একজন খুনীও নিজের অপরাধের জন্যে অনুতপ্ত হন, কৃতকর্মের জন্যে নিজেকে দোষী ভাবেন। অথচ ধর্ষকদের এসব অনুতাপের বালাই নেই!

আট বছর আগের কথা। ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বরের ঘটনা। নয়া দিল্লীতে বসবাসকারী ২৩ বছরের মনোবিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়নরত জ্যোতি সিং নামের এক তরুণী 'লাইফ অফ পাই' ছবিটি দেখে এক পুরুষ বন্ধুর সাথে বাসায় ফিরছে। তারা একটি বাসে ওঠে। চালকসহ সেই বাসে রয়েছে মোট ৬ জন লোক। চলন্ত বাসের মধ্যে তারা জ্যোতি ও তার বন্ধুর ওপর আক্রমন চালায়। গণধর্ষনের শিকার হয় জ্যোতি। তার বন্ধুকেও পিটিয়ে আধমরা করে দেয় মানুষরূপী পিশাচের দল। 

মুমূর্ষু অবস্থায় সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় জ্যোতিকে। কিন্তু ধর্ষণের ফলে তার তলপেট ও জরায়ু এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে দুই সপ্তাহের বেশি তাকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। ছয়জন ধর্ষকের মধ্যে পাঁচজনকে মৃত্যদন্ড দেয় আদালত। সবচেয়ে ছোট যে, প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়ায় তিন বছরের জন্য সংশোধানাগারে পাঠানো হয় তাকে, এবং মেয়াদ পূর্ণ হবার পর ছেড়েও দেয়া হয়। মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রাপ্ত পাঁচ ধর্ষকের একজন কারাগারেই রহস্যজনকভাবে মারা যায়। 

জ্যোতি সিংয়ের ধর্ষক 

এই ধর্ষণের ঘটনাটি প্রচন্ডভাবে নাড়া দেয় মধুমিতা পান্ডেকে, যিনি ওইসময় নর্থ ওয়েলসের ব্যাঙ্গোর ইউনিভার্সিটি থেকে ক্লিনিকাল সাইকোলজিতে মাস্টার্স করছিলেন। 'এই ঘটনার কথা কানে যেতে আমি খুবই বিচলিত হয়ে পড়ি, রাগে ফুঁসতে থাকি। ওই ঘটনার আগে দিল্লী শহরটাকে আমি ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতাম। কিন্তু ওই ঘটনা আমার চোখ খুলে দেয়,' এভাবেই নিজের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন মধুমিতা। অবশ্য তিনি বেশ ভালো করেই জানতেন, দিল্লীকে অনেক আগে থেকেই অভিহিত করা হয় 'ধর্ষণের রাজধানী' হিসেবে। কিন্তু সেবারই তিনি এমন নামকরণের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করতে পারেন। 

এরপর মধুমিতার মধ্যে তখন এক নতুন চিন্তার উদ্রেক হয়। তাকে জানতে হবে, মানুষ ধর্ষণ কেন করে? কোন ধরণের মানসিকতা কিছু মানুষকে এমন জঘন্য অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়? ধর্ষণের আগ মুহূর্তে তাদের মনের মধ্যে কোন ধরণের ভাবনা ঘুরপাক খায়? এসব প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়ার আশায়, ২০১৩ সালের মার্চ মাসে অর্থাৎ জ্যোতির ধর্ষণের তিন মাস পর মধুমিতা দিল্লীর তিহার কেন্দ্রীয় কারাগারে আবেদন করেন ১০০ জন সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষকের সাথে একান্তে কথা বলার।

ব্রিটিশ সাইকোলজিকাল সোসাইটি হতে অনুমোদিত নীতিমালা অনুসারে, তিনি কেবল সেই সকল সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষকের সাথেই কথা বলেন, যারা নিজে থেকেই তার সাথে কথা বলতে আগ্রহ দেখায়। এই কাজ শুরুর আগে মধুমিতার ধারণা ছিল, এবার হয়ত তিনি নতুন কোন সত্য উদ্ঘাটন করতে পারবেন। ধর্ষকদের মুখ থেকে তাদের উপলব্ধি ও অনুভূতির কথা জানতে পারলে, ধর্ষকেরা কেন ধর্ষক হয়ে ওঠে, এ ব্যাপারে নতুন ও কার্যকরী কোন তথ্যের দেখা মিলবে।

কিন্তু বাস্তবে মাঠে নেমে মধুমিতা আবিষ্কার করেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বেড়ে ওঠা অধিকাংশ মানুষের সাথেই এই ধর্ষকদের খুব বেশি তফাৎ নেই। নারীদের সম্পর্কে তাদের মনোভাব খুবই নেতিবাচক, নারীদেরকে তারা একদমই নগণ্য জীব বলে মনে করে, আর তাই ধর্ষণ করে সেজন্য সাজা পাওয়ার পরও তাদের মধ্যে খুব বেশি অনুশোচনার উদ্রেক ঘটে না। 

তবে একজনের বেলায় সামান্য বৈসাদৃশ্য পেয়েছিলেন মধুমিতা। ৪৯ নম্বর অংশগ্রহণকারী ছিল সেই ব্যক্তি। মধুমিতাকে সে জানায়, নিজের কৃতকর্মের জন্য সে আসলেই অনুতপ্ত। সামান্য সময়ের জন্য মনে আশার সঞ্চার হলেও, কেন সেই ব্যক্তি অনুতপ্ত তা জানার পর আবারও ঘেন্নায় গা গুলিয়ে ওঠে মধুমিতার।

মধ্যবয়স্ক সেই লোকটির কাছে ধর্ষিত হয়েছিল ৫ বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে। প্রথম প্রথম লোকটির মনে অনুশোচনা না জাগলেও, পাঁচ বছর কারাগারের চার দেয়ালে বন্দি থাকার পর একটু একটু পাপবোধ জন্মেছে তার মনে। এখন সে প্রায়ই ভাবে, সে যে ওই বাচ্চা মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছিল, মেয়েটি তো এখনও সেই চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে তার শরীরে, এবং আজীবন বয়ে বেড়াবে। কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা, মেয়েটি তো এখন আর কুমারী নেই। তাহলে কে বিয়ে করবে মেয়েটিকে? মেয়েটি কি তবে আজীবন আইবুড়ো হয়েই থাকবে? তবে যে তার নারী জীবন ষোলো আনাই বৃথা! তাই লোকটি কীভাবে তার পাপমোচন করবে সে কথাও ভেবে রেখেছে। ছাড়া পাওয়ার পর মেয়েটিকে সে নিজেই বিয়ে করে ফেলবে! 

অর্থাৎ নারী যে কেবলই পুরুষের ভোগ্যপণ্য, সতীত্বই তার একমাত্র সম্পদ, এবং বিয়ে করে কোন পুরুষকে সুখী না করতে পারলে তার মানবজীবনের আর কোনই মূল্য নেই - এমনটিই বিশ্বাস ওই ধর্ষকের। এবং পরিহাসের বিষয়, মধুমিতার কাছে সাক্ষাৎকার দেয়া ধর্ষকদের মধ্যে তার এমন মনোভাবই সবথেকে ভালো! তাহলেই বুঝে দেখুন, বাকি ধর্ষকরা নারীদের ব্যাপারে কেমন মনোভাব পোষণ করে থাকে! 

তবে মধুমিতা তার এই গবেষণার মাধ্যমে অন্তত একটি কাজ বেশ ভালোভাবেই করতে সক্ষম হন। তা হলো, ধর্ষণের ব্যাপারে যেসব প্রচলিত মিথ রয়েছে সেগুলো ভাঙতে সমর্থ হন। সাধারণত বলা হয়ে থাকে, কোন নারী খুব বেশি রাত পর্যন্ত বাসার বাইরে থাকলে, উগ্র পোশাক পরিধান করলে, সাথে কোন সঙ্গী সাথী না থাকলে বা পার্টিতে গিয়ে পান করার মত উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করলেই কেবল ধর্ষণের শিকার হতে পারে।

অর্থাৎ একজন নারী যে ধর্ষিত হচ্ছে, সে দায়ও তার উপরেই চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা চোখে পড়ে আমাদের সমাজে। কিন্তু জ্যোতির উদাহরণ টেনেই এসব মিথকে এক ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেন মধুমিতা। 'সে তো খুব বেশি রাত অব্দি বাসার বাইরে ছিল না। তার সাথে একজন পুরুষ সঙ্গীও ছিল। ছোটবেলা থেকেই সে শহরে থেকেছে, তাই দিল্লী শহরটা তার খুব ভালো করেই চেনা ছিল। সে ছিল শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, এবং তার পোশাক আশাকও ছিল যথেষ্ট ভদ্রোচিত। একজন নারীর ধর্ষিতা হওয়ার পেছনে যেসব কারণগুলোকে দাঁড়া করানো হয়, সেসবের কোনটিই তার বেলায় খাটত না। অথচ তারপরও তাকে ধর্ষণের শিকার হয়ে প্রাণ হারাতে হয়।' 

মধুমিতা পান্ডে

শুরুতে ১০০ জন অভিযুক্ত ধর্ষকের সাথে কথা বলার পরিকল্পনা থাকলেও, মোট ১২২ জনের সাথে কথা বলেন মধুমিতা। এবং অধিকাংশের মধ্যেই পাপবোধের ছিটেফোঁটাও নজরে পড়েনি তার। বরং এখনও তারা নিজেদের কাজকে নানাভাবে সঠিক বলে প্রমাণের চেষ্টা করে, এবং সব দায়ভার ধর্ষিতার উপরই চাপিয়ে দিতে চায়।

যেমন মুকেশ সিং (জ্যোতি যে বাসে উঠেছিল) আর তার ভাই। এখনও তারা বিশ্বাস করে, সব দোষ আসলে ছিল জ্যোতি আর তার বন্ধুটিরই। তাদেরকে যখন আক্রমণ করা হয়, তারা যদি পাল্টা আক্রমণ না করত, তবে বাসের ওই ছয়জন পুরুষ ক্ষেপে যেত না, ফলে কোন 'দুর্ঘটনা'ও ঘটত না। তাছাড়া একটি মেয়ে রাতের বেলা বাসায় থাকবেই বা কেন? এটিও প্রশ্ন মুকেশ সিং এর। 

গবেষণার এ পর্যায়ে মধুমিতার মনে নতুন এক প্রশ্নের উদয় হয়। সব অপরাধীই কি এরকম? নিজেদের দোষ তারা অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেদেরকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা চালায়? নাকি নিজেদের দোষ স্বীকার করে নিয়ে তারা অনুশোচনায় ভোগে? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে তিনি কথা বলেন খুনের অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত ৬৫ জন কয়েদীর সাথে। তাদের সাথে কথা বলে আবার ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা হয় মধুমিতার।

এইসব সাজাপ্রাপ্ত খুনিদের সাথে ধর্ষকদের বিস্তর ফারাক। তারা কিন্তু ঠিকই নিজেদের দোষ স্বীকার করে নেয়, ফলে তাদের মনে পাপবোধের জন্ম হয়। এবং কেন তারা এমন একটি কাজ করে ফেলল, তা ভেবে আফসোসও হয়। এ ব্যাপারে মধুমিতা বলেন, 'হাতেগোনা কয়েকজন ব্যতিক্রম বাদে বাকি সব খুনিই তাদের অপরাধের জন্য নিজেদেরকেই দায়ী করে। খুন পূর্ব পরিকল্পিতই হোক কিংবা হঠাৎ করে রাগের মাথায়, পরে এজন্য তারা বেশিরভাগই অনুশোচনায় ভোগে, অন্যের জীবন কেড়ে নিয়ে নিজের জীবনটাকেও শেষ করে দিয়েছে বলে আফসোস করে। অথচ ধর্ষকদের ক্ষেত্রে এমন মানসিকতা একদমই চোখে পড়ে না।' 

এবং এই গবেষণার মাধ্যমে মধুমিতার সামনে এমন একটি সত্য দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে ওঠে, যেটি সম্পর্কে আমরা বরাবরই অবগত ছিলাম। তা হলো, পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীই আসলে ধর্ষণকে কোন অপরাধ বলেই মনে করে না। আর সেজন্যই তারা ধর্ষণ করতে দ্বিধাবোধ করে না। এবং ধর্ষণ করার পরও তারা বিন্দুমাত্র আত্ম-অনুশোচনায় ভোগে না। 

তথ্যসূত্র- In Interviews With 122 Rapists, Student Pursues Not-So-Simple Question: Why?

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা