১৩০ বছর আগে একটি নেকড়ের মাথার দাম ধরা হয়েছিল ১০০০ ডলার! যে নেকড়েটি ছিল মানুষের চেয়েও ধূর্ত, বুদ্ধিমান, কোনভাবেই বাগে আনা যাচ্ছিল না তাকে। লোবো নামের সেই নেকড়েটির সঙ্গে মিশে আছে ভালোবাসা আর হৃদয় ভাঙার করুণ এক গল্প, যে গল্প নিয়ে হলিউডে সিনেমাও বানানো হয়েছে!

যে প্রিডেটরকে নিয়ে আমি সবচেয়ে বেশি অবসেসড সেটি হচ্ছে গ্রেউলফ বা নেকড়ে। আমার খুব ইচ্ছে যে কোনদিন যদি একটি নেকড়ের সাথে বন্ধুত্ব করতে পারতাম! নেকড়ের মতো বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ স্তন্যপায়ী খুব কমই আছে। আমার ক্রেডিট কার্ড বা ফোনের ওয়ালপেপারে কিংবা শয়নকক্ষের দেয়ালে, সব জায়গায় নেকড়ের অবাধ বিচরণ। কেন? এর পেছনের গল্পই আজকে! 

প্রাচীনকালে যখন অন্যান্য প্রাণীদের মতো আমরা মানুষেরা ছিলাম অসহায় তখন বাঁচার তাগিদেই আমাদেরকে একতাবদ্ধ হয়ে বাস করতে হতো। আমাদেরকে একসাথে শিকারে যেতে হতো। খাদ্যশৃঙ্খলের একেবারে উপরে আমাদের আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো গ্রেউলফ বা নেকড়ে, কেননা তারাও দলবদ্ধভাবে শিকার করতো। আর সংঘবদ্ধভাবে একটি নেকড়ের দল এতো ভয়ঙ্কর যে কিনা যেকোন প্রাণীকেই ধরাশয়ী করতে পারে, তাদের আকার-আকৃতি যাই হোক না কেন। কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন ঘটিয়ে একদল নেকড়েকে পোষা কুকুরে পরিণত করলেও বন্য নেকড়ের সাথে আদিকাল থেকেই মানুষের  চিরস্থায়ী শত্রুতা। অনেক উপকথা ও কল্পকাহিনীতেই নেকড়ে ছিলো অশুভ আত্মার প্রতীক। 

দলবদ্ধভাবে থাকার কথায় এতক্ষণে গেইম অফ থ্রোনস এ সান্সা স্টার্কের সেই সংলাপ মনে পড়েছে নিশ্চয়ই? 'When the snows fall and the white winds blow, the lone wolf dies, but the pack survives.'

নেকড়ে সামাজিক জীব। তাদের মধ্যেও সামাজিক মর্যাদার স্তরবিন্যাস আছে। দলের প্রধানকে আমরা বলি আলফা , এবং তার সংগীকে বলি স্ত্রী-আলফা বা আলফা শীউলফ, অনেকটা রাজা-রাণীর মতো। আর সাধারণত এরা সারাজীবনের জন্য জুটি বাঁধে। আজ থেকে প্রায় দুইশো বছর আগেও উত্তর পশ্চিম আমেরিকার বহু অংশ জুড়ে রাজত্ব করতো নেকড়ের দল। আর সেই সাথে মানুষও নামে নেকড়ের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে। ফেরারী আসামীর মতোই দেখামাত্রই হত্যা, এই ছিলো মানুষের উদ্দেশ্য। ঠিক সেরকমই এক নেকড়ে শিকারের ঘটনা বলবো আজকে। 

প্রতীকী ছবি 

তার নাম লোবো, কিং অফ কারাম্পো। লোবো ও তার দল বাস করতো বর্তমান নিউ মেক্সিকোর কারাম্পো উপত্যকায়। ১৮৯০ সালের দিকে ঔপনিবেশিকদের দল এসে খামার করা শুরু করে। একদিকে যেমন বনভূমি কমতে থাকে, অপরদিকে তাদের প্রাকৃতিক শিকার বাইসন, হরিণ ইত্যাদিতে মানুষ ভাগ বসাতে থাকে। এজন্য খাদ্যের প্রয়োজনে নেকড়ের দল খামারের গবাদিপশুর উপর আক্রমণ করতে থাকে। 
লোবো ও তার দল ছিলো কারাম্পোর ত্রাস। স্থানীয় মেষপালকরা তাকে ভালো করেই চিনতো এবং সবসময় লোবোর ভয়ে তটস্থ থাকতো। তারা লোবোকে বলতো কারাম্পো উপত্যকার রাজা। ৫ বছর ধরে লোবোর দলের নেকড়েদেরকে হত্যা করার জন্য বহু চেষ্টা করা হয় এবং বলা বাহুল্য, সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। এবং নিয়মিত বিরতিতেই গবাদিপশুর উপর আক্রমণ হতে থাকে। 

এই নেকড়ের দলকে হত্যা করার জন্য স্থানীয় মানুষ গবাদিপশুর মৃতদেহে বিষ মিশিয়ে রাখে। নেকড়ের ঘ্রাণশক্তি মানুষের চেয়ে প্রায় একশো গুণ বেশি হওয়ায় তারা সহজেই বিষ মেশানো মাংস শনাক্ত করে ফেলে এবং বিষ মেশানো অংশ খাওয়া থেকে বিরত থাকে। এরপর তাঁরা শিকারীদের ডেকে আনে এবং বিভিন্ন ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে, কিন্তু সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর লোবোর মাথার মূল্য নির্ধারণ করা হয় তৎকালীন সময়ের এক হাজার ডলার! এই পুরষ্কারের লোভে বহু শিকারী আসতে থাকে এবং নানাভাবে হত্যা করার চেষ্টা করতে থাকে। 

টেক্সাস থেকে আসেন টেনেরি নামের একজন শিকারী যিনি তার নিজ এলাকায় বহু নেকড়ে শিকার করে প্রসিদ্ধ হয়েছেন। তিনি ঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্র ও একদল উলফহাউন্ড নিয়ে শিকারে বের হন। কয়েকদিন চেষ্টা করে তিনি ব্যর্থ হন, অনেকগুলো কুকুর নিহত হয় এবং তাঁর প্রাণপ্রিয় ঘোড়া মারা যাওয়ার পর তিনি টেক্সাসে ফেরত চলে যান। এরপর অনেক শিকারীই আসেন এবং প্রত্যেকেই ব্যর্থ হয়ে ফেরত যান। আর এদিকে গবাদিপশুর উপর হামলা চলতেই থাকে। বহু গরু,ভেড়া ও ছাগল মরতে থাকে।

নিরুপায় হয়ে খামারের মালিকরা বিখ্যাত শিকারী আরনেস্ট থমসন সেটনকে আসার অনুরোধ করেন। অনুরোধে সাড়া দিয়ে সেটন এবার মাঠে নামেন। তিনি কথা দেন মাত্র দুই সপ্তাহেই নেকড়ের বংশ একেবারে নির্মূল করে দিবেন। তিনি অঞ্চলটি খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে উপলব্ধি করেন যে এই এলাকায় ঘোড়া ও কুকুরের সাহায্যে শিকার করার চেয়ে ফাঁদ এবং বিষ দিয়ে চেষ্টা করাই বেশি কার্যকর হবে। তিনি নানাভাবে চেষ্টা করেন কিন্তু প্রত্যেকবারই নেকড়ের দল বিষ ও ফাঁদ এড়িয়ে যায়। ধাতব গন্ধ যেন না পাওয়া যায় এরজন্য তিনি বো নাইফ ব্যবহার করেন, হাতে দস্তানা ব্যবহার করেন, এমনকি মাংসের মধ্যে যেন তাঁর নিশ্বাস না পড়ে সে ব্যাপারে পর্যন্ত সতর্ক থাকেন। কিন্তু কোন লাভ তো হয়ই না, উল্টো তিনি আবিষ্কার করেন লোবো বিষমাখানো মাংসের টুকরোগুলো স্তুপ করে তার উপরে মলত্যাগ করে রেখে গেছে, যেন ব্যঙ্গ করা হয়েছে। লোবো ঠিক সেই সব পশুর মাংসই খাওয়া শুরু করলো যেসব সে নিজে শিকার করেছে কিংবা যেগুলোতে কোন বিষ নেই। 

এরপরে সেটন পুনোরদ্দমে পুরো একসপ্তাহ জুড়ে অনেকগুলো নতুন ফাঁদ স্থাপন করেন। পরেরদিন তিনি আবিষ্কার করেন প্রত্যেকটি ফাঁদের আশেপাশে লোবোর পায়ের ছাপ। অর্থাৎ সে নিজেই অত্যন্ত সন্তর্পণে সবগুলো ফাঁদ খুলে ফেলেছে। প্রত্যেকটি ফাঁদের আশেপাশে এমনভাবে গর্ত খুঁড়ে রেখেছে যে অন্য নেকড়েগুলো সহজেই দেখতে পারে। লোবোর অসম্ভব ধূর্ততায় বিস্মিত হয়ে স্থানীয় রাখালেরা ভাবতে শুরু করলো লোবো সম্ভবত সাধারণ কোন নেকড়ে নয়, সম্ভবত পিশাচজাতীয় কিছু কিংবা ওয়ারউলফ ওরফে নেকড়েমানব। 

আর্নেস্ট থমসন সেটন  

শুরুতে দুই সপ্তাহে ধরার ঘোষণা দিলেও চার মাসেও লোবোকে ধরতে না পারায় সেটন প্রচন্ড ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে পড়েন। এরপর হঠাত একদিন ঝর্ণার উপরে ক্যাম্প স্থাপন করার সময় নীচে তুষারের উপরে লোবোর পায়ের ছাপ দেখতে পান, এবং ঠিক তাঁর পাশে পাশেই বিস্ময়করভাবে কিছুটা ছোট ছাপ দেখতে পান। সাথে সাথেই তিনি লোবোর দুর্বলতা বুঝে ফেলেন। দিজ নটোরিয়াস বিস্ট ইজ ইন লাভ! লোবোর এই প্রেমিকাটি অসম্ভব সুন্দরী উজ্জ্বল ধবধবে সাদা একটি নেকড়ে, নাম ব্লাংকা। 

এইবার সেটন ভীন্ন কৌশলে ফাঁদ পাতলেন। তিনি অপেক্ষাকৃত দৃশ্যমান দুটি ফাঁদের মাঝখানে মাংস রাখলেন যেটা লোবো সহজেই সনাক্ত করতে পারবে। এর ঠিক পাশেই মাংস রেখে আরোও গভীর ছয়টা ফাঁদ পাতলেন। এবার লক্ষ্য লোবো নয়, ব্লাংকা। অবশেষে এই পরিকল্পনা সফল হলো। ফাঁদে রাখা বাছুরের মাথা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে ফাঁদে আটকা পড়ে ব্লাংকা। ফাঁদ থেকে বের হতে না পেরে সে করুণ স্বরে বিলাপ করছিলো, আর কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে অপলক চোখে সব দেখছিলো লোবো। তার চোখের সামনেই সেটনের সাথীরা ব্লাংকাকে হত্যা করে এবং ঘোড়ার সাথে বেঁধে নিয়ে যায়। এরপরের দুইদিন সেটন আর্তনাদের মতন লোবোর একটানা হাউল শুনতে পান। সেই হাউল সম্পর্কে সেটন লিখেন,
'an unmistakable note of sorrow in it... It was no longer the loud, defiant howl, but a long, plaintive wail.'

ব্লাংকাকে হত্যা করার জন্য যদিও সেটন তীব্র অনুশোচনায় আচ্ছন্ন ছিলেন, তথাপি তিনি লোবোকে ধরার পরিকল্পনা চালিয়ে যেতে লাগলেন। সেটন ব্লাংকার থাবা দিয়ে রাস্তায় পায়ের ছাপ তৈরি করলেন একদম খামারবাড়ি পর্যন্ত। লোবোকে ধরার জন্য খামারবাড়ির আশেপাশে প্রায় ১৩০ টি ফাঁদ পাতা হয়!  বিপজ্জনক হওয়া সত্ত্বেও ব্লাংকার ঘ্রাণ অনুসরন করে লোবো ঠিকঠাক পৌঁছায় সেই জায়গায়, যেখানে ব্লাংকার মৃতদেহ রাখা ছিলো। এবং এই সাড়ে চার মাসে শত চেষ্টা করেও যাকে ধরা যায়নি সেই লোবো বলতে গেলে স্বেচ্ছায় ধরা দেয় ফাঁদে।

১৮৯৪ সালের ৩১শে জানুয়ারি, এই ভগ্ন হৃদয়ের প্রেমিকটি জীবনে প্রথমবারের মতো বন্দী হয়। সেটন যখন এগিয়ে যান তখন মারাত্মক আহত হওয়া সত্ত্বেও লোবো অবিচলভাবে দাঁড়িয়ে থাকে এবং আকাশের দিকে তাকিয়ে আর্তনাদ করতে থাকে। লোবোর সাহসিকতা ও সংজ্ঞীর প্রতি প্রেম ও বিশ্বস্ততা সেটনকে এতো প্রবলভাবে নাড়া দেয় যে তিনি লোবোকে হত্যা করতে পারেননি। 

লোবোকে লোহার শেকলে বন্দী করে সেই খামার বাড়িতে রাখা হয়। তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করলে কিছুই খায় না, পানিও পান করে না এমনকি কারও চোখের দিকে তাকায় না পর্যন্ত। শুধু বিষণ্ণভাবে দূরে বনের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেখানে রয়েছে তার হারানো রাজত্ব। লোবো সেই রাত্রিতেই প্রাণবায়ু ত্যাগ করে, সম্ভবত প্রেমিকার বিচ্ছেদ বেশিক্ষণ সইতে পারেনি। 

লোবোর মৃত্যুর পর সেটন এই করুণ ট্রাজেডির জন্য নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারেননি। কিংবদন্তী শিকারী সেটনই হয়ে উঠেন বন্যপ্রাণী রক্ষা আন্দোলনের প্রধান পথিকৃৎ। ১৯৪৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বন্য প্রাণী সংরক্ষণের আন্দোলন করে গেছেন, মানুষকে বুঝিয়েছেন, প্রাণী শিকারে বাঁধা দিয়েছেন, ক্যাম্পেইন করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর নিউ মেক্সিকোতে তাঁর সম্মানে আরনেস্ট থমসন সেটন স্মৃতি লাইব্রেরী ও জাদুঘর করা হয়েছে এবং লোবোর চামড়া এখনও সেই জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। 

যাদুঘরে প্রদর্শিত লোবো'র চামড়া 

সেটন ও লোবোর গল্প আমেরিকাসহ সাড়া বিশ্বেই প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে। এবং এই এক লোবোই পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীর প্রতি মানুষের দৃষ্টিভংগী পরিবর্তন করতে অন্যতম ভূমিকা পালন করে। লোবোকে নিয়ে বেশকিছু সিনেমা হয়, গল্প হয়, ডকুমেন্টারি হয়। আগ্রহীরা লোবোর ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ১৯৬২ সালের মুভি 'লিজেন্ডস অফ দ্য লোবো' দেখতে পারেন। 

লোবো আমাদের শিখিয়েছে, আমরা যাদেরকে বন্য হিংস্র প্রাণী বলি তাঁদেরও আবেগ আছে, অনুভূতি আছে, প্রেম আছে। তারা হত্যা করে খাদ্যের প্রয়োজনে, বাঁচার তাগিদে। পৃথিবীতে আমরাই সম্ভবত একমাত্র প্রাণী যারা নিছক আনন্দের জন্য কিংবা খেয়াল-খুশিতে গোটা একটি প্রজাতি বিলুপ্ত করে দিতেও দ্বিধা বোধ করি না। উনিশ শতকের শেষ দিকে ও বিশ শতাব্দীর শুরুতে আমেরিকার বিশাল অংশ জুড়ে নেকড়ে বিলুপ্ত করার যে মিশন শুরু হয়েছিলো সেটি বন্ধ করতে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে এই লোবো। নেকড়েরা যদি আমাদের মতো সভ্য (?) হত, তাহলে তাদের ইতিহাসে নিশ্চয়ই ট্রাজিক হিরো হিসেবে লোবোর নাম লেখা থাকতো স্বর্ণাক্ষরে!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা