খাদ্যে ভেজার রোধ করার জন্য নিজেকে উজাড় করে কাজ করেছেন, রেল মন্ত্রণালয়ে এসে রেলকে ঢেলে সাজাচ্ছিলেন, সেই মানুষটাকেই তার ট্র্যাক থেকে সরিয়ে দুর্নীতিবাজ আর সিন্ডিকেটের লোকজন প্রমাণ করলেন, তারা কতটা শক্তিশালী!
এইতো, কয়েকদিন আগেই তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, মাত্র দশজন সৎ কর্মকর্তা নিয়ে একটা টিম গড়ে দেয়া হোক তাকে, যে কোন মন্ত্রণালয়ের, যে কোন অধিদপ্তরের অচলাবস্থা কাটিয়ে, সিন্ডিকেট ভেঙে কাজের পরিবেশ তৈরি করবেন তিনি। কিছুদিন পরেই নিজের মন্ত্রণালয়ের (রেল) প্রায় পনেরো হাজার নিয়োগ হবার কথা আছে সামনে, সেই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শতভাগ স্বচ্ছতা বজায় রাখার আশ্বাসও দিয়েছিলেন তিনি। এসব 'অচলাবস্থা কাটানো', 'সিন্ডিকেট ভাঙা', 'স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখা'- এসবের জন্য অন্যান্য দেশে কর্মকর্তারা পুরস্কৃত হন, তবে বাংলাদেশে হলে ভিন্ন ব্যাপার। গতকালই যেমন অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হয়ে সততার পুরস্কারটা পেলেন!
মাহবুব কবির মিলনের ওপর শাস্তির খড়্গ যে নেমে আসতে যাচ্ছে, সেটা বোঝা যাচ্ছিল গত দুই তিনদিন ধরে। তবুও তিনি যখন ফেসবুকে নিজের ওএসডি হবার খবরটা শেয়ার করেছেন, অজস্র মানুষ আকাশ থেকে পড়েছেন। যে মানুষটা নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরে গিয়ে সেখানকার চেহারা বদলে দিয়েছিলেন, খাদ্যে ভেজার রোধ করার জন্য নিজেকে উজাড় করে কাজ করেছেন, যিনি রেল মন্ত্রণালয়ে এসে রেলকে ঢেলে সাজাচ্ছিলেন, টিকেট চোরাকারবারি বন্ধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, সেই মানুষটাকেই তার ট্র্যাক থেকে সরিয়ে দেয়া হলো এবার! অসৎ এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেটটা যে কত শক্তিশালী, সেটাই যেন প্রমাণ হলো এই ঘটনায়।
এইতো, মাত্র পাঁচ মাস আগেই তাকে নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। তার অপরাধ, গত কয়েক বছরে নিজের অবস্থান থেকে তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টাটা চালিয়েছেন, খাদ্যে ভেজাল দেয়া নানা প্রতিষ্ঠানকে করেছেন বিচারের মুখোমুখি। খাবারে যারা ভেজাল মেশায়, তাদের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধই ঘোষণা করেছিলেন মাহবুব কবির মিলন, সেই যুদ্ধটা ক্রুসেডের চেয়ে কম কিছু ছিল না। কিন্ত ভালো কাজ করলে এই দেশে চক্ষুশূল হতে হয় অনেকের। মিলন ভাইয়ের বেলাতেও সেটাই ঘটেছে।
মানুষ এবং পশুর খাদ্যে ব্যবহৃত বিপজ্জনক রাসায়নিকের আমদানি রোধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তিনি, অস্বাস্থ্যকর হোটেল আর রেস্তোরাঁগুলোতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করেছেন, সেবার মান অনুযায়ী সেগুলোকে গ্রেডিং সিস্টেমের আওতায় আনার কাজ করেছেন। শুধু তাই নয়, একটা সময়ে ফলমূলে ফরমালিনের ব্যবহার ছিল নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা, মাহবুব কবির মিলনের প্রচেষ্টাতেই সেটা থেমেছে, দেশে ফরমালিনের অবৈধ আমদানি বন্ধ করায় তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি এখন গর্ব করেই বলেন, আপনারা নিশ্চিন্তে ফল খেতে পারেন, বাংলাদেশের কোন ফলেই এখন আর ফরমালিন ব্যবহার হয় না।
নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর থেকে রেলওয়েতে এলেন, রেল নিয়ে তার মধ্যে একটা আবেগের জায়গা ছিল অনেক আগে থেকেই। রেল মন্ত্রণালয়ের লোক না হয়েও রেলের জন্য কাজ করতে চেয়েছেন সবসময়। এবার যেন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলেন, আর ফিরেই শুরু করলেন অ্যাকশন। টিকেট কালোবাজারি ঠেকাতে ন্যাশনাল আইডি কার্ড দিয়ে টিকেট কাটা এবং ভ্রমণের সময় সেই আইডি কার্ডধারী ব্যক্তি ও আইডি সঙ্গে রাখা বাধ্যতামূলক করা হলো। ভ্রমণের সময় প্রতিটি ব্যক্তির (যার নামে টিকেট কেনা হয়েছে) পরিচয় নিশ্চিত করর উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে করে কালোবাজারিদের হাতে টিকেট যাওয়ার নেমে এসেছে শূন্যের কাছাকাছিতে।
করোনাকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে, অনেকগুলোর স্বপক্ষে তো প্রমাণও আছে। সরকারী কর্মকর্তাদের একটা বড় অংশ কাজ করতে চান না, অধিদপ্তরগুলো ঝিমিয়ে পড়ে থাকে, এসব অভিযোগ পুরনো। কিছুদিন আগেই মাহবুব কবির মিলন এসব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, মাত্র দশজন সৎ, কর্মঠ কর্মকর্তাই পারে একটা দপ্তরের চেহারা পাল্টে দিতে। ফেসবুকে তিনি লিখেছিলেন-
"আমি যদি প্রধানমন্ত্রীকে পেতাম তবে বলতাম, স্যার আমাকে ১০ জন অফিসার দিন। এদের আমি চুজ করব, এদের নিয়ে আমি একটা উইং করব। মানুষের চোখের পানি দূর করার জন্য সব মন্ত্রণালয়, সব দফতর, সব অধিদফতরের বিষয়গুলো অ্যাড্রেস করব আমরা এই ১০ জন।
কেউ যদি বলে আমরা দুর্নীতি দূর করতে পারব না, কেউ যদি বলে সিন্ডিকেট ভাঙা যায় না, আমি ওটারই চ্যালেঞ্জ দিয়েছি— আমার তিন মাস সময়ই যথেষ্ট, যেকোনো ডিপার্টমেন্টের সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য। এনাফ টাইম। দেশের অনেক ডেভেলপমেন্ট আনা যাবে, অনেক পরিবর্তন আনা যাবে। পারা যায়, আমরা পারবই। করতে না পারলে যেকোনো শাস্তি মাথা পেতে নেব। এটা আমার খুব ইচ্ছা।
তবে আমাদের স্বাধীনতা দিতে হবে, জবাবদিহিতা থাকবে একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে। অন্য কারও কাছে নয়। কেন এই কথাটা বলছি- নানা পারিপার্শ্বিকতা আমাদের কাজ করতে দেয় না। নানা কারণে করতে দেয়া হয় না। সেখানে আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে, সেখানে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। আমি একটা ১০ জনের প্রতীকী রূপরেখা দিয়েছি। এটা ১৫ জন হতে পারে। অনেক ডেডিকেটেড ছেলে আছে সরকারি চাকরিতে। দশটা সৎ ডেডিকেটেড মানুষকে যদি স্বাধীনতা দেয়া হয় তারা ১০ হাজার জনের কাজ করতে পারবে।"
যে চ্যালেঞ্জটা মাহবুব কবির মিলন নিতে চেয়েছিলেন, সেটা তো তাকে দেয়া হলোই না, বরং সৎভাবে কাজ করতে চাওয়ার পুরস্কার তিনি পেলেন বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি হয়ে। একজন সরকারী অফিসারকে ওএসডি করা হয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে। মাহবুব কবির মিলন কি অপরাধ করেছেন? চুরি করেছেন? ঘুষ নিয়েছেন? নিজের পদের প্রভাব খাটিয়ে কাউকে অন্যায় সুবিধা দিয়েছেন?
যে মানুষটা নিজের দপ্তরে সরকারী নিয়োগের সময় নিজের আত্মীয় বা এলাকার মানুষকেও জানান না, যাতে কেউ তার কাছে তদবির নিয়ে আসতে না পারেন, সেই লোকটাকে ওএসডি করে তরুণ সরকারী কর্মকর্তাদের কি বার্তা দিতে চাইলো সিনিয়ররা? এদেশে সৎ থাকা, সততার সঙ্গে মানুষের জন্য কাজ করতে চাওয়া অপরাধ- এইতো? হয় তুমি সিন্ডিকেট আর এই বাজে সিস্টেমের অংশ হয়ে থাকো, আর থাকতে না চাইলে ভুক্তভোগী হও- এটাই তাহলে নিয়ম? টেকনাফের যে ওসি ক্রসফায়ারটাকে ডালভাত বানিতে ফেলেন, তাকে 'বীরত্বের' জন্য পুরস্কৃত করা হয়, আর মাহবুব কবির মিলন সততার সঙ্গে কাজ করতে চাইলে তাকে করা হয় ওএসডি- এটা কিরকম কৌতুক?
মাহবুব কবির মিলন নামের মানুষটাকে আমার কাছে মনে হয় সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো একজন। একুশ বছরের আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে আসা সুকান্ত চেয়েছিলেন নবজাতকের জন্যে পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করে যেতে। আর মাহবুব কবীর মিলন চান নতুন প্রজন্মের জন্যে এই দেশটাকে বসবাসের যোগ্য করে তুলতে। যে দেশে খাদ্যে ভেজাল বলে কোন জিনিস থাকবে না, খাবার নিয়ে কেউ দুই নম্বুরী করতে পারবে না, রেলের টিকেট জনগন ন্যায্য দামে পাবে, কোন দুই নম্বুরী হবে না, এদেশের সবগুলো সরকারী দপ্তর-অধিদপ্তর-মন্ত্রণালয় শুধু জনগনের সেবার জন্য কাজ করবে, সরকারী কর্মকর্তারা দেশের প্রভু নন, জনগনের সেবক হবেন, থাকবে না কোন সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। কিন্ত আফসোস শুধু একটাই, দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে অসম লড়াইটাতে মাহবুব কবির মিলনদের মতো মানুষেরা বড্ড একা হয়ে যান, হেরে যান ধীরে ধীরে। সঙ্গে হেরে যায় পুরো বাংলাদেশও।
মানুষের জন্যে সৎভাবে কেউ কাজ করতে চাইলে যে দেশে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়, সেই দেশটার নাম বাংলাদেশ! দুদকের মুনির চৌধুরী, সাবেক এয়ারপোর্ট ম্যাজিস্ট্রেট বানসুরি মোহাম্মদ ইউসুফেরা তার জ্বলন্ত উদাহরণ, সেই তালিকায় মাহবুব কবির মিলনের নামটাও উচ্চারিত হবে বারবার। অপরাধীদের চোখে তিনি ঘাড়ত্যাড়া, তাকে লোভ দেখিয়ে দলে আনা যায় না, বরং তিনি সিন্ডিকেট আর অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, এই লোক তো দুর্নীতিবাজদের জন্য সাক্ষাৎ যম। তাই তাকে ছেঁটে ফেলার মিশনে নেমেছে দুর্বৃত্তের দল। উচ্চপদস্থ লোকজনও তাদেরই দলে, তাই জনগনের কথা ভাবার কেউ নেই।
আর এভাবেই জনগন বনাম দুর্নীতিবাজদের লড়াইটাতে জনগনের হার হচ্ছে, সততা হেরে যাচ্ছে বিশাল ব্যবধানে, সবকিছু চলে গেছে নষ্টদের অধিকারে। নিশ্চিত করেই বলতে পারি, প্রশাসনের সৎ এই কর্মকর্তার এমন নাস্তানাবুদ হওয়ার দৃশ্য দেখার পরে কেউ আর কোনোদিন মাহবুব কবির মিলন হতেও চাইবেন না, জনগনের উপকার করতে গিয়ে নিজের বুকে গুলি খাওয়ার স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দেবেন অনেকেই...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন