'দোস্ত তুই কোন হাত দিয়ে খাবার খাস?', 'দোস্ত কিছু মনে করিস না, তুই শৌচকার্য করিস কোন হাত দিয়ে?'- এই দুইটা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়নি, এমন বাঁহাতি মানুষ বোধহয় উপমহাদেশের খুঁজে পাওয়া যাবে না...
তিয়ান্না আশিক প্রাপ্তি: চামড়ার শেড, শারীরিক গঠন, জেন্ডার ডিস্ক্রিমিনেশন, প্রভৃতি টপিক নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে ট্যাবু ভাঙা শুরু করলেও অনেকগুলো 'লেস টকড ম্যাটার' এর মধ্যে একটা হচ্ছে- বায়াসনেস এগেইন্সট লেফট হ্যান্ডেড পিপল।
আমি আসলে ভাগ্যবানই বলবো নিজেকে, যে এসব বিষয় আমার জীবনে খুব একটা নেগেটিভ ইম্প্যাক্ট ফেলতে পারে নাই কখনো, যদিও আমার এক্সপেরিয়েন্স খুব একটা ভালো না। কিন্তু এটা একটা ইস্যু, যা আমার ট্যাবু বলেই মনে হয় যেটা ভাঙা শুরু হওয়া দরকার। কারণ আমরা নিজেদের অজান্তেই বিষয়টাকে প্রোমট করে ফেলছি। আমার নিজের সাথে ঘটে যাওয়া কয়েকটি উদাহরণ দিয়েই বলছি-
১। ছোটবেলা থেকে প্রতিটা বোর্ড এক্সামে এক্সটার্নাল টিচার গার্ড হিসেবে পড়লে কমপক্ষে ৩-৫মিনিট নষ্ট হয় হাসিমুখে এটা এক্সপ্লেইন করতে যে কেন আমি ডান হাতে না লিখে বাঁ হাতে লিখি। এটা খুবই কমন একটা সিনারিও আর আমি খুব একটা আনকম্ফোর্টও ফিল করি না।
কিন্তু এই রিসেন্টলি ৩-২ টার্ম পরীক্ষার সময় একজন আমাদের ইউনিভার্সিটিরই স্যার গার্ড দিচ্ছিলেন। পরীক্ষা চলাকালীন সেইম ওল্ড কেন এর উত্তর দেওয়ার পর তাঁর বক্তব্য এমন ছিল- 'মা, তুমি আমার মেয়ে হলে তোমারে লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়ে দিয়ে ডান হাতে লেখা শিখাতাম হাহাহাহা!' আমি তাঁকে একদমই দোষ দিচ্ছি না, তিনি তাই বলেছেন যা তিনি ধারণ করেছেন।
২। আমার মতোই আমার আব্বা-আম্মা সবসময় সবাইকে ব্যাখ্যা করে গেছে যে না, আমার ডান হাতে কোনোই ঝামেলা নেই, ডান হাত দিব্বি সুস্থ হাত। তবে আমি যখন একবারে পিচ্চিকালে বাম হাতে কলম-পেন্সিল নিয়ে দাগানো শুরু করেছিলাম, আমার আম্মু আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে বাম হাতে লেখা কি পরিবর্তন করাবে কি না। আমার ভাগ্য ভালো ছিল, ডাক্তার বলেছিলেন- পরিবর্তন করার কোনো দরকার নেই, জোর করে পরিবর্তন করতে গেলে ব্রেইনে চাপ পড়ার সুযোগ থাকে।
ওনাকে আমি চিনি না, কিন্তু সারাজীবন ওনার প্রতি কৃতজ্ঞতা থেকে যাবে তাঁর এই দুই লাইনের জন্য। পরে পড়ে দেখেছিলাম ডিজলেক্সিয়া, স্টাটারিং, স্পিকিং ডিজঅর্ডার এর স্বীকার হয় বাচ্চারা এর কারণে। কিন্তু কথা হচ্ছে আমার আম্মুর মাথায় যে এই দুশ্চিন্তাটা এসেছিল যে- বাম হাতে লিখে, ডাক্তারের কাছে দেখিয়ে নিয়ে আসি, এটা এই ট্যাবুর জন্যই।
ডাক্তার দেখানো মোটেই খারাপ কিছু না। কিন্তু ট্যাবুটা না থাকলে হয়তো আমার আম্মু এরকমটা করতো না, ঠিক যেমন ডান হাতে লেখা বাচ্চাকে নিয়ে কেউ ডাক্তারের কাছে যায় না বাচ্চা কেন ডান হাতে লিখে জিজ্ঞেস করতে!
৩। 'তোর বিয়ে হবে না/টিকবে না' নামক ১০০০ টা কারণ দর্শানো বই এর লেখিকা আমার ভালোবাসার ব্রাউন মম। আমি এখন রান্নাবান্নার প্রতি যত উদাসীন, ছোটবেলায় এত ছিলাম না। সেইসময় আমার দাদুর সাথে রান্নায় হেল্প করতাম। তখন আমার আম্মা বলতো, 'বাম হাতে খুনতি ধরে খাবার রান্না করলে শাশুড়ী ঠুন্না মারবে। ঘেন্নায় কেউ তোর বানানো খাবার যখন কেউ খাবে না, তখন বুঝবি ঠেলা!'
এটা শুনে খুব রাগ লাগতো। ভাবতাম ড্যাবরা (যারা বা হাতে লিখে তাদের বলে অনেকে) শাশুড়ী ওয়ালা ঘরে বিয়ে করবো।
৪। কোনো কিছু ডান হাতে দেওয়া, ডান হাতে নেওয়া, বিশেষ ক্ষেত্রে ডান হাতে না নেওয়ার স্পেফিফিক কিছু কারণ থাকলে (হাতে কোনো কিছু থাকলে যা জিনিসটায় লেগে যেতে পারে ধরলে, যেমন খাবার) ডান হাত দিয়ে বাম হাত ছুয়ে এরপর বাম হাত দিয়ে নেওয়া ইত্যাদি - ছোট বেলা থেকে শিখে এসেছি, এইগুলা ভদ্রতা বা বলা যায় ম্যানারিজম।
কেন স্পেসিফিকলি বাঁ হাতে দেওয়া-নেওয়া অভদ্রতা এটা জিজ্ঞেস করে কখনো মানানসই উত্তর না পেলেও এই ভদ্রতা শিখতে প্রচুর স্ট্রাগেল করেছি। অনেক বছর পর্যন্ত (সম্ভবত ক্লাস ১০-১২ পর্যন্তও) এই 'ভদ্রতা' দেখাতে ভুলে যেতাম আর জাজমেন্টের স্বীকার হতাম। এমন না যে চেষ্টা করতাম না। অনেক চেষ্টা করতাম, কিন্তু ওইযে ইন্টার লেভেল এর অংকের মতো আয়ত্ত করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল।
এখন প্রতি স্টেপে এই ভদ্রতা দেখাতে শিখে গেছি ঠিকই, তবুও জানিয়ে রাখি- আপনাদের বেশিরভাগের মতো এটা আমার ন্যাচারাল রিফ্লেক্স না। এখনো আমার ব্রেইনের সময় লাগে আমাকে ডান হাতে জিনিস দিতে-নিতে অর্ডার করতে। সার্কাসের বাঘ সিংহ যেমন লাঠির ভয়ে ট্রিক্স দেখায়, আমিও জাজমেন্ট এর ভয়ে এই ইজি ট্রিক দেখায় দেই।
৫। এতক্ষণ কথা শুনে হয়তো মনে হতে পারে এগুলা আমাদের আগের জেনারেশনের মধ্যে প্রকট ছিল, এখন এগুলো ইস্যু না মোটেই। কিন্তু আমার জীবনের ৮০% বন্ধুবান্ধব যখন জানতে পেরেছে যে আমি বাঁ হাতে লিখি, তাদের প্রথম কথা হচ্ছে- 'দোস্ত দুইটা প্রশ্ন করবো?' আর আমি প্রিটি শিওর আপনি লেফটি হোন, আর রাইটি; প্রশ্ন দুইটা অনুমান করে ফেলেছেন। হ্যাঁ, এ দুটোই। দোস্ত তুই কোন হাত দিয়ে খাবার খাস? দোস্ত কিছু মনে করিস না তুই শৌচকার্য কোন হাত দিয়ে?
এই প্রশ্ন দুইটার সাথে এই উপমহাদেশের সব বাম হাতি'রা অভ্যস্ত বা পরিচিত আমার মনে হয়। এই প্রশ্ন দুইটা করায় এক পারসেন্টও ইনএ্যাপ্রোপ্রিয়েটনেস দেখি না আমি। যে কেউ এই প্রশ্ন করতেই পারে এতে এক ফোঁটাও লজ্জার কিছু নাই। কিন্তু এখানে দেখার বিষয়টা হলো মানুষের কিউরিওসিটি।
প্রশ্নগুলো অনেকটা মেয়েদেরকে প্রতিদিন 'রোজা আছেন?' জিজ্ঞেস করার মতোই। বাম হাতি'দের লাইফ লিড নিয়েও মানুষের ভিতর কিউরিওসিটি কাজ করে। ট্যাবুগুলো ভাঙার সাথে সাথে এগুলো স্বাভাবিক হয়ে যাবে এই আশা করি আমি। আমি জানিনা হোয়াই ডাজ ইট ইভেন ম্যাটার যে আমি কোন হাতে খেলাম, আর কোন হাতে ছুচলাম!
এই প্রশ্নগুলো এটাই বোঝায় যে আমাদের জেনারেশনের মধ্যেও বাঁ হাত নিয়ে নেগেটিভ চিন্তাগুলো স্লোলি পুশড হয়েছে।
৬। বামকে অশুভ, ডানকে শুভর প্রতীক ধরা হয়। প্রতীকিকরণের একদমই বিপক্ষে না আমি। কিছু না কিছু দিয়ে নির্দেশ তো করতেই হয়। বাম অশুভ না হয়ে ডান কেও অশুভ ধরতে পারতো চাইলে মানুষ।এটা আলাদা কিছু না। যেমন '২'কে যদি আমরা '১' বলে শিখতাম, তাহলে এটাই এক- এর প্রতীক হতো। বা কালো ভয়ের প্রতীক আর সাদা শুদ্ধতার প্রতীক না হয়ে উল্টোটাও হতে পারতো।
প্রতীক ব্যবহার হয় বোঝার সুবিধার্থে বা তুলনা করতে। কিন্তু আমরা প্রতীককে অতিরিক্ত সিরিয়াসলি নিয়ে নেই এবং এক দল আরেক দলকে ডোমিনেট করা শুরু করি। এইকারনেই বোধহয় আমরা শিখে আসছি যে বাঁ হাতে কিছু করা অশুভ, কালো বিড়াল মানেই ভয় বা নারী মাত্রই নমনীয় হতে হবে। প্রতীকের আসল কন্সেপ্টটাই গুলিয়ে ফেলেছি। শুধুমাত্র বাঁ হাতে কাজ করি বলেই 'ছিহ' ও শুনেছি।
৭। লেফট হ্যান্ডেড মানুষদের যে শুধু মেন্টাল সিচুয়েশনই হ্যান্ডেল করতে হয়, এমনটা মোটেই না। আমাদের ডেইলি লাইফে এমন অনেক জিনিসপাতি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা সংখ্যালঘু। সবচেয়ে সাধারণ উদাহরণ হলো এডুকেশনাল ইন্সটিটিউশনগুলোর ডেস্ক।
আমি দেখেছি অনেকেই ভাবে এটা কী এমন বিগ ইস্যু! বাম সাইড দিয়ে লেখা যায় না এমন তো না। কিন্তু নিজেরা এক্সপেরিয়েন্স করলে বোঝা যায় যে চেয়ারের সাথে এ্যাটাচড বোর্ডটার বাম সাইডে সাপোর্ট থাকে না বিধায় বা হাতের চাপ পড়ার সাথে সাথে বাঁ দিকে ঢালু হয়ে যায় বোর্ডটা। সোজা রাখতে হাতের পুরো প্রেশার বোর্ড এর উপর ফেলা যায় না, হাত উচু করে লিখতে হয়, এতে লিখতে টাইম বেশি লাগে।
আর না হয় আমি একটা কায়দা আবিষ্কার করেছি, জানি না অন্য কেউ ট্রাই করেছে নাকি, এক হাঁটুর উপর আরেক হাটু দিয়ে বোর্ড এর তলার সার্ফেস রিচ করার চেষ্টা করি যাতে সাপোর্ট পায়!
কাঁচি, আর ছুরি। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় যে একই তো। ডান হাতের জায়গায় বাঁ হাতে করলেই হয়। কিন্তু খেয়াল করলে বুঝবেন ছুরি-কাঁচির যে ব্লেড, ওইটা দুই সাইডে দুই রকম। এক সাইড সোজা, এক সাইড একটু বাঁকানো থাকে। এটা ডান হাতে যারা কাজ করে তাদের ফেবারে বানানো। বাম হাতে ছুরি কাঁচি ধরে সেইম প্রোসেসে কাজ করলে রেজাল্ট সেইম আসে না। বিশ্বাস করেন আর না করেন।
কিছু কিছু কাঁচিতে আবার হ্যান্ডেলের ফুটা দুইটাও এমন শেইপে থাকে যে ডান হাতের বুড়া আংগুল একটায় আর বাকি আংগুলগুলা অন্যটায় দেওয়া যায়। এইটাকে উল্টাভাবে ব্যবহার করা যায় না। সেইম গোজ ফর কালার প্যালেটস। লেফট হ্যান্ডেড আর্টিস্টরা রিলেট করতে পারবেন যে আর্টিস্টস কালার প্যালেটগুলো রাইট হ্যান্ড ফ্রেন্ডলি হয় (অর্থাৎ যাতে আপনি ডান হাতে আঁকতে পারেন এবং বা হাত দিয়ে প্যালেট ধরতে পারেন এবং প্রোপার গ্রিপ পান)। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইজেলে কাজ করার সময় ডান হাতে এই প্যালেটগুলো ধরে হাতে গ্রিপ রাখা প্রচুর প্যাথেটিক।
স্কাল্পচার ডিসিপ্লিনে পড়ার কারণে লাইফে একটু আধটু গ্রাইন্ডার মেশিন নিয়ে কাজ করা শুরু করেছিলাম। গ্রাইন্ডার মেশিনগুলোও রাইট হ্যান্ড ফ্রেন্ডলি আর আমি নিজে বাঁ হাতে ব্যবহার করে ফিল করেছি যে বাঁ হাতে ব্যবহার করা তুলনামূলক বেশি রিস্কি।
আমি জানি যে লেফটিদের জন্যে অলটারনেটিভ অপশন আছে এবং তৈরিও হয় সাফিশিয়েন্টভাবে। কিন্তু স্যাডলি আমি আজ পর্যন্ত যেই গুটি কয়েক জায়গায় আমার প্রয়োজন অনুসারে জিনিস খুঁজেছি, বেশিরভাগ প্রোভাইডাররা লেফট হ্যান্ড ফ্রেন্ডলি প্রোডাক্ট আছে বলে জানেই না বা আনলেও বিক্রি হবে না বলে ধারণা রাখে।
বাইরে থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস অর্ডার করে আনা আমার কাছে খাজনার থেকে বাজনা বেশি লাগে। যেমন আমার ২-৩ মাস পরপর টুথ ব্রাশ চেইঞ্জ করতে হলে প্রতিবার বাইরে থেকে অর্ডার করা ব্যয়বহুল ওরাকম ই। সবার কাছে বাম হাতে লেখার ব্যপার টা জেনেরালাইজ হলে এই সমস্যা আর থাকবে না একদিন এইটাও আমি আশা করি।
আমি আমার জীবনে যেই কয়জন বাম-হাতি হেটার দেখেছি, তার থেকে ৫০ গুন বেশি বাম হাতি লাভারদের দেখেছি। খারাপের থেকে ভালো এক্সপেরিয়েন্স অনেক বেশি। ওগুলো নিয়ে অন্য কোনো একদিন কথা হবে। কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের এই জেনারেশনও লো কি এই ব্যপারগুলো নিজেদের ভিতর ক্যারি করছি। এবং আমরা এওয়ারও না এইটা নিয়ে। আমার এমন না হলেও ১০০ জনের সাথে কথা হইসে এই ছোট্ট লাইফের ছোট্ট সার্কেলে, যারা আমাকে বাম হাতে লিখতে দেখে স্বীকার করেছে যে, 'আমিও ছোট বেলায় বা হাতে লিখতাম, আব্বু পিটায় ডান হাতে লেখা শিখাইসে!'
আমরা নিজেদের অজান্তে এইগুলা ক্যারি করে নিয়ে নেক্সট জেনারেশনকেও সাফার করাবো। আমরা হয়তো অন্যকে বা হাতে লিখতে দেখে অবাক হই কিন্তু দেখা যাবে নিজের বেলায় এসে নিজের বাচ্চাকে 'সঠিক' টা শেখাতে চাবো। এই ডান হাতে লেখা শেখানোর ক্রেইজের জন্যে হয়তো লেফট হ্যান্ডেড মানুষের সংখ্যা এই সাব কনটিনেন্টগুলোতে ৫% এরও কম যতদূর জানি।
আমার লম্বা লম্বা লেকচার দেওয়া অভ্যাস না, ঘরে থাকতে থাকতে সব কিছু শুরু করে দিসি, এই লম্বা লেখার উদ্দেশ্য একটাই। যদি কোন একজন ও এইটা পড়ে এখন থেকে মাথায় সেট করে রাখে যে 'আমার বাচ্চাকে ফোর্স করবো না এই বিষয়ে এক ফোটাও' তাহলে হয়ত আমি যতটুকু যা স্ট্রাগেল করেছি, তার থেকেও কম স্ট্রাগেল করবে বাচ্চাটা।