ধর্ষক আসলে কেমন হয়? দেখতে তার মধ্যে কী কী বিশেষত্ব থাকে? কান কি দুটোর জায়গায় তিনটা থাকে? মুখভর্তি লোম থাকে? হাতের আঙুল ছয়টা করে হয়?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত একমাত্র ব্যক্তিটি ধরা পড়েছে র‍্যাবের হাতে, তাকে সংবাদমাধ্যমের সামনে হাজির করে বিস্তারিত বর্ণনা করেছে র‍্যাব। কীভাবে, কখন কোথা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, কোন সূত্র ধরে র‍্যাব তদন্ত করেছে, সবকিছুই উঠে এসেছে তাদের বক্তব্যে। কিন্ত আমরা জাতে তো বাঙালি, সবকিছুর মধ্যেই আমাদের নোংরা স্বভাবটা প্রকাশ না করলে চলে না। আর তাই গ্রেফতারের নিউজ কিংবা প্রেস ব্রিফিংয়ের ভিডিওর নিচে অদ্ভুত সব কমেন্ট চোখে পড়ছে। জাতিগতভাবেই নোংরা মানসিকতার মানুষ আমাদের মধ্যে বেশি, এটা জানা ছিল। কিন্ত সেই নোংরামী যে অভ্যস্ত আমাকেও অবাক করে দিতে পারে, সেটা ভাবনার করিডোরে ছিল না।

প্রথম, এবং সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটা, সেটা হচ্ছে, একদল উজবুক মেনেই নিতে পারছে না যে, গ্রেফতার হওয়া মজনু নামের ব্যক্তিটি ধর্ষনের সঙ্গে জড়িত। তাদের চোখে, এটা হচ্ছে আরেকটা জজ মিয়া নাটক! দুবলা-পাতলা একটা লোককে হাজির করে আইন-শৃঙ্ক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনী নাকী নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে চাইছে। নইলে এরকম ছোটখাটো গাঁজাখোর টাইপের একটা মানুষ কী করে একা একটা মেয়েকে জনবহুল ব্যস্ত রাস্তার পাশে ধর্ষন করতে পারে? 

গতকাল থেকে আরেকটা ব্যাপার চোখে পড়ছিলো। কয়েকটা সংবাদমাধ্যমে নির্যাতিতা ওই তরুণীর জবানবন্দীর খবর এসেছে, সেখানে ধর্ষক 'দাম্ভিক' প্রকৃতির লোক ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাঙালি এই দাম্ভিকতার সঙ্গে মিশিয়েছে ঘটনাস্থলকে, যেটা ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ার ঠিক পাশেই। কমেন্টবক্সে অনেকে তো নিশ্চিতভাবেই বলে দিচ্ছিলো, সেনাবাহিনীর সঙ্গে জড়িত কেউই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। কোথা থেকে যেন বিশালদেহী আর শক্তিমান টাইপের টার্মসও চলে এলো। আমাদের চিরাচরিত ফিক্সড মাইন্ড সেটআপ তো আছেই, যেটা একবার মাথায় ঢুকেছে, সেটা আর কখনও বের হবার নয়। 

র‍্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়া ধর্ষক মজনু

আর কল্পিত সেই অবয়বের সঙ্গে মিলছে না বলেই ক্ষেপে উঠেছে জনতার একাংশ। অনলাইন সংবাদমাধ্যমের কমেন্টবক্স গরম করছে তারা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পুরো ঘটনা বোধহয় তাদের চোখের সামনে ঘটেছিল, ধর্ষক যেন তাদের পাড়া-পড়শী, জন্ম জন্মান্তর থেকে ধর্ষকের সঙ্গে তাদের পরিচয়। হকার বা ভবঘুরে কেউ যে ধর্ষণ করতে পারে, এটা তারা মানতেই রাজী নয়। তাদের ধারণা, ধর্ষন করবে ছাত্রলীগ, ধর্ষন করবে উঁচুতলার লোকজন। 

অথচ আটক হওয়া মজনু যে দিনমজুরির পাশাপাশি চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধেও জড়িত ছিল, সেটা কিন্ত র‍্যাব জানিয়েছে। র‍্যাব আরও বলেছে, মজনু কোন সাধারণ অপরাধী নয়, সে একজন সিরিয়াল রেপিস্ট। এর আগেও সে ভিক্ষুক বা প্রতিবন্ধী নারীদের ধর্ষন করেছে। তার কপাল ভালো যে সেই নারীদের কেউ অভিযোগ জানায়নি পুলিশের কাছে, হয়তো ভয়ে, কিংবা লোকলজ্জায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীটি এসব জুজুর পরোয়া করেনি, সেকারণেই মজনুর মতো একটা পিশাচ ধরা পড়েছে।

এসব লোকজনকে আমার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, ধর্ষক আসলে কেমন হয়? দেখতে তার মধ্যে কী কী বিশেষত্ব থাকে? কান কি দুটোর জায়গায় তিনটা থাকে? মুখভর্তি লোম থাকে? হাতের আঙুল ছয়টা করে হয়? নাকি প্রতিটা ধর্ষকই ছয় ফুটের ওপরে লম্বা হয়, পেটানো চেহারার অধিকারী হয়, তাদের মাসল কিলবিল করতে থাকে- এরকম কিছু? দৈহিক দিক দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের পার্থক্যটা কোথায়? কপালে খোদাই করে কিছু লেখা থাকে? শরীর থেকে আলো বের হয়? নাকী অন্য গ্রহের ভাষায় কথা বলে? মজনুর মধ্যে কী এমন বৈশিষ্ট্যটা মিলছে না বলে তাকে ধর্ষক বলে মানতে আপনাদের এত আপত্তি? 

দুনিয়ার আর কোন দেশে এই ঘটনা ঘটলে অপরাধী গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি বিতরণ শুরু হতো, অন্তত লোকজন খুশির বহিঃপ্রকাশটা করতো দল-মত নির্বিশেষে। অথচ এখানেও আমরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছি। সামান্য কিছু সূত্র থেকে মজনুকে গ্রেফতার করায় র‍্যাবের যেখানে অভিনন্দন প্রাপ্য, সেখানে উল্টো তাদের প্রতি ফালতু আর অযৌক্তিক সব প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়া হচ্ছে! মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভিক্টিম নিজে কিন্ত মজনুকে ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তিনি বলেছেন- পৃথিবীর সব চেহারা ভুলে গেলেও, এই একটা চেহারা তিনি কখনও ভুলবেন না। তার বক্তব্য পাবার পরেই মজনুকে সংবাদমাধ্যমের সামনে এনেছে র‍্যাব। 

চলছে নোংরা মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ!

ধর্ষনের ঘটনা ঘটবে, আর ভিক্টিমের ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশন হবে না, তার পোষাক নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না- এটা এই বঙ্গ মুল্লুকে হতেই পারে না! ছাত্রীটি কেন জিন্স প্যান্ট পরে বাইরে গিয়েছিল, এটাও এখন ইস্যু হয়ে গেছে! একদল অমানুষের কাছে ধর্ষনের চেয়ে বড় অপরাধ হচ্ছে জিন্স পরে কোন মেয়ের ঘরের বাইরে যাওয়াটা! জিন্স পরে বের হলে তাকে ধর্ষন করা জায়েজ! এই পটেনশিয়াল রেপিস্টদের জন্যেই ধর্ষকেরা সাহস পায়, তারা জানে, দিনশেষে তাদেরই দলভুক্ত কিছু লোক ভিক্টিমের কল্পিত দোষ খুঁজে বের করে পুরো ব্যাপারটাকে লঘু করার চেষ্টা করবে।

আরেকটা নোংরামি হচ্ছে, যেটা সহ্য করার মতো নয়। ভুক্তভোগী তরুণীর শ্বাসকষ্ট আছে, এবং আক্রমণের পর থেকে মজনু তাকে কয়েকদফা মারধর করেছে, গলা টিপে ধরেছে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন কয়েক বার। এটা এখন কারো কারো কাছে বিমলানন্দের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে! মজনু কীভাবে ভিক্টিমকে অজ্ঞান করলেন, এটা ভেবেই তারা অর্গাজমের সুখ লাভ করে ফেলছে। এই শুকরের ছানাগুলোকে (গালি ব্যবহার করায় বিন্দুমাত্র অনুতাপ নেই) জেলখানায় মজনুর সাথে একই সেলে রাখা দরকার, ধর্ষনের মতো জঘন্য ঘটনাও এদের কাছে গোপন তৃপ্তির ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়! 

আমাদের মধ্যে খুব বড়সড় সমস্যা আছে। জঙ্গী নিব্রাস যখন অস্ত্র হাতে নিয়ে হোলি আর্টিজানে গুণে গুণে মানুষ মেরেছিল, তখন কেউ কেউ তার ওপরে 'ক্রাশ' খেয়েছিল, এত সুন্দর ছেলে জঙ্গী হতে পারে কীনা, এমন প্রশ্ন তুলেছিল! যেন কেউ দেখতে ভালো হলে তার মনটাও ফুলের মতো পবিত্র হবে! এখন আবার মজনুকে ধর্ষক হিসেবে মেনে নিতে অনেকের আপত্তি। যেন পাঁচ ফুট চার ইঞ্জি উচ্চতার একটা লোক কাউকে ধর্ষন করার ক্ষমতা রাখে না, ধর্ষন করতে হলে ছয়ফুট চওড়া আর ছাপ্পান ইঞ্চি সিনা বিশিষ্ট হতে হবে! এই অসুস্থ মানসিকতার লোকগুলো আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, একই বাতাসে আমরা শ্বাস নিচ্ছি, এটা ভাবতেই অস্বস্তি লাগছে প্রচণ্ড। 


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা