যেভাবে অল্পের জন্য গিলোটিনের মৃত্যু থেকে বেঁচে যান মাদাম তুসো!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
তাঁকে তারা ‘রয়্যালিস্ট’ অপবাদ দেয়, এবং তাঁকে ধরে নিয়ে অন্ধকূপে নিক্ষেপ করে। এ সময়ে তাঁর মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়, এবং তাঁকে গিলোটিন দিয়ে শিরশ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপর?
মাদাম তুসো হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মোমের মূর্তির জাদুঘর। মাদাম ম্যারি তুসো নামীয় এক ফরাসী মহিলা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সংগ্রহশালাই পরবর্তীকালে মাদাম তুসো জাদুঘর নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। এই জাদুঘরটির মূল শাখা লন্ডনে অবস্থিত হলেও, একই নামে আরও বেশি কয়েকটি শাখা পরবর্তীতে খোলা হয় বিশ্বের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরে। আজকাল মানুষজন মাদাম তুসো জাদুঘরে গিয়ে জর্জ ওয়াশিংটন বা নেপোলিয়নের মত ঐতিহাসিক চরিত্রদের মূর্তির সাথে যেমন ছবি তুলতে পারে, তেমনি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে পারে সমসাময়িক তারকা যেমন লেডি গাগা, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো বা নিকি মিনাজদের সাথেও।
লন্ডনের মূল জাদুঘরটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে সেই ১৮৩৫ সাল থেকে, যখন ম্যারি তুসো লন্ডনের বেকার স্ট্রিটে বাস করতেন, এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টিকর্মগুলোকে মানুষের সামনে তুলে ধরার। ওই সময়ে জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ ছিল 'চেম্বার অফ হররস', যেখানে স্থান পেত বিভিন্ন ঐতিহাসিক খুনির মূর্তি।
বর্তমান সময়ের মূর্তিগুলো ভাড়াটে শিল্পীদের সৃষ্টি হলে কী হবে, সেই সময়কার অধিকাংশ মূর্তিই ছিল প্রকৃত মাদাম তুসো তথা ম্যারির একদম নিজের হাতে গড়া। এর মধ্যে রোবসপিয়ের, জর্জ তিন ও তাঁর নিজের সেলফ-পোট্রের বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর সৃষ্টিকর্মের দ্বারা ম্যারি তুসো আজ বিশ্বের সকল দেশের মানুষের কাছেই স্মরণীয় হয়ে আছেন। কিন্তু একসময় যে তাঁকে যে এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবন পার করে আসতে হয়েছে, এবং তাঁর নামের সাথে ফরাসী বিপ্লবও খুব গভীরভাবে জড়িত, সে ইতিহাস অনেকেরই অজানা।
ম্যারি তুসোর জন্ম ফ্রান্সে, ১৭৬১ সালে। এক সুইস চিকিৎসক, ড. ফিলিপ কার্টিয়াসের কাছ থেকে তিনি মূর্তি গড়া শেখেন। এই ড. কার্টিয়াসের বাড়িতেই তাঁর মা হাউজকিপারের দায়িত্ব পালন করতেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই, ১৭৭৭ সালে তিনি প্রথম মোমের মূর্তি গড়েন, এবং সেটি ছিল ভলতেয়ারের। ১৭৮০'র দশকে তিনি একে একে বহু স্বনামধন্য ব্যক্তির মূর্তি গড়েন, এবং নিজেও একজন প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পী হিসেবে অনেক নাম করেন।
সেই সময়ে তাঁর সৃষ্টিকর্মের তালিকায় প্রাধান্য পেত ফরাসি অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষজন। একসময়ে তিনি এমনকি কিং লুইস ষোড়শের বোন, ফ্রান্সের রাজকন্যা এলিজাবেথের ভাস্কর্য শিক্ষিকা হিসেবে নিযুক্ত হন। কিন্তু রাজ পরিবারের সাথে ম্যারি তুসোর এই যোগাযোগই এক সময়ে তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়, এবং এ জন্য ফরাসি বিপ্লব চলাকালীন তিনি তাঁর প্রাণও হারাতে বসেন।
১২ জুলাই ১৭৮৯, বাস্তিল দুর্গ আক্রমণের মাধ্যমে ফরাসি বিপ্লব শুরুর দুইদিন আগে, ম্যারি তুসোর শিক্ষক ড. ফিলিপ কার্টিসের তৈরি রাজ পরিবারের বেশ কিছু মূর্তির মুন্ডুচ্ছেদ করা হয়, এবং সেগুলোকে প্যারিসে নিয়ে যাওয়া হয় আন্দোলনে কাজে লাগাবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু বিপ্লবীরা অবগত ছিল যে ড. কার্টিসের শিষ্যা ম্যারি তুসো রাজ পরিবার কর্তৃক নিযুক্ত ছিলেন। এজন্য তাঁকে তারা 'রয়্যালিস্ট' অপবাদ দেয়, এবং তাঁকে ধরে নিয়ে অন্ধকূপে নিক্ষেপ করে। এ সময়ে তাঁর মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়, এবং তাঁকে গিলোটিন দিয়ে শিরশ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে, তাঁর মৃত্যুদন্ড কার্যকরের অল্প কিছুদিন আগেই ড. কার্টিস জেনে যান যে তাঁকে বন্দি করা হয়েছে, এবং খুব শীঘ্রই মেরে ফেলা হবে। তখন ড. কার্টিস ছুটে যান বিপ্লবীদের কাছে, আর তাদেরকে আশ্বস্ত করেন যে ম্যারি তুসো নিজেও আসলে 'লিবারাল ধারণা'রই সমর্থক (এবং এ দাবি আসলে সত্য ছিল)।
এইসব শুনে বিপ্লবীরারা ম্যারি তুসোকে কেবল ছেড়েই দেয় না, বরং পরবর্তীতে তাঁকে নিয়োগও দেয়া হয় রাজ পরিবারের সদস্য ও ধনবান রয়্যালিস্টদের ডেথ মাস্কওয়ালা মূর্তি তৈরির কাজে। এমনকি রাজ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের পাশাপাশি রাজকন্যা এলিজাবেথ আর রাজা ষোড়শ লুইকেও গিলোটিনে চড়িয়ে হত্যা করা হয়, আর ম্যারি তুসো তাদের ডেথমাস্কও তৈরি করেন। ১৮০০ এর শুরুর দিক পর্যন্ত ম্যারি তুসো প্যারিসে বাস করেন। এই সময়েই তিনি ইউরোপ পরিভ্রমণে বের হন, এবং বিভিন্ন দেশে তাঁর মূর্তি প্রদর্শন করতে শুরু করেন। অবশেষে ১৮২২ সালে তিনি লন্ডনে চলে আসেন, এবং দুই পুত্রসন্তানকে নিয়ে বেকার স্ট্রিটে স্থায়ী হন।
তথ্যসূত্র- Madame Tussaud narrowly escaped execution by guillotine during the French Revolution
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন