'আমি হিন্দু-মুসলমান দেখিনি কোথাও, আমি মানুষ দেখেছি...'
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
সাম্প্রদায়িক সহিংসতার এই ভয়ংকর সময়টাতে এভাবেই আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখেন মহিন্দর-ইন্দরজিতেরা। তাদের জন্যেই হয়তো দিন শেষে এত হানাহানির মাঝেও ভাতৃত্ববোধ জিতে যায়...
'মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য'- কথাটা নাকি এখন কাগজ-কলমের বাইরে দেখতে পাওয়া যায় না কোথাও। এরকমটা যারা বলেন, তাদের একবার দিল্লির প্রেমকান্ত বাঘেলের গল্পটা শোনা উচিত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লাগানো আগুন থেকে যিনি নিজের জীবন বাজী রেখে ছয়জন মুসলমানকে উদ্ধার করে এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। তাদেরকে শোনানো উচিত পুরনো দিল্লির মুস্তফাবাদের মুসলমানদের গল্পটাও। মসজিদ পুড়েছে দাঙ্গার আগুনে, কিন্ত দল বেঁধে তারা পাহারা দিচ্ছেন এলাকার মন্দিরটাকে, যাতে প্রতিশোধ নিতে এসে কেউ মন্দির ভাঙতে না পারে!
দিল্লির শিখ ধর্মাবলম্বীরা আক্রান্ত মুসলমানের জন্যে খুলে দিয়েছে গুরদ্বার, খ্রিস্টানরাও খুলেছে চার্চের দরজা। দলিত হিন্দুরা পাহারা দিচ্ছে পাড়া, যাতে মুসলমানদের ওপর হামলা করতে না পারে কেউ। এরকমই আরও একটা গল্পের জন্ম দিয়েছেন উত্তর-পূর্ব দিল্লির বাসিন্দা মহিন্দর সিং এবং তার ছেলে ইন্দরজিত সিং। দুজনে মিলে জীবন বাজী রেখে দাঙ্গার সময় নিজেদের এলাকায় আটকে পড়া প্রায় ৭০-৮০ জন মুসলমানকে নিরাপদে মুসলমান পাড়ায় দিয়ে এসেছেন, যাতে এই হানাহানির সময়টায় তাদের কোন ক্ষতি না হতে পারে!
ঘটনাটা ২৪শে ফেব্রুয়ারীর। দিল্লি তখন অগ্নিগর্ভ, হিন্দুত্ববাদের ঢেউ আছড়ে পড়ছে দিল্লির আনাচে কানাচে। মুসলমানদের ঘর-বাড়ি আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেছে বেছে ভাঙচুর চালানো হচ্ছে, রাস্তায় মুসলমান কারো পরিচয় পেলেই দাঙ্গাবাজেরা ধরে পিটুনি দিচ্ছে, প্রাণও হারাচ্ছে অনেকে। মুসলমানেরাও পাল্টা আক্রমণ করছে কোথাও, হিন্দু-মুসলিমের সংঘর্ষের এই ভয়াল রূপ দিল্লির মানুষ কখনোই দেখেনি, শোনেওনি।
২৪ তারিখ বিকেলের দিকে উন্মত্ত দাঙ্গাবাজদের ভীড় এসে হানা দেয় গোকলপুরি এলাকায়, প্রায় হাজারখানেক লোক ছিল সেখানে। 'জয় শ্রীরাম' শ্লোগানে তারা প্রকম্পিত করে তুলছিল এলাকা, সেই সঙ্গে ছিল আরেকটা শ্লোগান- 'দেশ কে গাদ্দারো কো, গোলি মারো সালো কো!' তাদের চোখে মুসলমানেরা হচ্ছে ভারতের জন্যে গাদ্দার, তাই মুসলমানদের সমূলে শেষ করে দিতে হবে। গোকলপুরিতে সব মিলিয়ে ৭০/৮০ জন মুসলমানের বাস, তারা ভয়ে আশ্রয় নিলো মসজিদে, এলাকার অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লোকজন অবস্থান নিলো সেই মসজিদের সামনে, যাতে দাঙ্গাবাজদের প্রতিহত করা যায়।
কিন্ত মসজিদ ভাঙতে আসা অমানুষদের তুলনায় মানুষের সংখ্যা ছিল কম। তাদের সঙ্গে বেশিক্ষণ পারা যাবে না বুঝতে পেরেই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, মসজিদের পেছনের রাস্তা দিয়ে আটকে পড়া মুসলমানদের অন্য এলাকায় সরিয়ে নেয়া হবে। কাছেই কর্দমপুরি নামে একটা পাড়া আছে, সেখানে প্রচুর মুসলমান থাকেন। হিন্দু দাঙ্গাবাজেরা সেই এলাকা পর্যন্ত যাবে না। আটকে পড়া মুসলমানদের কর্দমপুরি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারলেই প্রাণে বেঁচে যাবে সবাই। নইলে মসজিদ আর মানুষ, কাউকেই হয়তো বাঁচানো যাবে না আর।
গোকলপুরি থেকে কর্দমপুরি পর্যন্ত হেঁটে যেতে লাগে দশ মিনিট, কিন্ত যেতে হবে দাঙ্গাবাজদের চোখের ওপর দিয়েই। সেটা কি করে সম্ভব? তার ওপরে আটকে পড়াদের মধ্যে বেশিরভাগই মহিলা ও শিশু! এগিয়ে এলেন মহিন্দর সিং, তার সঙ্গে ছেলে ইন্দরজিত সিং। বাপ-বেটা মিলে গ্যারেজ থেকে বের করলেন তাদের মোটর সাইকেল দুটো। চুরাশির শিখ বিরোধী দাঙ্গার ভুক্তভোগী ছিলেন মহিন্দর, তিনি জানেন ধর্মীয় বিদ্বেষের আগুণ কী করতে পারে! মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিলেন তিনি, সামনে দুটো বাচ্চাকে নিলেন, পেছনে উঠলেন তাদের মা। ভদ্রমহিলাকে বোরখা ফেলে দিতে বললেন মহিন্দর, প্রাণ বাঁচানোর জন্যে এই মুহূর্তে পর্দা না করলেও চলবে। বোরখা দেখলেই মুসলমান হিসেবে চিনে ফেলতে সময় লাগবে না কারো।
এক ঘন্টার মধ্যে সব মুসলমানকে কর্দমপুরিতে রেখে এলেন মহিন্দর ও ইন্দরজিত। যেসব শিশু আর পুরুষদের মোটরসাইকেলে চড়িয়ে পার করেছেন, তাদের সবাইকে শিখদের পাগড়ি পরিয়ে দিয়েছিলেন তারা, কারণ দাঙ্গাটা হিন্দু-মুসলমানের, শিখদের কোন ভয় নেই এখানে। শিখ ধর্মাবলম্বীকে হিন্দুও মারবে না, মুসলমানও আটকাবে না। মহিন্দর পরে সেই সময়ের কথা মনে করতে গিয়ে বলেছেন- 'আমি তখন হিন্দু-মুসলমান দেখিনি কোথাও, আমি দেখেছি মানুষ বিপদে পড়েছে, তাকে বাঁচানোটা আমার কর্তব্য ছিল।'
সবাইকে কর্দমপুরিতে নিরাপদে রেখে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতেই মহিন্দর দেখলেন, সাম্প্রদায়িকতার আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে এলাকার দোকান-পাট, মুসলমানদের বাড়িঘর। মহিন্দর চেষ্টা করেছিলেন দাঙ্গাবাজদের রুখে দেয়ার, পারেননি, আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচাতে পারেননি প্রতিবেশীদের সম্পদ। কিন্ত নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৭০/৮০ জন নিরপরাধ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছেন, এই অমূল্য অর্জনটাই তো মহিন্দর আর ইন্দরজিতের নামের পাশে লেখা হয়ে গেছে!
'কোথায় স্বর্গ? কোথায় নরক? কে বলে তা বহুদূর? মানুষের মাঝেই স্বর্গ-নরক মানুষেতে সুরাসুর...' - শেখ ফজলুল করিম লিখেছিলেন লাইনগুলো। ক্রমশ অস্থিরতা আর হানাহানির সময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা, মানুষের মধ্যে থেকে মনুষ্যত্ব আর মানবতাবোধ ব্যাপারগুলো উঠে যাচ্ছে দিনদিন। ধর্মের নামে প্রাণ যাচ্ছে নিরীহ মানুষের, সম্পত্তি জ্বলছে। সেই ভয়ংকর সময়টাতে এভাবেই আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখেন মহিন্দর-ইন্দরজিতেরা। তাদের জন্যেই হয়তো দিন শেষে এত হানাহানির মাঝেও ভাতৃত্ববোধ জিতে যায়...