বিদায় প্রিয় সাঞ্জ। আপনি তো ইতিহাসের সাক্ষী, আপনার এই বিদায় কাম্য ছিল না কখনোই। কিন্তু আজ এইদিনে এসে, কষ্ট চেপে দুই এক লাইন লেখার বাইরে কিছুই তো করার নেই।
একজন প্রচন্ড ফুটবলপ্রেমী ও বিশেষত মাদ্রিদ সমর্থক হিসেবে আজকের সকালটা ছিল ভীষণ মন খারাপের এবং শোকের। ঘুম থেকে উঠে সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখতেই দেখি 'লরেঞ্জ সাঞ্জ আর নেই'। করোনা ভাইরাসে তাঁর আক্রান্তের ঘটনা সবাই জেনেছিলো বেশ কদিন আগে। আর কিছু ঘন্টা পূর্বে তাঁর মৃত্যুর সংবাদ জানলো সমগ্র পৃথিবী। ফুটবল বিশ্বও হারালো এক আপাদমস্তক ফুটবল ব্যক্তিত্বকে। রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং ফুটবল ক্লাব মলাগার সাবেক মালিক হিসেবেই যিনি কিনা সমধিক পরিচিত ছিলেন।
স্প্যানিশ ব্যবসায়ী লরেঞ্জো সাঞ্জ, যিনি ছিলেন ইউরোপীয়ান ফুটবল ইতিহাসের সফলতম ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট। প্রায় ৫ বছর রিয়াল মাদ্রিদ বোর্ডের এই সর্বোচ্চ পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে তিনি দশ বছর (১৯৮৫-৯৫) ডিরেক্টর পদেও ছিলেন। সেই মুহুর্তে প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন র্যামন মেন্ডোজা। ১৯৮৫ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে যিনি কোনো নির্বাচনই হারেননি। প্রথম দুই মেয়াদের চমৎকার কাজ করেছিলেন মেন্ডোজা, টানা পাঁচবার লীগ জয়ের শিরোপা নিয়েছিলেন ঝুলিতে। কিন্তু পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে থাকে নব্বইয়ের পরে। ধীরে ধীরে ক্লাবে তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য ও একনায়কতন্ত্র কায়েম হয়। জর্জরিত হয়ে পড়েন মহা দুর্নীতিতে। তবে ১৯৯৪ সালেও তাঁর বিদায়ের আগে শেষ নির্বাচনে তিনি ফ্লোরেন্তিনা পেরেজ-কে হারিয়েছিলেন ৭০০ ভোটে এবং চতুর্থ বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন। কিন্তু মেন্ডোজার দূর্নীতি ও চরম অব্যবস্থাপনায় সবমিলিয়ে বেশ টালামাটালা অবস্থা পরিণত হয় রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাবের।
সাল ১৯৯৫। বিভিন্নখাতে অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ। ততদিনে অস্বস্তি এবং বিদ্রোহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে ভিতরে ভিতরে। অবশেষে সেই ক্ষণ আসে, অর্থনৈতিক ক্ষতি ও ক্লাবের নানামুখী সমস্যাকে সম্মুখে এনে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে জোরপূর্বক পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় রাউল মেন্ডোজাকে। ঠিক মুহুর্তে সামনে অগ্রসর হোন লরেঞ্জো সাঞ্জ। কিন্তু তাঁর পথও সূচনায় মসৃণ ছিলনা৷ শুরুতেই জনপ্রিয়তা অর্জনে তাঁর বেশ বেগ পেতে হয়। কেননা মেন্ডোজার প্রায় পুরো মেয়াদেই এই লোক দলের ডিরেক্টরের পদ সামলেছেন, তাই তাঁর প্রতিও অভিযোগের তীর এবং আস্থাহীনতা অনেকের ছিল। কিন্তু সাবলীল দক্ষতায় মোটামুটি সবকিছু সামলিয়ে, বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে ৯৫ সালের শেষের দিকে অর্থ্যাৎ ১৯৯৫-৯৬ মৌসুমের মাঝপথে বোর্ড প্রেসিডেন্ট হোন লরেঞ্জো সাঞ্জ। রিয়াল মাদ্রিদও দশ বছর পর মাঠের বাইরে তাদের নতুন নেতা খুঁজে পেলো। আর সাঞ্জের দায়িত্ব ছিল, যেভাবেই হোক রিয়াল মাদ্রিদের সাময়িকভাবে হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা।
মৌসুম ১৯৯৫-৯৬, হাল আমলে যার কথা ভুলে থাকতে চাইবে রিয়াল মাদ্রিদের সব সমর্থকই। কেননা মৌসুমটিতে লীগে ব্যর্থতার ষোলকলা যেন পূর্ণ করেছিলো রিয়াল মাদ্রিদ। ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো রিয়াল মাদ্রিদ ব্যর্থ হয় চ্যাম্পিয়নস লীগে পদার্পণ করতে! আজকে ২০২০ সালে দাঁড়িয়েও কি তা ভাবা যায়? তখনো তাই স্বপ্নের অতীত ছিল, সমর্থকদের হতাশা ছিল আকাশচুম্বী। এমনেই চ্যাম্পিয়নস লীগের শিরোপাটা অধরা আছে তিন দশক, এবার তো খেলার যোগ্যতাও খোয়ালো। নব্বইয়ের শুরুতে ইউরোপিয়ান কাপ নাম বদলে চ্যাম্পিয়নস লীগ নামকরণ দিয়ে নবযাত্রাও শুরু করেছে উয়েফা, কিন্তু সেই রিয়াল মাদ্রিদ যেন কোথাও নেই। চ্যাম্পিয়নস লীগেও নেই! তবুও দায় বর্তায় না সাঞ্জোর ওপর কেননা মৌসুমের অর্ধেক সময়ে এসে তাঁকে দায়িত্ব নিতে হয়েছিলো। সবকিছু ঠিকঠাক করার মতো পর্যাপ্ত সময় তিনি পাননি। তাই বাস্তবতা বুঝে কেউ আর আঙ্গুলও তুলেননি সেভাবে। তবে চাপ তো ছিলই।
৯৬-৯৭ মৌসুমে ব্যর্থতার দ্বারপ্রান্ত থেকে দলকে তুলে আনার মিশনে নামলেন সাঞ্জ৷ ডাগ আউটের দায়িত্ব তুলে দেয়া হয় সদ্য এসি মিলান ত্যাগ করা ফ্যাবিও কাপেলোর হাতে। অর্থনৈতিক মন্দাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দলে ভিড়ালেন রবার্তো কার্লোস, ডেভর সুকার, ক্ল্যারেন্স সিড্রোফ এবং প্রিড্রেগ মিয়াটোভিচদের মতো খেলোয়াড়দের যারা আজ ফুটবল কিংবদন্তী হিসেবেই বিবেচিত হোন। শক্তিশালী ফুটবল লাইন আপ ও ক্যাপেলোত ফুটবল মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় লড়াইয়ে ফিরলো রিয়াল মাদ্রিদ। বার্সালোনাকে দুই পয়েন্ট পেছনে ফেলে, লালীগার শিরোপা উঠলো রিয়ালের শোকেসে। এতে স্বাভাবিকভাবে চ্যাম্পিয়নস লীগেও ফিরে আসলো রিয়াল মাদ্রিদ। দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম পূর্ণাঙ্গ মৌসুমেই সফল লরেঞ্জো সাঞ্জ। কিন্তু মৌসুম শেষে বিপত্তি বাঁধে। সাঞ্জের সাথে ক্যাপেলোর মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়, পাশাপাশি লীগ শিরোপা জেতানোর পরেও রাউল গঞ্জালেসকে লেফট উইং এ খেলানোয় দর্শকের দুয়োধ্বনি শুনতে হয় ক্যাপেলো। এসি মিলান তাদের সাবেক কোচকে পুনরায় ডাক দিলে, দায়িত্ব ছেড়ে মিলানে ফিরে যান ক্যাপেলো।
সাঞ্জ এবার দায়িত্ব তুলে দেন জার্মান ট্যাকটিশিয়ান হেইঙ্কেস এর ওপর, শুরু হয় ১৯৯৭-৯৮ মৌসুম। কিন্তু হেইঙ্কেস এর তত্ত্বাবধানে লীগে খেই হারিয়ে ফেলে রিয়াল মাদ্রিদ। যদিও ইউরোপের মঞ্চে গুটিগুটি পায়ে সফলতার সাথে সব বাঁধা পার হতে থাকে লস ব্লাঙ্কোসরা। সেমি ফাইনালে তৎকালীম চ্যাম্পিয়ন জার্মান জায়ান্ট বরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে হারিয়ে ফাইনালেও পৌঁছে যায় রিয়াল, যা ছিল সতেরো বছর তথা ১৯৮১ সালের পর প্রথমবারের মতো ফাইনালে পদার্পণ। প্রতিপক্ষ হিসেবে ছিল জিনেদিন জিদানে উড়তে থাকা জুভেন্টাস। তবে আমস্টারডাম এর সেই ফাইনালে নব ইতিহাস রচনা করে রিয়াল মাদ্রিদ। মিয়াটোভিচের দেয়া জয়সূচক একমাত্র গোলে সপ্তমবারের মতো ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট নিজেদের করে নেয় রিয়াল। তবে এই জয়ের আনন্দের গভীরতার ছাপ ছিল অন্যরকম, ছিল বাঁধভাঙা উল্লাসের। কেননা এই জয় যে দীর্ঘ প্রতীক্ষার 'লা সেপ্তিমা' অর্জনের৷ পুরোনো উৎসব যেন ফিরে এসেছিলো মাদ্রিদের রাজপথে।
শুধু একবার নয়, ১৯৯৯-০০ মৌসুমেও তাঁর মেয়াদে ভ্যালেন্সিয়াকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস লীগ শিরোপা জিতেছিলো রিয়াল মাদ্রিদ। তাঁর হাত ধরেই পুনরায় ইউরোপ ফুটবলে আধিপত্য শুরু হয় রিয়ালের। কিন্তু মেয়াদের শেষে অর্থনৈতিক সমস্যা অনেক বড় আকারে দেখা দেয় ক্লাবের মধ্যে। তাই দ্বিতীয়বারের মতো ইউরোপ সেরার মুকুট জিতেও ক্লাবের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে পারেননি সাঞ্জ। ফাইনালের কয়েকদিন পর অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের কাছে হেরে যান তিনি। ফলে রিয়াল মাদ্রিদের সাথে টানা প্রায় পনেরো বছরের প্রশাসনিক সম্পর্ক ছিন্ন হয় সাঞ্জের, বিদায় জানান প্রিয় ক্লাবকে। যদিও ফুটবলে থেকে সরে যাননি তিনি। মাঝে ইতালিয়ান ফুটবল ক্লাব পারমা কেনার কথা থাকলেও, সেখানে কিছু জটিলতা তৈরি হয়। পরে তা থেকে সরে আসেন। ২০০৬ সালে পুনরায় রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন তিনি। কিন্তু এবারও হেরে যান প্রতিদ্বন্দ্বী র্যামন ক্যালদেরন এর কাছে। পরবর্তীতে একই বছরে তিনি স্প্যানিশ ফুটবল ক্লাব মালাগাকে কিনে নেন৷ যা ৪ বছর পর, ২০১০ সালে কাতারের বিয়োগকারী আব্দুল্লাহ আল থানীকে বিক্রি করে দেন। এরপর ফুটবলের সাথেও মোটামুটি পাট চুকিয়ে ফেলেন লরেঞ্জ সাঞ্জ।
৯৮ সালের আমস্টারডাম ফাইনাল জিতে আসার পর মুহুর্তে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে আয়োজিত বিশাল জয়োৎসব ও সংবর্ধনায় ডিরেক্টর বক্সেই নেচে উঠেন লরেঞ্জো সাঞ্জ। আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান তিনি। তিনি এখন ইউরোপের রাজাদের প্রেসিডেন্ট, তার চেয়ে সুখী নিশ্চিতভাবেই আর কে হবে! সমর্থকদের মাঝে ছুটে গেলেন। সমর্থকরাও ভুলে গেল সবকিছু। তারা ভুলে গিয়েছিলো এই সে লরেঞ্জো সাঞ্জ যিনি কিনা কুখ্যাত প্রেসিডেন্ট মেন্ডোজার মেয়াদে তাঁর সবচাইতে বিশ্বস্ত সাথী ছিলেন, অনুগত ছিলেন। পুরোনো ক্ষত, পুরোনো অভিমান-অভিযোগ কিছুই অবশিষ্ট থাকলো না। কারণ তিন দশকের অবসান হয়েছে, বত্রিশ বছর পর সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ফিরবে চ্যাম্পিয়নস লীগের শিরোপা। লরেঞ্জো সাঞ্জ তাই হয়ে উঠলেন সমর্থকদের মধ্যমণি, প্রাণের প্রিয় প্রেসিডেন্ট। সমগ্র সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর প্রতিটা গ্যালারি একত্রিত সুরে চান্ট করতে থাকে সাঞ্জের নামে। আবেগতাড়িত অশ্রুসজল হয়ে উঠেন সাঞ্জ। তিনিও হয়তো ততক্ষণে বুঝতে পেরেছিলেন মাদ্রিদের রাজকীয় ইতিহাসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন স্বর্ণাক্ষরে!
বিদায় প্রিয় সাঞ্জ। আপনি তো ইতিহাসের সাক্ষী, আপনার এই বিদায় কাম্য ছিল না কখনোই। কিন্তু আজ এইদিনে এসে, কষ্ট চেপে দুই এক লাইন লেখার বাইরে কিছুই তো করার নেই। আপনার নেতৃত্বে ইউরোপে হারানো গৌরব ফিরেছিলো রিয়াল মাদ্রিদের। শতাব্দীর সেরা ক্লাবের মুকুট অর্জনে আপনার এনে দেওয়া সফলতার অনিবার্য অবদান আছে। আপনি চির স্মরণে থাকবেন। রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাব ফুটবলের লরেঞ্জো সাঞ্জ হয়ে, আপনি অমর হয়ে থাকবেন ফুটবল বিশ্বে।