আজকে আপনাদের শোনাব ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে লম্বা ম্যাচটির কাহিনী, পাঁচ দিন নয়, যেটি চলেছিল বারো দিন যাবত, এবং মাঠে খেলা চলেছিল ৪৬ ঘণ্টার মতো, তবুও ম্যাচটা হয়েছিল ড্র!

১৯৩৯ সালে হয়েছিল সেই অবিস্মরণীয় ম্যাচটি। আর এই ম্যাচে অংশ নিয়েছিল সফরকারী ইংল্যান্ড ও স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা। ৩ মার্চ থেকে ১২ মার্চ পর্যন্ত ডারবানের কিংসমিডে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ম্যাচটি। যদিও ম্যাচটির দৈর্ঘ্য ছিল ১২ দিনের, কিন্তু খেলা মাঠে গড়িয়েছিল ৯দিন। বাকি তিনদিন প্রবল বৃষ্টিপাতে খেলা স্থগিত ছিল। 

যারা ভাবছেন ৯দিন বা ১২দিন কীভাবে খেলা সম্ভব, তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, সেই সময়ে টেস্ট ক্রিকেট খেলা হতো 'টাইমলেস' ফরম্যাটে। অর্থাৎ একটি ম্যাচের কোন ধরাবাঁধা সীমারেখা নেই। যতদিন পর্যন্ত ম্যাচের একটি সুনির্দিষ্ট ফলাফল আসবে, ততদিন অবধি খেলা চলতে থাকবে। এই ফরম্যাটেই ১৯৩৮-৩৯ মৌসুমে ইংল্যান্ডের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের শেষ ম্যাচ ছিল এটি। 

তবে ঐতিহাসিক এই ম্যাচটিতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন ফলাফল আসেনি। দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত ম্যাচটিকে ড্র ঘোষণা করা হয়। আর যে কারণে এমন সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হয়েছিল দল দুটি, তা জানলে চোখ কপালে উঠবে অনেকেরই। ইংল্যান্ড দলের পক্ষে ১২তম দিনের পর আর খেলা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ ওইদিনই তাদেরকে দেশে ফেরার জাহাজ ধরতে হতো! 

ইংল্যান্ড ও স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে ম্যাচ ছিল সেটি

ম্যাচটি শুরু হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার টস জয়ের মাধ্যমে। সেই সময়ে স্বাভাবিকভাবেই টসজয়ী দলগুলো সাধারণত আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিত। প্রোটিয়ারাও হেঁটেছিল সেই পথেই। উইকেট ছিল ব্যাটিংয়ের জন্য দারুণ উপযোগী। এবং তার পুরো সুবিধাটুকু নিয়ে, ফন ডার বিজল (১২৫) ও নাওর্স (১০৩)-এর জোড়া শতকের সুবাদে ৫৩০ রানের এক বিশাল সংগ্রহ জমা করে স্বাগতিকরা।

বল হাতে ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষিক্ত পার্কস নেন ১০০ রানের বিনিময়ে পাঁচ উইকেট। জবাবে নিজেদের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি ইংল্যান্ড। দক্ষিণ আফ্রিকার ডাল্টন মাত্র ৫৯ রানে চার উইকেট নিয়ে চাপে ফেলে দেন সফরকারীদের। ফলে মাত্র ৩১৬ রানেই গুটিয়ে যায় ইংলিশদের ইনিংস। ২১৪ রানের বড় লিড পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। 

নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসেও চমৎকার ব্যাটিং প্রদর্শন জারি রাখে দক্ষিণ আফ্রিকা। এবার তারা করে ৪৮১ রান। তাদের পক্ষে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন মেলভিল (১০৩)। ফন ডার বিজল আরও একবার তিন অংকের কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৯৭ রানে সাজঘরে ফিরতে হয় তাকে। ইংল্যান্ডের পক্ষে ৭৪ রানের বিনিময়ে চার উইকেট নেন ফারনেস। 

জয়ের জন্য ইংল্যান্ডকে তাড়া করতে হতো ৬৯৫ রান। এত বড় রান তাড়া করে জয়ের ইতিহাস সেই আমলে কেন, হাল আমলেও নেই কোন দলের। তাই দক্ষিণ আফ্রিকাকেই ভাবা হচ্ছিল ম্যাচের নিশ্চিত জয়ী দল। কিন্তু ইংল্যান্ড ব্যাট করতে নামা মাত্রই উলটে যায় পাশার দান। এখন পর্যন্ত নিজেদের ইতিহাসের সম্ভবত সেরা ব্যাটিংটি সেদিন করেছিল ইংল্যান্ড। টানা ছয়দিন ব্যাট করে যায় তারা; যার মধ্যে একটি বিশ্রামের দিন ছিল, পাশাপাশি আরেকদিন বৃষ্টির কারণেও খেলা ভেস্তে যায়। 

ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে এই ম্যাচটি

ম্যাচের দশম দিনে, মাত্র পাঁচ উইকেটের বিনিময়েই ৬৫৪ রান করে ফেলে ইংলিশরা। জয়ের লক্ষ্য থেকে তখন মাত্র ৪২ রান দূরে ছিল তারা। এডরিক (২১৯) দারুণ এক দ্বিশতক হাঁকিয়ে সকল আলো নিজের দিকে টেনে নেন। অন্যদিকে ইংলিশ অধিনায়ক হ্যামন্ড (১৪০) দারুণভাবে পার্শ্বনায়কের ভূমিকা পালন করেন। বল হাতে ডাল্টন আবারও ছিলেন তার দলের সবচেয়ে সফল বোলার; ১০০ রানে দুই উইকেট নেন তিনি। 

দশম দিন চা বিরতির পর আবারও বৃষ্টি শুরু হয়। পরের দিনও ম্যাচটি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না, কারণ ওইদিন সন্ধ্যা ৮টায়ই ডারবান হতে কেপ টাউনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করতে হতো ইংরেজদের। কেপ টাউনে পৌঁছে নিজ দেশের জাহাজে ওঠার কথা ছিল তাদের। ফলে ইংরেজ অধিনায়ক হ্যামন্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকান অধিনায়ক মেলভিলের পারস্পরিক সমঝোতায় শেষ পর্যন্ত ড্র-তেই শেষ হয় ম্যাচটি। 

বেশ কিছু কারণেই ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে এই ম্যাচটি। প্রথমত, এই ম্যাচে দুই দল মিলে মোট ১৯৮১ রান করেছিল। কোন টেস্ট ম্যাচে সর্বমোট রানের রেকর্ড এটিই। এছাড়াও এই ম্যাচেই নিজের ২১তম শতক হাঁকিয়ে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের পাশে বসেছিলেন হ্যামন্ড, এবং সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিজের নাম। সেই ম্যাচের পর কেটে গেছে ৭৯ বছর। কিন্তু আজও ক্রিকেট রোমান্টিকদের মনে বিশেষ জায়গা দখল করে আছে এই ম্যাচটি।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা