সরকারী চাকুরীতে বদলি থাকবেই। কোন পদে কেউই চিরস্থায়ী নন, ভালো কাজ করুন কিংবা খারাপ- বদলি, পদোন্নতি, এগুলো সরকারী চাকরিজীবীদের পেশাজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাহলে মাহবুব কবির মিলনের বদলি নিয়ে কেন এত কথা বলছি? কেন ষড়যন্ত্রের প্রসঙ্গ আসছে?

যেমনটা ধারণা করা হয়েছিল, সেটাই ঘটলো। নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক মাহবুব কবির মিলনকে সরিয়ে দেয়া হলো খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে, অতিরিক্ত সচিব হিসেবে তাকে বদলি করা হয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে। নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর থেকে উদ্যমী এবং সৎ এই মানুষটাকে সরানোর জন্যে যে ষড়যন্ত্রের নীল নকশা বোনা হয়েছিল, সেটাই হয়তো পূর্ণতা পেলো আজ।

সরকারী চাকুরীতে বদলি থাকবেই। কোন পদে কেউই চিরস্থায়ী নন, ভালো কাজ করুন কিংবা খারাপ- বদলি, পদোন্নতি, এগুলো সরকারী চাকরিজীবীদের পেশাজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাহলে মাহবুব কবির মিলনের বদলি নিয়ে কেন এত কথা বলছি? কেন ষড়যন্ত্রের প্রসঙ্গ আসছে?

ষড়যন্ত্রের কথা আসছে, কারণ খাবারে যারা ভেজাল মেশায়, তাদের কাছে মাহবুব কবীর মিলন ছিলেন যমের আরেক নাম। খাবারে ভেজাল রোধে গত কয়েক বছরে নিজের অবস্থান থেকে তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টাটা চালিয়েছেন, খাদ্যে ভেজাল দেয়া নানা প্রতিষ্ঠানকে করেছেন বিচারের মুখোমুখি। এই অমানুষদের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধই ঘোষণা করেছিলেন মাহবুব কবির মিলন, সেই যুদ্ধটা ক্রুসেডের চেয়ে কম কিছু ছিল না। কিন্ত ভালো কাজ করলে এই দেশে চক্ষুশূল হতে হয় অনেকের। মিলন ভাইয়ের বেলাতেও সেটাই ঘটেছে। 

যাদের বিরুদ্ধে মাহবুব কবির মিলন লড়ছিলেন, তারা হচ্ছে গোলিয়াথের মতো দানব, বিশাল বড় সিন্ডিকেট। তাদের সামনে মানুষটা ডেভিডের মতোই সাহস করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন। লোকবল নেই, ক্ষমতা নেই, তবুও তিনি এক প্রকার অসাধ্য সাধন করেছেন সততা আর মনের জোরে। ষড়যন্ত্র হয়েছে, তাকে নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর থেকে সরিয়ে দিতে পারলে জনগন নিরাপদে থাকুক না থাকুক, খাবারে যারা ভেজাল মিশিয়ে কোটি কোটি টাকা লুটে নেয়, তাদের নিরাপত্তা তো নিশ্চিত হবে! সেটাই হচ্ছে এখন। 

বেসরকারি ভোক্তা অধিকার সংস্থা ‘কনসাস কনজুমার্স সোসাইটি’ (সিসিএস) এর নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ কিছুদিন আগেই ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, সেটা পড়লেই আপনারা বুঝতে পারবেন, কেন মাহবুব কবির মিলনের এই বদলিটা স্বাভাবিক নয়, কেন বারবার ষড়যন্ত্র শব্দটা ব্যবহার করছি আমরা। আপনাদের জন্যে সেই স্ট্যাটাসটা তুলে দেয়া হলো এখানে-

মাহবুব কবির মিলন

মূলত দুটি কারণে চেয়ারম্যানের পদটা কেড়ে নেয়া হচ্ছে মাহবুব কবির মিলনের কাছ থেকে। 

১ নম্বর কারণ- গত ৬ মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি নিষিদ্ধ ‘মিট অ্যান্ড বোন মিল’ (এমবিএম) এর ৪৪টি কনসাইনমেন্ট আটকে দিয়েছে ‘বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ (বিএসএফএ) ও চট্টগ্রাম কাস্টমস। যেখানে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা মূল্যের সাড়ে ৯ হাজার মেট্রিক টন এমবিএম রয়েছে। যার মূল কারিগর ছিলেন কর্তৃপক্ষের বর্তমান চেয়ারম্যান মাহবুব কবির মিলন। এমবিএম পোল্ট্রি ও অন্যান্য প্রাণি খাদ্যে মিশিয়ে বাজারজাত করা হয়। সেখান থেকে এই ‘নিষিদ্ধ বিষ’ আমরা খাই। এই বিষ ছড়িয়ে ছিল গোটা দেশে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান মাহবুব কবির।

চট্টগ্রাম বন্দরে কনসাইনমেন্টগুলো খালাস করার জন্য বহু চেষ্টা হয়েছে। কয়েকজন কোর্টে রিটও করেছে। কিন্তু মাহবুব কবিরদের চেষ্টায় তারা হেরে যায়। এখন তাদের একমাত্র ভরসা মাহবুব কবিরকে সরিয়ে দেয়া। সেই চেষ্টায় তারা আপাতত সফল হয়েছে। মাহবুব কবিরকে চেয়ারম্যান থেকে সরিয়ে সেখানে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের আদেশ হয়েছে।

২. সম্প্রতি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষে জেলায় জেলায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ২০৮ জন জনবল নিয়োগ দিয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ছিলেন মাহবুব কবির। চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের আগে এক ‘বস’ তার কাছে রেজাল্টের তালিকা চেয়েছিলেন। তারা হয়তো কিছু লোকজনের নাম ঢোকাবেন। কিন্তু মাহবুব কবির তাদের কথা না রেখে, দুর্নীতির সুযোগ না দিয়ে পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফল প্রকাশ করে দেন। এতে চটেছেন সেই ‘বস’। ফলে প্রশাসনিক বস আর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের যৌথ চেষ্টায় চেয়ার হারালেন মাহবুব কবির।

কি চমৎকার দেখা গেল, তাই না? প্রথমে মাহবুব কবির মিলনকে পরিচালক পদ থেকে সরানো হয়েছে, এরপর সবাই যখন করোনাভাইরাস নিয়ে ব্যস্ত, দেশ মোটামুটি লকডাউন হয়ে গেছে, সেসবের ভীড়ে তাকে নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর থেকেই সরিয়ে দেয়া হলো। ফেসবুকে বদলির আদেশের একটা ছবি আপলোড করে মাহবুব কবির মিলন লিখেছেন, ‘বদলীর আদেশ পেলাম। অতিরিক্ত সচিব, রেলপথ মন্ত্রণালয়।’ এই একটা লাইনের পেছনে যে কতটা হতাশা আর আক্ষেপ লুকিয়ে আছে, সেটা হয়তো অনেকেই বুঝবেন না। জনগন বনাম দুর্নীতিবাজদের লড়াইটাতে জনগনের হার হয়েছে আজ, সততা হেরে গেছে বিশাল ব্যবধানে, সবকিছু চলে যাচ্ছে নষ্টদের অধিকারে। কে জানে, এরপরে কেউ হয়তো আর মাহবুব কবির মিলন হতেও চাইবেন না, জনগনের উপকার করতে গিয়ে নিজের বুকে গুলি খাওয়ার স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দেবেন অনেকেই... 

রেল নিয়ে মাহবুব কবির মিলনের একটা প্যাশন আছে, রেলের ক্যাটারিং সার্ভিস, বগির অবস্থা, ট্রেনের গতি, স্ট্যান্ডিং টিকেট- এসব নিয়ে এর আগেও তিনি অনেক কাজ করেছেন, জনবান্ধব নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙ্গে, মাহবুব কবির মিলনও রেল মন্ত্রণালয়ে রেলের উন্নয়নের জন্যে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করবেন, যেভাবে তিনি নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের জন্যে করেছিলেন- এই বিশ্বাসটুকু আমাদের আছে।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা