এলজিবিটি রাইট: এ যেন অন্যরকম এক বিপ্লব!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
জার্মানিতে সমকামী মানুষেরা যুক্ত হচ্ছেন রাজনীতিতে। থাইল্যান্ড, তাইওয়ানেও সমকামীদের প্রসঙ্গে শিথিল হচ্ছে বিধিনিষেধ। থাইল্যান্ডে তো সমকামীদের ফুটবল টুর্নামেন্টই অনুষ্ঠিত হয়েছে, নারীদের অনেকে সেখানে হিজাব পরেই অংশগ্রহণ করেছেন!
বিখ্যাত কম্পিউটার প্রকৌশলী 'অ্যালান টুরিং' এর জীবনী-নির্ভর সিনেমা 'দ্য ইমিটেশন গেম' দেখেননি, এমন মানুষ কম আছেন। আমার যখন এই সিনেমা দেখার সুযোগ হয়, আমি অবাক হয়েছিলাম অ্যালান ট্যুরিং এর জটিল জীবনের মারপ্যাঁচ দেখে। সমকামী ছিলেন মানুষটি। আর ঠিক এই একটিমাত্র কারণে তাকে যেভাবে পর্যুদস্ত হতে হয়েছিলো তৎকালীন সামাজিক কাঠামোর যূপকাষ্ঠে, তা জানার জন্য বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ এবং 'দ্য ইমিটেশন গেম' দেখার আমন্ত্রণ রইলো। 'এলজিবিটি' কনসেপ্ট নিয়ে সিনেমা হয়েছে অজস্র। এই সাহসী বিষয়ে সিনেমা বানানো শুরু হয়েছে তাও কম দিন হলোনা। ১৯১৯ সালে প্রকাশিত 'ডিফারেন্ট ফ্রম দ্য আদার্স' সিনেমাটির কথা বলা যায়। সমকামিতা নিয়ে যেটি ছিলো প্রথম সিনেমা এবং যে সিনেমা মুক্তির পরে জার্মানিতে শুরু হয়েছিলো তুমুল আলোড়ন। হবে নাও বা কেন? জার্মানির সেই সময়ের সমাজ কাঠামোকেই যেন নাড়িয়ে দিয়েছিলো সিনেমাটি। থিয়েটার থেকে সিনেমাটি নামানোর দাবীও উঠেছিলো জোরেসোরে। জার্মানিতে সমকামিতা ছিলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ আর এ সিনেমাটি সমকামিতার পক্ষেই। কিন্তু তবুও সিনেমাটি বন্ধ করা যায় নি সেখানে।
এ তো ১৯১৯ সালের ঘটনা। সে সময়ের মানুষ ধরলাম নাহয় একটু সংকীর্ণমনা ছিলো। কিন্তু এখনকার মানুষের কী অবস্থা? কয়েকদিন আগে 'Prayers For Bobby' নামে একটা সিনেমা দেখলাম। সমকামী ছেলের মৃত্যুর পরে মা হয়ে যান 'গে-রাইট এক্টিভিস্ট।' তা নিয়েই গল্প। তো যাই হোক, সিনেমা শেষ করে রিভিউ লিখলাম। রিভিউ লিখে সিনেমার একটা বেশ বড়সড় গ্রুপে পোস্ট করার পর, যেরকম সমাদর পেলাম, কিছুটা সংশয়েই ছিলাম। লোকজন পারলে আমাকেই সমকামী বানিয়ে ফেলে আর কী! বুঝলাম, এই ব-দ্বীপে আদ্যিকালের সেই ধ্যানধারণা খুব একটা পাল্টায়নি। এখানের মানুষজন যে তিমিরে, সে তিমিরেই রয়ে গিয়েছে।
সিনেমা দিয়ে উদাহরণ টানার কারণ- ঋত্বিক ঘটক একবার বলেছিলেন, সমাজের পরিবর্তন সিনেমার মাধ্যমে খুব সহজেই বোঝা যায়। সে হিসেব করলে, আমরা ঠিক কবে নাগাদ 'এলজিবিটি' নিয়ে সচেতন বা শিক্ষিত বা উদার মানসিকতার হবো, জানি না। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, এই বিষয়টিতে বিভিন্ন দেশ তাদের কট্টর ধ্যানধারণা থেকে ক্রমশ সরে আসছে। যেমনটি বললাম- জার্মানির কথা। জার্মানির সেই 'সমকামিতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ' আইনটি বাতিল করা হয়েছে পরবর্তীতে এসে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এই গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল মানবিক সম্পর্কের প্রসঙ্গে ক্রমশই শিথিল করছে তাদের আইনকানুনের জটিলতা।
এরকমই একটি দেশ থাইল্যান্ড। সে দেশের একজন সমকামী মানুষের গল্প শোনা যাক প্রথমে। মানুষটির নাম আন্তিচা৷ তার জন্ম থাইল্যান্ডের পাত্তানি শহরে। জীবনের একটা বড় সময় সে তার 'সমকামী' পরিচয় চেপে রেখে বসবাস করে গিয়েছে। অথবা বসবাস করার অভিনয় করে গিয়েছে। কারন, সমকামীতাকে থাইল্যান্ডে দেখা হতো বাজে চোখে। নিজের ভেতরের কথা যে মুখ ফুটে বলবেন, সে সাহসও ছিলো না আন্তিচার।
এরপর অনেক বছর কেটেছে। নিজের শহরেই একটি বইয়ের দোকান দিয়েছে আন্তিচা। যে দোকানে তিনি তার মত মানুষজনের সাথে মিলে কথা বলেন বই নিয়ে, লিঙ্গ নিয়ে, যৌনতা নিয়ে। আস্তে আস্তে তার দোকানে তিনি পেয়ে যান তার মত কিছু মানুষকে। তাদেরকে সাথে নিয়ে খুলে ফেলেন একটি ফুটবল ক্লাব। সেই ফুটবল ক্লাবে সমকামী, উভকামী নারীরা খেলতে আসা শুরু করে৷ আস্তে আস্তে মানুষ বাড়তে থাকে। তাদেরকে নিয়েই সম্প্রতি হয়ে গেলো টুর্নামেন্ট। যে খেলায় এলাকাবাসী এসে সমর্থনও দিয়েছে তাদের। মানুষজন মেনে নিয়েছে এই মানুষগুলোকে। আন্তিচার কাছে একসময়ে যা ছিলো অচিন্তনীয় বিষয়, সেটাই আজ হয়ে গিয়েছে সত্যি!
জার্মানির মত একটা সময়ে থাইল্যান্ডেও সমকামিতাকে ধরা হতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে। থাইল্যান্ডও সরে এসেছে তাদের সেই জায়গা থেকে। থাইল্যান্ডের মন্ত্রীসভা সমলিঙ্গের মানুষের সম্পর্ককে দাম্পত্য জীবনের সমান মর্যাদা দিয়ে সিভিল পার্টনারশিপ বিল অনুমোদন দিয়েছে। যদি বিলটি পাশ হয়ে আইনে পরিনত হয়, তাহলে তাইওয়ানের পরে দ্বিতীয় দেশ হবে থাইল্যান্ড, যারা সমলিঙ্গের মানুষের দাম্পত্য নিবন্ধনের অনুমতি দিয়েছে। এছাড়াও থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক দলগুলোতেও সমকামী মানুষজনের উপস্থিতি বাড়ছে। বাড়ছে জার্মানিতেও। বাড়ছে আরো কিছু দেশে।
একটা মানুষ কোথায় থাকবে, কী পরবে, কী খাবে, এগুলো তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। যতক্ষণ পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ রাষ্ট্রের ক্ষতি না করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রের কোনো অধিকারই নেই, কারো স্বাধীনতা অথবা ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দে হস্তক্ষেপ করার৷ এলজিবিটির মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিভিন্ন দেশ যে ক্রমশ সচেতন হচ্ছে, এটা আসলে খুবই ইতিবাচক এক বিষয়। আশা করি, মানুষের ধ্যানধারণা পরিবর্তন হবে, সমাজেরও প্রথাগত চিন্তাভাবনার পরিবর্তন হবে। তাহলেই ভালো হবে সবার।
রাষ্ট্রীয় নানা পদক্ষেপে মানুষের সামগ্রিক এই কল্যানই প্রত্যাশা করি কায়মনোবাক্যে।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন