নায়িকাদের সাথে তাঁর স্পষ্ট একটা ব্যবধান দেখা গিয়েছিলো, ক্যারিয়ারের শুরুতেই। নেপালের কাঠমাণ্ডুতে পুরোদস্তুর রাজনৈতিক পরিবেশে জন্ম তাঁর। বাবা প্রকাশ কৈরালা ছিলেন নেপালের একসময়ের পরিবেশ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী। ঠাকুরদা বিশ্বেশ্বর প্রসাদ কৈরালা ছিলেন নেপালের বাইশতম প্রধানমন্ত্রী। এরকম রাজনৈতিক পরিবেশের মেয়েটি রাজনীতি ছেড়ে কেন অভিনয়ে এলেন, সেটি আসলেই বেশ চিন্তাভাবনার এক বিষয়৷

নেপালে জন্ম নিলেও মনীষার পড়াশোনা কিন্তু আবার ভারতে। তীর্থস্থান বারাণসীতে দাদু-দিদিমার কাছে বড় হয়েছেন। প্রাথমিক পড়াশোনা এখানেই করেছেন। এরপর পড়াশোনা করেছেন দিল্লি আর মুম্বাইতেও। চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছে ছিলো তাঁর। কিন্তু ললাটের লিখন না যায় খণ্ডন! রাজনীতিবিদ বা চিকিৎসক কিছুই হওয়া হলোনা, ক্লাস টেনে থাকতে ঝোঁকের বশেই নেপালি এক সিনেমায় অভিনয় করলেন। 'ফেরি ভেতৌলা' নামের এই সিনেমায় প্রথমবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন। ভীষণ নার্ভাস, পেটের মধ্যে মোচড়াচ্ছে যেন কী। হাঁত-পা কেঁপে শরীরের মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে এমন অবস্থা। তাও শট 'এনজি' হলোনা। কীভাবে কীভাবে যেন উতরে গেলো সব। এই সিনেমার পরেই মনীষা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, সব বাদ। করতে হবে অভিনয়। নেপাল ছাড়লেন। পাকাপাকিভাবে চলে এলেন মুম্বাই।

কিন্তু ভারতে এসেই তিনি বুঝতে পারলেন 'বলিউড' নামের যে জগতে তিনি এসেছেন, সেখানে টিকে থাকা খুব শক্ত। সুভাষ ঘাইয়ের পরিচালনায় মনীষার প্রথম হিন্দি ছবি ‘সওদাগর’ মুক্তি পায় ১৯৯১ সালে। এরপর যে ছবিগুলো করেছেন সবই ফ্লপ। বলিউডে তার একটা তকমাও হয়ে যায়, অপয়া। সিনেমার পরিচালকেরা তাঁর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছিলেন। কোনো সিনেমায় অভিনয়ও আসছিলোনা আর। ওদিকে মনীষাও মরিয়া। যেভাবেই হোক, নামের পাশ থেকে 'অপয়া' শব্দটিকে সরাতেই হবে।

বিধু বিনোদ একটা নতুন সিনেমা করছেন তখন। নাম- ১৯৪২ এ লাভ স্টোরি৷ এখানে মাধুরী দীক্ষিতের বোনের চরিত্রের জন্যে অভিনেত্রী খুঁজছিলেন তিনি। মনীষা এই চরিত্রে অভিনয়ের ডাক পান। অডিশন দিতে আসেন। কিন্তু খুব অল্পদিনেই মনীষার উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক ঝড়। সিনেমা ফ্লপ, পরিচালকদের মুখ ফিরিয়ে নেয়া, অপয়া হিসেবে পরিচিতি পাওয়া... মাথায় অনেক চাপ নিয়ে অডিশনটা তাই খুব ভালো হলোনা। সহজ সহজ অভিনয়ও ভুল করে গেলেন তিনি। বিধুবিনোদ ক্ষেপে বেরই করে দিলেন মনীষাকে। বললেন- যাচ্ছেতাই অভিনয় করেন তিনি। মনীষা দিশেহারা হয়ে চাইলেন একদিন সময়। বিধুবিনোদ তখন দিলেন এক অদ্ভুত চ্যালেঞ্জ। বললেন, একদিনের মধ্যে মনীষা যদি অভিনয়ে ইম্প্রুভমেন্ট করতে পারেন, তাহলে মাধুরীর পরিবর্তে তাকেই নায়িকা হিসেবে নেবেন তিনি।

পরদিন এলেন মনীষা। অডিশনে মাত করে দিলেন। বিধু বিনোদও কথা রাখলেন, মাধুরীর জায়গায় নির্বাচিত হলেন মনীষা। এ সিনেমা হয়তো বক্সঅফিসে খুব বেশি ব্যবসা করেনি। তবে মনীষার চ্যালেঞ্জ জেতা এ সিনেমাটি হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে প্রথম সিনেমা হিসেবে 'ইউনিভার্সাল/এ্যাডাল্ট' তকমা পায়।

এরপর ভালো সিনেমা করেছেন অগুনতি। বম্বে, দারার, ইন্ডিয়ান, খামোশি দ্য মিউজিক্যাল, দিল সে, আকেলি হাম আকেলি তুম সিনেমাগুলোতে অসাধারণ কাজ করে বলিউডের প্রথম সারির অভিনেত্রী হয়ে যান তিনি। ইন্ডাস্ট্রিতে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক নেয়া নায়িকাদের মধ্যে তাঁর নাম উঠে আসে সবার উপরে। বলিউডের তিন খানের বিপরীতে অভিনয় করার সুযোগ পাওয়া  যেকোনো নায়িকার জন্যেই এক মাইলস্টোন৷ তিনি শাহরুখ-সালমান-আমির তিনজনের বিপরীতেই অভিনয় করেন। সাউথের কিছু সিনেমাতেও অসাধারণ অভিনয় করেন। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে এক দশক কাটান তিনি।

কিন্তু এরপরেই আবার ছন্দপতন। ভালো সিনেমা আসছিলোনা তাঁর কাছে। তিনিও বড়পর্দা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যান ছোটপর্দায়। এরপর আমেরিকা যান, সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করার জন্যে। সেগুলো শেষ করে ফিরে এসে আবার অভিনয়ে মনোযোগী হন। কিন্তু তাও খুব একটা লাভ হয়না।

বলিউডে একসময়ে চাউর ছিলো নানা পাটেকার ও মনীষা কৈরালার প্রেমকাহিনী

ক্যারিয়ারে ভাঙ্গন, বলিউডের বহু মানুষের সাথে তাঁর সম্পর্কের গুঞ্জন। এরকমই এক ডামাডোলের মধ্যে ২০১০ সালে বিয়ে করে ফেলেন নেপালের এক শিল্পপতিকে। দুই বছরের মাথাতেই হয়ে যায় ডিভোর্স। এরপরেই আসে ভয়ানক দুঃসংবাদ। জানা যায়, মনীষার ওভারিতে সংক্রমিত হয়েছে ক্যান্সার। নেপাল, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রে দৌড়াতে থাকেন চিকিৎসার জন্যে। অপারেশন করে ক্যান্সার অপসারণ করা হয়। টানা চার মাসে আঠারোটি কেমোথেরাপিও দিতে হয় তাকে। চুল, চোখের পাপড়ি, ভ্রু ঝরে যায় সব। তবুও প্রানে বেঁচে যান তিনি।

কেমোথেরাপির প্রভাবে মাথার চুল সব ঝড়ে গিয়েছিলো এক সময়ে! 

বুঝতে পারেন, দ্বিতীয় জীবন পেয়েছেন তিনি। ক্যান্সারের এই সময়টা নিয়ে বই লেখেন- 'হিলড- হাউ ক্যানসার গেভ মি এ নিউ লাইফ।' বইটি বেশ সাড়া ফেলে। অকপটে অনেক কিছুই স্বীকার করেন তিনি সেখানে। ক্যান্সারের সাথে লড়াই এর এই বইটি অনুপ্রেরণা দিয়েছে অনেককেই। তবে শুধু বই লিখেই থেমে থাকেননি তিনি। ক্যান্সার নিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে নিয়মিত সভা-সেমিনার করেছেন। এখনো করছেন। ক্যান্সার এ্যাপ চালু করেছেন। সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ক্যান্সার নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে। নেপালে ইউএনএফপি'র শুভেচ্ছাদূত হয়েছেন। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, পেয়েছেন 'স্পিরিট অফ ইন্সপিরেশন' এ্যাওয়ার্ড। পেয়েছেন নেপালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা অর্ডার অব গোর্খা দক্ষিণ বাহু। নারীশিক্ষার প্রসার বা বাল্যবিবাহ নিরসন... কৈরালা সরব সবখানেই। এরমধ্যে অভিনয়েও কিন্তু ইস্তফা নেই। ডিয়ার মায়া, সঞ্জু,
চেহরে: এ মডার্ন ডে ক্লাসিক’ সিনেমাগুলোতে বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। ওয়েব প্লাটফর্মেও সিনেমা মুক্তি পেয়েছে তাঁর। সবদিকেই মোটামুটি ব্যালেন্স করার চেষ্টা করেছেন তিনি।

বাস্তব জীবনে তিনি অজস্রবার নিয়েছেন ভুল সিদ্ধান্ত। ক্যারিয়ারের গ্রাফও বরাবরই ছিলো উঁচুনিচু। বহু মানুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছেন, নাস্তানাবুদ হয়েছেন। ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ফ্লপ সিনেমা করেছেন। অপয়া ট্যাগ পেয়েছেন। আবার ভালো সিনেমা করে কামব্যাক করেছেন। ক্যান্সার জাপটে ধরেছিলো। সেখান থেকেও দুর্দান্তভাবে ফিরে এসেছেন। মনীষার জীবন-গল্পে আর যাই হোক, হার নেই। তিনি পিছিয়ে যান। আবার ঠিকই সামনে চলে আসেন৷ হতাশা আঁকড়ে বসে থাকেন না মোটেও। ঠিক এ কারণেই তিনি এখনো আলোচনার শিরোনামে আসেন, মানুষ এখনো তাকে শ্রদ্ধাভরেই মনে রাখে। তাঁর অভিনয়, ব্যক্তিজীবন, কাজকর্ম নিয়ে আজও আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ক হয়।

এভাবেই বহু দশক ধরে মনীষা কৈরালা দর্শকদের হৃদয়ে প্রেরণা, ভালোবাসা ও অধ্যাবসায়ের নিদর্শন হিসেবে টিকে আছেন বহাল তবিয়তে। 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন



 

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা