আপনার আমার প্লেন নিয়ে উড়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কাজেই আমাদের দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। মনে রাখবেন, সামান্য ভুলে, অসাবধানতায় শরীরে ঢুকতে পারে মৃত্যুদূত...

দেশে একদিকে রোজ করোনায় আক্রান্ত আর মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে। অন্যদিকে সবকিছু স্বাভাবিক খোলার আয়োজন চলছে। আমাদের কপাল খারাপ- শুধু করোনা নয়, আম্পানের তাণ্ডব, লিবিয়ায় ২৬ জনের মৃত্যু, ইউনাইটেডে আগুনে পুড়ে মৃত্যু, দুবৃত্তায়ন, স্বেচ্ছাচারিতা, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অনড় অবস্থান, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ সবই দেখতে হচ্ছে। 

দেখেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ৪০ জন মারা গেলেন যা এক দিনে সর্বোচ্চ। ওদিকে আড়াই হাজার করোনা আক্রান্তকে শনাক্ত করা হয়েছে যেটা একদিনে সবচেয়ে বেশি। অবশ্য প্রায় রোজই আগেরদিনের রেকর্ড ভাঙছে। 

আমি শুধু ভাবছি দেশে এখনই মোট আক্রান্ত ৪৭ হাজার। মারা গেছেন ৬৫০ জন। সুস্থ হয়েছেন ৯ হাজার। তার মানে আরও ৩৮ হাজার এখনো অসুস্থ। নতুন করে আর কেউ যদি আক্রান্ত নাও হন তাহলে এই ৩৮ হাজার থেকে ঠিক কতোজন মারা যাবেন আমি জানি না। এই যে যারা মারা যাচ্ছে তারা ঠিক কী কারণে মারা যাচ্ছে সেটাও পরিস্কার নয়। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রোজ ব্রিফিংয়ে শুধু আক্রান্ত আর মৃত্যুর তথ্য দিচ্ছে। এর পাশাপাশি যদি রোজকার বিশ্লেষণ থাকতো! এই যেমন যারা মারা যাচ্ছে কেন মারা যাচ্ছে? এই মুহুর্তে সাধারণ মানুষদের করণীয় কী? আচ্ছা এই যে ৬১০ জন মারা গেলো সবাই কি অন্য রোগে অসুস্থ ছিল? যথাসময়ে আইসিইউ বা অক্সিজেন না পেয়ে কেউ কী মারা যায়নি? এমন হলে করণীয় কী কী? 

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি 

অনেক ডাক্তারই বলছেন, রোগীদের জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে সমাধান কী হতে পারে? আমরা কি বড় বড় ক্যাম্প টাইপ হাসপাতাল করবো? বেসরকারি হাসপাতালগুলো বিশেষ করে বড় বড় হাসপাতালগুলো কিন্তু এখনো করোনার রোগী নিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে সরকার কী ভাবছে?  

আমার নিজের ধারণা, এই সপ্তাহতেই রোগী ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। করোনা খুব সহসা যাবে না সেটাও পরিস্কার। কিন্তু রোজ যদি দেড় থেকে দুই হাজার আক্রান্ত হয় তাহলে শুধু জুন মাসেই নতুন করে আরও ৫০ হাজার লোক করোনায় আক্রান্ত হবে। তখন মোট রোগী হবে এক লাখ। আমরা তখন কী করবো? আর যদি পুরো বছরই করোনায় রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে? রোগী যদি তিন চার লাখ হয়ে যায়? চট্টগ্রামে তো দেখছি যতো পরীক্ষা হচ্ছে তার ৫০ শতাংশই রোগী। এমন হলেে কী হবে? আমার মনে হয় আমাদের এখুনি প্রস্তুতিগুলো নেয়া উচিত।  

একদিকে করোনা রোগীর সংখ্যা যখন হু হু করে বাড়ছে অন্যদিকে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে খুলে দেয়ার আয়োজন চলছে। আমার ব্যক্তিগত মত হলো ঈদের সময়টা কঠোর থাকতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সেটি তো সম্ভব হয়নি। কাল থেকে না খুলে আরও ১৫ দিন দেখতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আমার কথায় তো রাষ্ট্র চলবে না। রাষ্ট্র চলবে তার মতো করে। জীবন আর জীবিকার দ্বন্দ্বের সমাধান কী করে হবে? 

সরকার বলছে, সীমিত আকারে সব খুলবে। কিন্তু ব্যাংক, বাজার, বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান কিন্তু পুরোপুরি খুলে দেয়ার আয়োজন চলছে। সেক্ষেত্রে সমাধান কী? বাস-ট্রেনে লোকজনের নিয়ন্ত্রণ কী করে হবে? ঢাকা শহরের মুড়ির টেনমার্কা বাসের গেট দিয়ে যখন সব লোকে নামবে তখন কী হবে?  

দেখেন সবকিছুতে সরকারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের দেশের সরকারের অনেক দোষ আছে সেটা সত্য কিন্তু আমাদের নাগরিকদেরও আরও সচেতন হওয়ার সুযোগ আছে। আমি মনে করি সামনের দিনগুলোতে সেই দায়িত্বশীলতা দেখাতে হবে। সরকার যাই বলুক বা করুক মূল দায়িত্বটা নিজেদের বা প্রতিটা অফিসকে আলাদাভাবে নিতে হবে। আমাদের সবাইকে কিছু নিয়ম মানতেই হবে। 

একটা বিষয় খেয়াল করে দেখবেন সরকারি নোটিশে সবাইকে মাস্ক পরার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এটা কিন্তু বাধ্যতামূলক। আপনি আমি যেই যখন বাইরে যাবো হোক সেটা এক মুহুর্তের জন্য, তবুও মাস্ক পরতে হবে। আরেকটা জিনিষ মনে রাখতে হবে বাইরে একবার মাস্ক পরে গেলে সেই মাস্ক আর খোলা যাবে না। ফ্যাশন করার জন্য মাস্ক সরিয়ে রাখা যাবে না। 

সর্বক্ষণ মাস্ক পরে থাকতে হবে 

মাস্ক পরার পাশাপাশি যার সঙ্গেই কথা বলবেন দেখা হবে দূরত্ব রাখতে হবে। বিষয়টা এভাবে ভাবতে হবে আপনার আশেপাশে যাদের দেখছেন সবাই করোনায় আক্রান্ত। আর হাত ধুতে হবে একটু পরপর। ব্যক্তি পর্যায়ে এই বিষয়গুলো আমাদের মানতেই হবে। 

এইবার আসি করোনা পরীক্ষা নিয়ে। দেশের ৫০টি ল্যাবে পরীক্ষা হলেও এখনো আমরা দিনে দশহাজার পরীক্ষাতেই আটকে আছি। গত তিন মাসে আমরা তিন লাখ পরীক্ষাও করতে পারেনি। কিন্তু আমার মনে হয় শুধু জুন মাসেই ৩ লাখ পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা কী করে সম্ভব? সেটা সরকার ঠিক করুক। আমি মনে করি গণস্বাস্থ্য যে কিটের কথা বলছে এমন দ্রুত টেষ্ট করা কিছু লাগবে। সরকারকে বলবো দ্রুত এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিন। 

স্বাস্থ্য বিষয়ে আরেকটি কথা। সামনের দিনগুলোতে অনেক আক্রান্ত হবে। প্রচুর অক্সিজেন, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর দরকার হবে। আমি জানি না সরকার কতো দ্রুত এগুলো ঠিক করতে পারবে। 

আমি মনে করি করোনার চিকিৎসায় বেসরকারী হাসপাতালগুলোকে শতভাগ যুক্ত করা দরকার। এই হাসপাতালগুলো আগামী কয়েক মাসের জন্য প্রয়োজনে সরকার নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে নিক। প্রতিটি হাসপাতালে সরকার একজন করে তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করুক। যে হাসপাতাল-ক্লিনিক এখন চিকিৎসা দিতে অনীহা দেখাবে তার অনুমোদন বাতিল করা হোক। জাতির এই সংকটময় মুহুর্তে যে চিকিৎসা দেবে না তার এইদেশে চিকিৎসা চালানোর কোন নৈতিক অধিকার নেই। 

এবার আসি গণপরিবহন নিয়ে। সরকার বাস-ট্রেন-লঞ্চ সব চালু করেছে। এখানেই আমার ভয়। এক জেলা থেকে আরেক জেলায় বাস চলতে পারে কিন্তু ঢাকায় যেহেতু সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত এখানে বাস চলাচল করতে দেয়াটা ঠিক হয়নি। বিআরটিএ বলছে, ৫০ শতাংশ যাত্রী নেবে তারা। অথচ ভাড়া বাড়ানো হয়েছে আশি শতাংশ। এটা অনৈতিক। 

বাস্তবে যেটা হবে বাসগুলো ইচ্ছমতো যাত্রী নেবে। ঢাকার বাসগুলোর যে চালক বা সুপারভাইজার তারা যাত্রী পাবে আর নেবে না সেটা হবে না। আমার মনে হয় বেসরকারি বাস চলতে না দিয়ে সরকার যদি প্রতিটা প্রতিষ্ঠানকে তাদের বাস ভাড়া করতে বলতো এবং গণপরিবিহন হিসেবে শুধু বিআরটিসি নামাতো এবং বলে দিতো প্রতি বাসে ১৫ জনের বেশি যাত্রী উঠবে না সেটি ভালো হতো। 

আমি জানি না এখন সমাধান কী? সরকারকে বলবো বাসের বদলে মেইন রাস্তায় রিকশা চলাচলের অনুমিতি দিন। পুরো ঢাকাজুড়ে রিকশা চলুক। একেকটা রিকশায় একজন যাত্রী উঠবে এটা নিরাপদ। আর রিকশাওয়ালাদের আয়টাও দরকার। পাশাপাশি আরেকটা পরামর্শ দেব সবাই সাইকেলে চড়ুুন। আগামী কিছুদিন সাইকেলে করে অফিসে যাতায়াত করুক। সরকার এই সময় ঢাকায় বাস বন্ধ রেখে রিকশা আর সাইকেলের ব্যবস্থা করতে পারতো।  

আরও বেশ কিছু বিষয় বলার ছিল। কিন্তু লেখা বড় হয়ে যাবে বলে আর বলছি না। শুধু একটা কথাই বলবো, আপনার আমার প্লেন নিয়ে উড়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কাজেই আমাদের দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। মনে রাখবেন, কাল থেকে নিজেদের আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। 

আবারও বলছি মাস্ক-হাত ধোয়া-শারীরিক দূরত্ব মানতেই হবে। পাশাপাশি প্রতিটা সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান, বিভিন্ন বিভাগের প্রধানসহ বিভিন্ন দায়িত্বে যারা আছেন আপনারা আপনাদের কর্মীদের বিষয়ে দায়িত্বশীল হন। মনে রাখতে হবে জীবিকা আমাদের দরকার কিন্তু জীবন আগে এবং প্রতিটা জীবন আমাদের বাঁচাতেই হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ভালো রাখুন। ভালো থাকুক প্রিয় বাংলাদেশ।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা