জিবরিল ছিলেন লিবিয়ার সবচেয়ে কম ডিভাইসিভ পলিটিশিয়ান। এবং তার জীবনের শেষ বছর পর্যন্ত তিনি সংলাপের জন্য কাজ করে গেছেন।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন লিবিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিল। সপ্তাহ দুয়েক আগেই তার আক্রান্তের সংবাদ এসেছিল। কাল কায়রোর একটা হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সম্ভবত এখন পর্যন্ত মারা যাওয়া সবেচয়ে হাই প্রোফাইল ব্যক্তি তিনি।

মাহমুদ জিবরিল ছিলেন ২০১১ সালে লিবিয়ার যুদ্ধকালীন অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী। ইকোনমিক্স এবং পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক মাহমুদ জিবরিল ছিলেন লিবিয়ার সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক রাষ্ট্রে তিনি লিডারশিপ ট্রেনিং প্রোগ্রামের ম্যানেজমেন্ট এবং অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের দায়িত্বে ছিলেন।

২০০৭ সাল থেকে লিবিয়া যে অর্থনৈতিকভাবে সফল হতে শুরু করেছিল, তার পেছনেও মূল অবদান ছিল মাহমুদ জিবরিলের। কারণ এ সময় তিনিই ছিলেন লিবিয়ার ন্যাশনাল প্ল্যানিং কাউন্সিল এবং ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের প্রধান। একইসাথে তিনি ছিলেন গাদ্দাফীর ছেলে এবং বলতে গেলে সে সময় লিবিয়ার ডিফ্যাক্টো লিডার সাইফ আল-ইসলামের উপদেষ্টা।

২০১১ সালে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পরপরই অন্য অনেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার মতো মাহমুদ জিবরিলও বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতাদের সাথে সুসম্পর্কের সুবাদে তিনিই হয়ে ওঠেন বিদ্রোহীদের প্রতিনিধি সংগঠন এনটিসির ডিফ্যাক্টো পররাষ্ট্রমন্ত্রী - বিদেশীদের সাথে এনটিসির যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম।

সারকোজি এবং হিলারির সাথে মিটিংয়ে মাহমুদ জিবরিলই মূলত তাদেরকে আশ্বাস দেন, গাদ্দাফীর পতন হলেও লিবিয়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে না, খুব দ্রুতই ট্র্যাকে ফিরে আসবে। তার সাথে মিটিংয়ের পরেই হিলারি বিদ্রোহীদেরকে সাহায্য করার ব্যাপারে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাহমুদ জিবরীল ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি শুধুমাত্র অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরই প্রধানমন্ত্রী। যুদ্ধ শেষ হলেই তিনি পদত্যাগ করবেন। তিনি কথা রেখেছিলেন। ২০ অক্টোবর গাদ্দাফির মৃত্যুের তিন দিন পর, ২৩ অক্টোবর তিনি পদত্যাগ করেন।

যুদ্ধ শেষে মাহমুদ জিবরিল দ্রুত নির্বাচনের পক্ষপাতী ছিলেন না। তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানতেন, সংকটের পরপরই নির্বাচন সমস্যার সমাধান আনতে পারবে না। তিনি এনটিসিকে ক্ষমতায় রেখেই আলোচনা এবং বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সমঝোতার উপর গুরুত্ব দিচ্ছিলেন। কিন্তু তার প্রধান প্রতিপক্ষ, ইসলামপন্থীদের পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। মিশর এবং তিউনিসিয়ায় মুসলিম ব্রাদারহুডকে জয়লাভ করতে দেখে তারা আশা করে লিবিয়াতেও তারা সহজেই জয় পাবে। ফলে তারা যুদ্ধ শেষে, কোনো ন্যাশনাল কনফারেন্স ছাড়াই, মিলিশিয়াদের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়া অস্ত্র উদ্ধার করা ছাড়াই, মাত্র আট মাসের মাথায় নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে অনড় থাকে।

নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বরাদ্দ ছিল ৮০টি আসন। রাজনৈতিক দল বলতে ছিল একমাত্র মুসলিম ব্রাদারহুড, তার বিপরীতে তড়িঘড়ি করে গজিয়ে ওঠা কয়েক ডজন দল, যাদের নাম এর আগে কেউ কখনো শোনেনি। এদের মধ্যেই একটা ছিল মাহমুদ জিবরিলের নতুন প্রতিষ্ঠিত দল - তাহালুফ আল-কুওয়া আল-ওয়াতানিয়া - ন্যাশনাল ফোর্সেস অ্যালায়েন্স (এনএফএ)।

ন্যাশনাল ফোর্সেস অ্যালায়েন্সকে কেউ চিনত না। কিন্তু মাহমুদ জিবরিলকে সবাই একনামে চিনত। যুদ্ধ চলাকালীন সময় থেকেই অন্য সব নেতা যেখানে খামখেয়ালি, আক্রমণাত্মক, ঘৃণামূলক বক্তব্য দিত, তখন থেকেই মাহমুদ জিবরিলের বক্তব্যের মধ্যে ছিল পরিমিতিবোধ, সমঝোতার আহ্বান।

২১ আগস্ট বিদ্রোহীরা যখন দলে দলে ত্রিপোলিতে প্রবেশ করছিল, মাহমুদ জিবরিল তখন টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে বিদ্রোহীদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন কারো সাথে খারাপ ব্যবহার না করা হয়, যেন বন্দীদের সাথে দুর্ব্যবহার না করা হয়।

যুদ্ধ শেষে ইসলামপন্থীরা যখন ছিল প্রতিশোধ গ্রহণে উন্মত্ত, মিসরাতীরা যখন সম্পূর্ণ বিনা কারণে বানিওয়ালিদ আক্রমণ করে ১ লাখ মানুষকে শহর ছাড়া করেছিল, তখন মাহমুদ জিবরিল ডাক দিচ্ছিলেন সমঝোতার - গাদ্দাফির পক্ষের মানুষদের সাথে সমঝোতার, তাদেরকে সাথে নিয়ে দেশ গড়ার উদ্যোগ নেওয়ার।

জীবনের শেষ বছর পর্যন্ত তিনি সংলাপের জন্য কাজ করে গেছেন

তার এই উদারপন্থী নীতির পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন। যেখানে মিশরে এবং তিউনিসিয়ায় মুসলিম ব্রাদারহুড জয়ী হয়েছিল, সেখানে লিবিয়ার প্রথম নির্বাচনে, যেটাকে সবাই সুষ্ঠু বলে স্বীকার করে, সেখানে তার দল একাই ভোট পেয়েছিল ৪৯%। বিপরীতে মুসলিম ব্রাদারহুড পেয়েছিল মাত্র ১০% ভোট। মানুষ তার দলকে ভোট দেয়নি। তার দলকে কেউ চিনত না। মানুষ ভোট দিয়েছিল একজন মাহমুদ জিবরিলকে।

কিন্তু তার এই জয় শেষপর্যন্ত কাজে লাগেনি। কাজে লাগতে দেওয়া হয়নি। জনগণের মধ্যে এককভাবে তার জনপ্রিয়তা বেশি হলেও সংসদে মাত্র ১০০-২০০ ভোটারের ভোট পাওয়া এমপিরাও তার বিরুদ্ধে একজোট হয়ে তার প্রধানমন্ত্রীত্বের পথ বন্ধ করে দেয়। তার বিরুদ্ধে একজোট হয় সবই - মুসলিম ব্রাদারহুড নেতারা, আল-কায়েদাপন্থী জিহাদীরা, ইন্ডিপেন্ডেন্ট সালাফিরা - সবাই। তাদের অভিযোগ প্রধানত দুইটা - মাহমুদ জিবরীল সেক্যুলার এবং গাদ্দাফীপন্থী।

গাদ্দাফীপন্থী কেউ যেন নতুন লিবিয়াতে স্থান না পায়, যেন মহান বিপ্লবের চেতনা সমুন্নত রাখা যায়, সেজন্য ইসলামপন্থীরা একজোট হয়ে নতুন একটা আইন প্রস্তাব করে - পলিটিক্যাল আইসোলেশ ল। এই আইন অনুযায়ী গাদ্দাফীর আমলে যেকোনো পদে ছিল - এরকম যেকোনো ব্যক্তিকে নতুন লিবিয়ার যেকোনো সরকারি পদের দায়িত্ব থেকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

বলাই বাহুল্য, এই আইনের প্রধান টার্গেট ছিল মাহমুদ জিবরিল এবং তার দলের লোকেরা। সশস্ত্র ইসলামপন্থী মিলিশিয়ারা সংসদ ঘেরাও করে, ফাঁকা গোলাগুলি করে সংসদকে এই আইন পাশ করাতে বাধ্য করে।

গাদ্দাফীর পতনের পর লিবিয়া কেন সফল হতে পারেনি, তার অনেকগুলো কারণ দেখানো যায়। কিন্তু লিবিয়া বিষয়ক প্রায় সব বিশেষজ্ঞ - ফ্রেডেরিক ওয়েহরি, জালাল হার্শাওই, ঔলফার্ম ল্যাখার - সবাই একবাক্যে এর পেছনে দুইটা প্রধান কারণকে চিহ্ণিত করেন। এক, তড়িঘড়ি করে নির্বাচন দেওয়া। এবং দুই, পলিটিক্যাল আইসোলেশন ল' পাশ করা। এবং এই দুইটাই করেছিল ইসলামপন্থীরা, শুধুমাত্র মাহমুদ জিবরিলের জনপ্রিয়তার ভয়ে।

পলিটিক্যাল আইসোলেশন ল'কে অনেকে ইরাকের ডিবাথিফিকেশনের সাথেও তুলনা করেন। ইরাকে মার্কিন গভর্নর পল ব্রেমার কলমের এক খোঁচায় ছয় লাখ বাথ পার্টির সদস্যকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। ফলে নতুন ইরাকে তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। বাধ্য হয়ে তাদের অনেকেই অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল।

একই ঘটনা ঘটেছিল লিবিয়াতেও। যেসব নেতারা, যেসব টেকনোক্র্যাটরা লিবিয়াকে নতুন করে গড়ে তুলতে পারত, তাদেরকে নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে তাদেরকেও বাধ্য করা হয়েছিল বিকল্প পথের সন্ধান করতে। ইরাকে যে কাজটা করেছিল আমেরিকা, লিবিয়াতে সেই একই কাজ করেছিল ইসলামপন্থীরা।

পলিটিক্যাল আইসোলেশনের পর মাহমুদ জিবরিলও নতুন পথের সন্ধান শুরু করেন। তিনি স্পষ্টতই সে সময় উদীয়মান সম্ভাব্য নতুন শক্তি জেনারেল হাফতারের দিকে ঝুঁকে পড়েন। হাফতার যখন বেনগাজিতে অভিযান শুরু, জিনতানি বাহিনী যখন ত্রিপোলি আক্রমণ করে, মাহমুদ জিবরিল তাতে সমর্থন দেন।

গত ছয় বছর ধরে মাহমুদ জিবরিল মোটামুটি নির্বাসনেই ছিলেন। তার তেমন কোনো অ্যাকটিভি চোখে পড়েনি। মাঝেমাঝে তিনি বিভিন্ন ফোরামে, আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু তার আগের মতো প্রভাব ছিলও না। প্রথম নির্বাচনে লিবিয়ানরা যেরকম উৎসাহের সাথে তাকে ভোট দিয়েছিল, সেটা ব্যর্থ হওয়ার পর মানুষ নির্বাচনের উপরই আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল।

নতুন করে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের লিবিয়াতে যেখানে একদিকে ইসলামপন্থীরা, অন্যদিকে একাই সকল ক্ষমতা ভোগ করতে ইচ্ছুক জেনারেল হাফতার, সেখানে মাহমুদ জিবরিলের কোনো ভবিষ্যত ছিল না। কিন্তু তারপরেও তিনি সব সময়ই সমঝোতার কথা বলে গেছেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও তিনি ত্রিপোলির যুদ্ধ বন্ধ করে সেফ জোন ঘোষণা করে ন্যাশনাল কনফারেন্সের আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন।

সাংবাদিক সামের আতরাশের ভাষায়, জিবরিল ছিলেন সম্ভবত লিবিয়ার সবচেয়ে কম ডিভাইসিভ পলিটিশিয়ান। এবং তার জীবনের শেষ বছর পর্যন্ত তিনি সংলাপের জন্য কাজ করে গেছেন।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা