তার দাদাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল ঘরবাড়ি, শৈশবের একটা অংশ কেটেছে রিফিউজি ক্যাম্পে। মাইন বিছানো মাঠে ফুটবল নিয়ে দৌড়ে বেড়ানো সেই ছেলেটাই মেসি-রোনালদোর এগারো বছরের আধিপত্য ভেঙে হয়েছিলেন বর্ষসেরা ফুটবলার...

সাল ১৯৯১। যুগশ্লোভিয়ার বলকান অঞ্চলে কঠিন এবং নির্মম গৃহযুদ্ধ বিস্তার লাভ করেছে। সার্বিয়ান সৈন্যদের বোমা হামলায় তছনছ অনেক কিছুই। ঠিক এমন দুরূহ পরিস্থিতিতে বেড়ে উঠছিলেন আধুনিক ফুটবলের অন্যতম বড় নাম লুকা মড্রিচ৷ পরিবার থেকে সাবধান করে দেয়া হতো যাতে আশ্রয়কেন্দ্রের নিকটেই থাকেন৷ কিন্তু শিশু মড্রিচ তা পাত্তা দিতেন না, বরং বল নিয়েই ছুটতেন মাইনভর্তি মাঠে। দমানো যেত না, অদ্ভুত সাহসের পিঠে চড়ে পার হয়ে আসতেন৷ দাদা লুকাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিলো, জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিলো ঘরবাড়ি। ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক মাত্রায় নেমে এসে, ক্রোয়েশিয়া স্বাধীন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। তবে দুঃস্মৃতি আজো কাতর করে তোলে লুকা মড্রিচকে৷ কখনো একবার বলেছিলেন, এই যুদ্ধই আমাকে প্রতিনিয়ত শক্তিশালী করেছে!

ব্যালনের মঞ্চে মেসি-রোনালদোর আধিপত্য কে ভাঙবেন? গুণী বিশ্লেষকরা কম নাম নেয়নি, নেইমার, হাজার্ড, ব্রুইনে, লেওয়ানডস্কি আরো কত নাম! তবে প্রতি বছর শেষে ব্যর্থ ভবিষ্যৎ বাণীগুলোর পরে হতাশায় নিমজ্জিত সমালোচকরা বলেছিলেন, হয়তো এদের পিছনে ফেলার মতো কেউ নেই। এরা যতদিন খেলবে, রাজ্যের মুকুট ভাগাভাগি করে নিবে। দ্বৈরথ চলবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে, একজন এলেন! ভিনগ্রহের কেউ নয়, বরং সেই মাইনভর্তি মাঠে সীমাহীন মৃত্যু ঝুঁকিকে অতিক্রম করে বল নিয়ে দৌড়ানো ছেলেটি হয়ে উঠলেন ব্যালনের মঞ্চের শিরোমনি। মেসি-রোনালদোকে পেছনে ফেলে ২০১৮ সালে জিতলেন বর্ষসেরার পুরষ্কার।

পথচলা কোনোভাবেই মসৃণ ছিল না, তা লুকা মড্রিচের শিশুকালের জীবনী থেকেই বোঝা যায়। দাদাকে হত্যার পর সার্বিয়ান বিদ্রোহীদের হাতে তিনিও আটক হয়েছিলেন, পরে ছাড়া পান। তবে জীবনে ফুটবলে স্পর্শ আসার পর সেটাই ধ্যান-জ্ঞান হয়ে উঠে শিশু মড্রিচের। যে ক্রোয়েশিয়ার জাদার অঞ্চলে জন্ম নিয়েছিলেন, সেই জাদার তরুণ দলের হয়ে দশ বছর বয়সে একটি ক্লাব 'হাজদুক সপ্লিট'-এ জীবনে প্রথমবারের মতো ট্রায়ালে অংশ নেন। কিন্তু শারীরিক গড়নে পিছিয়ে পড়ায় প্রথমবার বাদ পড়েন। 

পরবর্তীতে জাদারের এক ফুটবল বিশেষজ্ঞ তোমাসিলাভ বাসিচের নজড় কাড়তে সক্ষম হন লুকা। মূলত তিনিই মড্রিচের ফুটবল জীবনটা পাল্টে দেন৷ তাঁর তৎপরতায় ডায়নামো জাগরেব-এর যুবদলের সাথে চুক্তি হয় মড্রিচের। সেখানে মড্রিচ দারুণ কিছু বছর পার করেন, ধীরে ধীরে একজন ভালো মিডফিল্ডার হিসেবে গড়ে তোলেন নিজেকে। তরুণ ক্রোয়েট ফুটবলারের দারুণ প্রতিভা নজর এড়ায়নি উত্তর লন্ডনের ক্লাব টটেনহাম হটস্প্যারের৷ সুতরাং ২০০৮ সালে সাড়ে ষোল মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান তিনি।

২০১৮ বিশ্বকাপে স্বপ্নের মতো ফর্মে ছিলেন মড্রিচ

লন্ডনের সূচনা অধ্যায় এতো মসৃণ না হলেও, টটেনহামের দায়িত্ব হ্যারি রেডন্যাপের হাতে আসার পর মড্রিচও নিজেকে খুঁজে পেতে শুরু করেন। হয়ে উঠেন দলের অপরিহার্য সদস্য৷ এরপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি৷ ২০১২ সালে গ্রীষ্মের ট্রান্সফার মার্কেটে ম্যানেজার হোসে মরিনিহোর আবদারে ত্রিশ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে স্পার্সের সাথে চার বছরের সম্পর্ক চুকিয়ে রিয়াল জার্সিতে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর ঘাসে পা রাখেন লুকা মড্রিচ। সবাই জানতেন মড্রিচ শীঘ্রই রিয়ালের মাঝমাঠের তুরুপের তাস হবেন, কিন্তু এই সাইনিং এ মিডিয়া তোলপাড়ের মতো কোনো আলোচনা হয়নি। বরং প্রথম মৌসুম শেষে রিয়ালের ইতিহাসে অন্যতম ফ্লপ সাইনিং এর তকমা জুটেছে, হয়েছে বিস্তর সমালোচনা। কিন্তু কে জানতো, পরের মৌসুমেই উজ্জ্বল মড্রিচের দেখা মিলবে, শুরু হবে এক নব জয়যাত্রা ও ইতিহাস নির্মাণ! 

গত দশকে কেবল মড্রিচই নয় বরং রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসটাও সমৃদ্ধভাবে লেখা হয়েছে ১৩-১৪ মৌসুম থেকেই৷ লিসবনের সেই ফাইনালের রাতে বারো বছরের অভিশাপ ঘুচানো রামোসের হেডটা তো এসেছিলো মড্রিচের তড়িঘড়ি করে নেয়া চমৎকার কর্ণার হতেই। এরপরের ইতিহাস সকলেরই জানা৷ রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে হ্যাট্রিক চ্যাম্পিয়নস লীগ ট্রফি তো স্বপ্নকেও হার মানায়, হার মানায় শতাব্দীর গল্পকে। যে সফল উপাখ্যানে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মধ্যমাঠের শিরোমণি, হয়ে উঠেছিলেন মধ্যমাঠের সুপারস্টার! 

ফলে খুব দ্রুতই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পাশাপাশি মাদ্রিদের সেরা খেলোয়াড় হওয়ার বিশেষণটাও মিডিয়ায় হরহামেশা শিরোনাম হতে থাকে। অপরদিকে জাতীয় দলের হয়ে ২০১৮ বিশ্বকাপেও স্বপ্নের আকাশ ছুঁয়েছেন তিনি। অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পড়ে প্রিয় দেশকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে তুলেছেন ফাইনালে, জিতেছেন আভিজাত্যের গোল্ডেন বল৷ ফাইনালের হারে ব্যক্তি সাফল্যে পূর্ণতা আসেনি বটে, কিন্তু শতাব্দী পরেও ক্রোয়েশিয়ার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরেই লেখা থাকবে মড্রিচের দলটির গল্প।

লুকা মড্রিচ। লিটল ম্যাজিশিয়ান কিংবা মিড ফিল্ড জেনারেল নাকি মধ্যমাঠের স্ক্রিপ্ট রাইটার, তাকে কি বিশেষণে বিশেষায়িত করতে চান সেটা আপনাদের ওপরেই ছেড়ে দিলাম। পাসিং, ড্রিবলিং, থ্রু পাস, ট্যাকেল কিংবা আচমকা নেয়া জোরালো শটে যেন সেই চরিত্রের স্পেশালিটি খুঁজে পাবেন প্রতিটা মুহুর্তে। সবমিলিয়ে অপ্রতিরোধ্য ও অদম্য এক চরিত্র। অন্তত সদ্যই করোনা পরবর্তী সময়ে মৌসুমের শেষ ম্যাচগুলোতে 'না ফুরিয়ে' যাওয়ার গল্পটা যেভাবে মাঠে এঁকেছেন তাতে মড্রিচের আজীবন লড়াকু মানসিকতার চরিত্রের পরিস্ফুটনই আমরা দেখতে পাই।

ব্যালন ডি-অরের ট্রফি হাতে

স্প্যানিশ মিডিয়া তার নাম দিয়েছিলো 'El Pazaro', অর্থ্যাৎ দ্যা বার্ড। মাঠের খেলায় প্রিয় লুকিতা আসলেই তো উড়েছেন। কখনো পুরো মধ্যমাঠ জুড়ে, কখনোবা এই বক্স থেকে ওই বক্স! যা কিনা ব্যালনের মঞ্চে গিয়ে থেমেছে একেবারে। মড্রিচ অনেকটাই বিয়ারের মতো! বয়স যতটা বেড়েছে, পুরোনো বিয়ারের মতো তাঁর স্বাদ বেড়েছে ততটুকু। কে ভেবেছিলো সেই সময়, একত্রিশ বছরের এক লোকের কাছে মেসি-রোনালদো কুপোকাত হবেন, যিনি কিনা আবার পুরোদমে মিডফিল্ডার!

সময় গড়িয়ে গেছে অনেকখানি। আজ পয়ত্রিশ বছরে পাড়ি জমালেন 'দ্যা ক্রুয়েফ অব বলকান' খ্যাত লুকা মড্রিচ। প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে এমন এক চমৎকার খেলোয়াড়ের পুরো ক্যারিয়ারটার সাক্ষী হয়ে আছি। সাক্ষী হয়ে আছি অসংখ্য জন্ম দেয়া ঐতিহাসিক ফুটবলীয় ও চোখ ধাঁধানো মুহুর্তের। সাক্ষী হয়ে আছি এক ব্যক্তির রিফিউজি ক্যাম্প থেকে বিশ্বসেরা ফুটবলার হয়ে উঠার রূপকথার বাস্তব গল্পের!

জন্মদিনে অসংখ্য শুভকামনা থাকবে। নতুনভাবে পাওয়া কিছু নেই। তবে প্রত্যাশা থাকবে, যাতে অন্তত আরো দুই মৌসুম মানুষটিকে ইউরোপিয়ান ফুটবলে খুঁজে পাই।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা