
বেনাপোল পার হবার পরে আমি গভীর বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করতে থাকি, একটা লম্বা রাস্তা ধরে যাচ্ছি তো যাচ্ছি, শেষ আর হয় না, নাম যশোর রোড। তখনও মনে হচ্ছিলো, বুঝি নিজের মায়ের কোলেই আছি এখনও। একটা বর্ডার পার হতে গিয়ে যে উৎকন্ঠা আর ঝামেলার মধ্যে পরতে হয়, না চাইলেও যেন বুঝিয়ে দেয়া যে ওপারে এইটা পরদেশ, ভুলে যাতে না যাস এজন্য মনে করিয়ে দিচ্ছি ভালো করে। অথচ, যশোর রোড পার হয়ে আরও ভেতরে চলে গেলাম, দুই পাশে ক্ষেত, গাছ, নালা। কী অদ্ভুত! এতো দেখি আমার বাংলার মতোই, বাংলাই তো!
প্রথমবার একা গিয়েছিলাম। সাথে সিম কার্ড নেই। ইন্টারনেট এক্সেস নেই। এখান থেকে গুগল ম্যাপ এ সেভ করে নিয়ে গিয়েছিলাম লোকেশন। বদের হাড্ডি দেখা গেলো ঠিক মতো কাজ করছে না। বহু ঝামেলা করে শেষ পর্যন্ত চমৎকার একটা হোস্টেল এর মতো জায়গায় উঠলাম। সম্পূর্ন এসি, টাট্টিখানাতেও এসির বাতাস পৌছায়। চাইলে নিজে রান্না করে খাওয়া যায়। আমি এপস নামিয়ে অর্ডার করে আনাতাম খাওয়া। চমৎকার বারান্দা, কিচেনের পাশে, সেখানে পানাহার এর সুন্দর ব্যবস্থা। কতো ইউরোপিয়ান, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোকদেরকেও পেলাম সেখানে।
দ্বিতীয়বার অবশ্য বন্ধুদের সাথে যাওয়া। কোলকাতার পুরনো অলিগলির পাশাপাশি, আমি ভালোবেসে ফেলেছি ততোক্ষনে কোলকাতার মানুষগুলোকে। এক ট্যাক্সিতে উঠলাম, খুব তাড়ায় পরে। ভাড়া চাইলো পঞ্চাশ রুপী, আমাদের ঢাকা হলে অবশ্য ২৫০টাকা চাইতো। বললাম, দাদা মিটারে যাবেন না কেন? সব গুলো দাঁত বের করে হেসে বললো, ‘দাদা, মিটারে গেলে পরণের জাঙ্গিয়াটাও খুলে রেখে আসা লাগবে যে’।
রাস্তাগুলো সব এক মুখী বলে, চাইলেই রিকশা বা ছোট কোন যান নিয়ে যত্র তত্র যাওয়া যায় না, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই হাঁটতে হয়। প্রশস্ত ফুটপাতে হাঁটতে খারাপ লাগে না। আমার মতো হাঁটাবিমুখ মানুষও দিনে বাধ্য হয়ে ৩-৪কিলো করে হেঁটেছি প্রতিদিন।
কোলকাতাকে ভালো না বেসে পারা যায় না, এর পথের ধারে বিভিন্ন খাবারের কারণে, যাকে কি না বলে স্ট্রিট ফুড। মাত্র ষাট রুপীতে চিকেন ফ্রাইড রাইস কিংবা ন্যুডলস, ২০ রুপিতে ডালভাজি, লুচি, বিভিন্ন সবজি ভাজি– পেট পুরে খাওয়া যায়! আরও অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, সেখানে অফিস করা বড় কর্তা থেকে শুরু করে, আধুনিক বন্ধু বান্ধবী কিংবা ভবঘুরে সবাই খাচ্ছে একসাথে। খাবারের তো জাতপাত নেই, দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।

কোলকাতায় সবচেয়ে মনে পরে যে কয়টা জায়গার কথা, তার একটি হলো জাকারিয়া স্ট্রীট, মুসলিম প্রধান এলাকা। কী রঙ্গিন একটা এলাকা! কাওয়ালী গান বাজছে দোকানে দোকানে, চারদিকে শুধু কাবাব এর দোকান, আর বাতাসে কাবাব এর ধোয়ার ঘ্রাণ। ২০-৩০ রুপী থেকে শুরু করে ৫০ কি ৬০ রুপীতে মজার সব কাবাব, লুচি। সাথে শত বর্ষ পুরনো বিভিন্ন মিষ্টির দোকান। সে দোকানে বিভিন্ন পদের হালুয়া, তাতে টাটকা ঘি এর সুঘ্রাণ। একটু খেলেই যেন পেট ভরে যায়, মন ভরে যায়।
ভরা পেটে পার্ক স্ট্রীট এর এদিক আসলে মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন পানশালা। চাইলে উদ্যম সঙ্গীতের সাথে একটু শুরাপান চলতে পারে। এতো এতো বার, মদ এর দোকান, অথচ রাস্তাঘাটে কেউ মাতলামী করছে না, যে ভয় আমাদের এখানকার মুরুব্বীরা পান।
কোলকাতার সবচেয়ে বড় অর্জন বলে আমার যেটা মনে হয়, সেটা একটা অব্যয় ব্যাপার, মানে ধরা ছোঁয়া যায় না, তবে অনুভব করা যায়। সেটা হলো, এরা একটা আস্থা অর্জন করতে পেরেছে, আত্মবিশ্বাস দান করতে পেরেছে শহরের নারীদের যে, তুমি পরিধান করতে পারো, যা মন চায়। তুমি যা ইচ্ছে পরিধান করো, যা ইচ্ছে করো, বন্ধুর হাত ধরে রাত ১১টায় ঘুরে বেড়াতে চাও, ঘুরো, পান করতে চাইলে করো, আমি আছি, আমরা আছি, কোনো ভয় নেই।
কোলকাতার মেয়েদের সাথে আমাদের মেয়েদের দৈহিক সৌন্দর্যের তেমন পার্থক্য না থাকলেও, একটা পার্থক্য প্রকটভাবে চোখে পরে, তা হলো, ওদের মেরুদণ্ড সোজা হয়ে হাটা। অফ শোল্ডার পরেছে, ব্রা এর ফিতা বের হয়ে আছে, কিচ্ছু যায় আসে না! সোজা সিনা টান করে হাঁটছে। যার ইচ্ছে কামিজ, সালোয়ার (বেশ কম সংখ্যায়), ইচ্ছে হলে জিন্স পরে হাটছে, আড্ডা দিচ্ছে। দেখলেই বোঝা যায়, কেউ এসব নিয়ে টু শব্দ করলে একদম গলা চাপ দিয়ে ধরবে। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা হলো, মেট্রোর মতো জায়গায়, এতো ভীড়েও কি কনফিডেন্স নিয়ে শর্ট স্কার্ট পরে একা মেট্রো চেপে সন্ধ্যা রাতে শহরের এক মাথা থেকে অন্য মাথা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ভারতের অন্য রাজ্যের কথা জানি না তবে পশ্চিম বঙ্গ, বিশেষ করে কোলকাতা যথেষ্ট প্রোগ্রেসিভ এসব ব্যাপারে। একটা স্বাধীন মেয়ে, যখন ক্লিভেজের কাছে কিছুক্ষন পর পর জামার খুট ধরে টানে না, ব্রা স্ট্র্যাপ বের হয়ে আছে কি না এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে না, নিতম্বের উপর থেকে কাপড় সরে গেলো কি না, একটু পর পর টানতে হয় না, নিজের মতো করে বুক টান করে, সাহসের সাথে যখন হাসে, হাটাচলা করে, নিজ কাজে মনোনিবেশ করে, তাকে অসম্ভব সুন্দর দেখায়, এই সৌন্দর্যের সাথে লাস্যময়ী সৌন্দর্য যাকে দেখলে বিছানায় পেতে ইচ্ছে করে তার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই।
কোলকাতার সবচেয়ে দারুণ ব্যাপারটা সম্ভবত এর মেট্রো রেল। পার্ক স্ট্রীট থেকে রবীন্দ্র সরোবর যেতে প্রায় ৭-৮টা স্টেশন ঠেলে যেতে লাগে মাত্র ৬-৮ রুপী! সময় লাগে হয়তো ১০ কি ১২ মিনিট! ৫-৬ মিনিট পর পর ট্রেন আসছে, কী দারুণ সস্তায় শহরের মানুষ পৌছে যাচ্ছে যার যার ঠিকানায়। নিরাপত্তা বেশ ভালো বুঝলাম কারণ আমি একটা প্যানারোমা তুলবার জন্য মোবাইল বের করে ছবি তুলতে উদ্যত হওয়া মাত্র এক পুলিশ এসে নিষেধ করলো। মেট্রো রেল এর র্যুট একবার জেনে নিলে সারা কোলকাতা দুজন মিলে সারাদিন ঘুরতে চাইলেও ১০০ রুপী খরচ করা সম্ভব না হয়তো।
কোলকাতা নিয়ে এতো স্মৃতি রোমন্থন এর কারণ বলি। আমপান এর তাণ্ডবে কোলকাতার অবস্থা দেখে ভীষণ মন খারাপ হয়েছে। এই কোয়ারেন্টাইনে আমি অনেক দিন ধরে বলছি বন্ধু রহমানকে, কবে কার্ভ ডাউন হবে, কবে কেস কমতে শুরু করবে, কবে বর্ডার খুলবে আর কোলকাতা যাবো। আপনার পকেটে দশটা হাজার টাকা জমেছে? সিলেট বা কক্সবাজার যেয়ে দেখুন তো, কয়দিন থাকতে পারেন। অথচ, কাগজে, কলমে আমার দেশ-ই না, অথচ সেখানে অনায়াসে খেয়ে পরে ৭-৮ দিন পার করে দেয়া যায় আনন্দে হেসে খেলে।
কোলকাতার কফি হাউজে বসে কফি খেয়েছিলাম, সে কী বিস্বাদ কফি! অথচ তবুও বসে থাকতে ইচ্ছে করে। নিচের দোকানে বই, সিগারেট বিক্রী হয়, সেখানে চারমিনার দেখে কিনে নিলাম। কলেজ স্ট্রীট দেখে মনে পরে গেলো, আমাদের নীলক্ষেত এর কথা। মির্জা গালিব স্ট্রিট এর ইসলামী ইয়াদগার হোটেলের কালাভূনা আর কাচ্চি খেয়ে আমার মনে পরে যায় চানখারপুলের সোহাগ হোটেলের কালাভূনা, সাতরওজার কোলকাতা কাচ্চির কথা। কোলকাতা মেডিকেল কলেজ এর বাইরেটা দেখে ঢাকা মেডিকেল এর আউটডোরের ভীড় মনে পরে গেলো। সেই কোলকাতা আজ লন্ডভন্ড আমপান এর তাণ্ডবে। কষ্ট হয়, ভীষণ খারাপ লাগে।
ভটভট শব্দ করা হলুদ ট্যাক্সিতে চেপে বাস কাউন্টারে নেমে যেদিন ঢাকা ফেরত আসছিলাম মায়ের কাছে, সেদিন বার বার মনে পরছিলো এক ক্ষ্যাপাটে বাঙ্গালী কাকুর কথা, নাম তাঁর হৃত্তিক ঘটক। ক্ষ্যাপাটে কাকু বলেছিলেন, 'বাংলারে ভাগ করিবার পারিছো, কিন্তু দিলটারে ভাগ করিবার পারো নাই'।
প্রিয় ওপার বাংলা, ভালোবেসে পাশে আছি।