এভাবেই দুর্নীতির কাছে হেরে যায় সততা, নষ্টদের অধিকারে যায় সবকিছু
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মাহবুব কবির মিলন চান নতুন প্রজন্মের জন্যে এই দেশটাকে বসবাসের যোগ্য করে তুলতে। যে দেশে খাদ্যে ভেজাল বলে কোন জিনিস থাকবে না, খাবার নিয়ে কেউ দুই নম্বুরী করতে পারবে না।
বাংলাদেশে সরকারী কর্মকর্তাদের নামে ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রচুর অভিযোগ আছে। জনগনের সেবক হওয়ার পরিবর্তে তারা জনগনের মালিকের মতো আচরণ করেন। কিন্ত এর মধ্যেও গুটিকয়েক সরকারী কর্মকর্তাকে দেখলে মনে হয়, মানুষের উপকার করার জন্যেই বুঝি তারা সরকারী চাকুরীতে এসেছেন। সংখ্যায় তারা হয়তো নগন্য, কিন্ত এই মানুষগুলোর দিকে তাকিয়েই সুন্দর একটা বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা যায়। মাহবুব কবির মিলন নামের মানুষটা তাদেরই একজন। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ছিলেন লিখতে হচ্ছে, কারণ ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে তাকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে চেয়ারম্যানের পদ থেকে, এই দেশের মানুষের জন্যে কাজ করার 'সুফল'টা মাহবুব কবির মিলন পাচ্ছেন হাতেনাতে।
মাহবুব কবির মিলনকে সরিয়ে নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তার অপরাধ, গত কয়েক বছরে নিজের অবস্থান থেকে তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টাটা চালিয়েছেন, খাদ্যে ভেজাল দেয়া নানা প্রতিষ্ঠানকে করেছেন বিচারের মুখোমুখি। খাবারে যারা ভেজাল মেশায়, তাদের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধই ঘোষণা করেছিলেন মাহবুব কবির মিলন, সেই যুদ্ধটা ক্রুসেডের চেয়ে কম কিছু ছিল না। কিন্ত ভালো কাজ করলে এই দেশে চক্ষুশূল হতে হয় অনেকের। মিলন ভাইয়ের বেলাতেও সেটাই ঘটেছে।
মানুষ এবং পশুর খাদ্যে ব্যবহৃত বিপজ্জনক রাসায়নিকের আমদানি রোধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তিনি, অস্বাস্থ্যকর হোটেল আর রেস্তোরাঁগুলোতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করেছেন, সেবার মান অনুযায়ী সেগুলোকে গ্রেডিং সিস্টেমের আওতায় আনার কাজ করেছেন। শুধু তাই নয়, একটা সময়ে ফলমূলে ফরমালিনের ব্যবহার ছিল নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা, মাহবুব কবির মিলনের প্রচেষ্টাতেই সেটা থেমেছে, দেশে ফরমালিনের অবৈধ আমদানি বন্ধ করায় তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি এখন গর্ব করেই বলেন, আপনারা নিশ্চিন্তে ফল খেতে পারেন, বাংলাদেশের কোন ফলেই এখন আর ফরমালিন ব্যবহার হয় না।
যাদের বিরুদ্ধে মাহবুব কবির মিলন লড়ছিলেন, তারা হচ্ছে গোলিয়াথের মতো দানব, বিশাল বড় সিন্ডিকেট। তাদের সামনে মানুষটা ডেভিডের মতোই সাহস করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন। লোকবল নেই, ক্ষমতা নেই, তবুও তিনি এক প্রকার অসাধ্য সাধন করেছেন সততা আর মনের জোরে। ষড়যন্ত্র হয়েছে, তাকে নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর থেকে সরিয়ে দিতে পারলে জনগন নিরাপদে থাকুক না থাকুক, খাবারে যারা ভেজাল মিশিয়ে কোটি কোটি টাকা লুটে নেয়, তাদের নিরাপত্তা তো নিশ্চিত হবে! সেটাই হচ্ছে এখন।
কেন নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের চেয়ারম্যানের পদ সরিয়ে দেয়া হচ্ছে মাহবুব কবির মিলনকে- এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেল। বেসরকারি ভোক্তা অধিকার সংস্থা ‘কনসাস কনজুমার্স সোসাইটি’ (সিসিএস) এর নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ জানালেন, মূলত দুটি কারণে চেয়ারম্যানের পদটা কেড়ে নেয়া হচ্ছে মাহবুব কবির মিলনের কাছ থেকে।
১ নম্বর কারণ- গত ৬ মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি নিষিদ্ধ ‘মিট অ্যান্ড বোন মিল’ (এমবিএম) এর ৪৪টি কনসাইনমেন্ট আটকে দিয়েছে ‘বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ (বিএসএফএ) ও চট্টগ্রাম কাস্টমস। যেখানে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা মূল্যের সাড়ে ৯ হাজার মেট্রিক টন এমবিএম রয়েছে। যার মূল কারিগর ছিলেন কর্তৃপক্ষের বর্তমান চেয়ারম্যান মাহবুব কবির মিলন। এমবিএম পোল্ট্রি ও অন্যান্য প্রাণি খাদ্যে মিশিয়ে বাজারজাত করা হয়। সেখান থেকে এই ‘নিষিদ্ধ বিষ’ আমরা খাই। এই বিষ ছড়িয়ে ছিল গোটা দেশে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান মাহবুব কবির।
চট্টগ্রাম বন্দরে কনসাইনমেন্টগুলো খালাস করার জন্য বহু চেষ্টা হয়েছে। কয়েকজন কোর্টে রিটও করেছে। কিন্তু মাহবুব কবিরদের চেষ্টায় তারা হেরে যায়। এখন তাদের একমাত্র ভরসা মাহবুব কবিরকে সরিয়ে দেয়া। সেই চেষ্টায় তারা আপাতত সফল হয়েছে। মাহবুব কবিরকে চেয়ারম্যান থেকে সরিয়ে সেখানে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের আদেশ হয়েছে।
২. সম্প্রতি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষে জেলায় জেলায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ২০৮ জন জনবল নিয়োগ দিয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ছিলেন মাহবুব কবির। চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের আগে এক ‘বস’ তার কাছে রেজাল্টের তালিকা চেয়েছিলেন। তারা হয়তো কিছু লোকজনের নাম ঢোকাবেন। কিন্তু মাহবুব কবির তাদের কথা না রেখে, দুর্নীতির সুযোগ না দিয়ে পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফল প্রকাশ করে দেন। এতে চটেছেন সেই ‘বস’। ফলে প্রশাসনিক বস আর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের যৌথ চেষ্টায় চেয়ার হারালেন মাহবুব কবির। কি চমৎকার দেখা গেল, তাই না?
মাহবুব কবির মিলন নামের মানুষটাকে আমার কাছে মনে হয় সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো একজন। একুশ বছরের আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে আসা সুকান্ত চেয়েছিলেন নবজাতকের জন্যে পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করে যেতে। আর মাহবুব কবীর মিলন চান নতুন প্রজন্মের জন্যে এই দেশটাকে বসবাসের যোগ্য করে তুলতে। যে দেশে খাদ্যে ভেজাল বলে কোন জিনিস থাকবে না, খাবার নিয়ে কেউ দুই নম্বুরী করতে পারবে না। কিন্ত আফসোস শুধু একটাই, দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে অসম লড়াইটাতে মাহবুব কবির মিলনদের মতো মানুষেরা বড্ড একা হয়ে যান, হেরে যান ধীরে ধীরে। সঙ্গে হেরে যায় পুরো বাংলাদেশও।
মানুষের জন্যে সৎভাবে কেউ কাজ করতে চাইলে যে দেশে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়, সেই দেশটার নাম বাংলাদেশ! দুদকের মুনির চৌধুরী, সাবেক এয়ারপোর্ট ম্যাজিস্ট্রেট বানসুরি মোহাম্মদ ইউসুফেরা তার জ্বলন্ত উদাহরণ, সেই তালিকায় এখন মাহবুব কবির মিলনের নামটাও যুক্ত হবে। অপরাধীদের চোখে তিনি ঘাড়ত্যাড়া, তাকে লোভ দেখিয়ে দলে আনা যায় না। তাই তাকে ছেঁটে ফেলার মিশনে নেমেছে দুর্বৃত্তের দল। উচ্চপদস্থ লোকজনও তাদেরই দলে, আর তাই জনগনের কথা ভাবার কেউ নেই।
আমি জানিনা এই ঘটনাটা প্রধানমন্ত্রীর কানে কখনও যাবে কীনা। খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে নিরলস লড়ে যাওয়া মাহবুব কবির মিলন নামের এই অক্লান্ত যোদ্ধাটিকে প্রধানমন্ত্রী চেনেন কিনা, সেটাও জানা নেই। চাওয়া থাকবে, এই মানুষটাকে যেন আবার স্বপদে বহাল করা হয়। নইলে জনগন বনাম দুর্নীতিবাজদের লড়াইটাতে জনগনের হার হবে, সততা হেরে যাবে বিশাল ব্যবধানে, সবকিছু চলে যাবে নষ্টদের অধিকারে। কে জানে, এরপরে কেউ হয়তো আর মাহবুব কবির মিলন হতেও চাইবেন না, জনগনের উপকার করতে গিয়ে নিজের বুকে গুলি খাওয়ার স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দেবেন অনেকেই...
তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- পলাশ মাহমুদ।