লেবাননের সরকারের পদত্যাগ ও আমাদের আকাশ কুসুম কল্পনা
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বিস্ফোরণের দায়ভার কাঁধে নিয়ে লেবাননের পুরো সরকার পদত্যাগ করেছে। স্বাধীনতার পদ থেকে আজ পর্যন্ত এদেশের কয়জন জনপ্রতিনিধি ব্যর্থতার দায়ভার কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করেছেন, বলুন তো? আমাদের নেতাদের কাছে সবার ওপরে 'পদ' সত্য, তাহার ওপরে আর কিছু নাই...
লেবাননের সরকারব্যবস্থায় যে বড় রকমের একটা পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে, সেটা অনুমেয় ছিল। বিস্ফোরণের প্রাথমিক ধাক্কার পর স্বাভাবিকভাবেই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবী উঠেছে, সেই দাবী গিয়ে পরিণত হয়েছে সরকারবিরোধী একটা মানসিকতায়। লেবাননের, বিশেষ করে বৈরুতের বাসিন্দারা- যারা এই বিস্ফোরণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, প্রাণ হারিয়েছে, সম্পদ খুইয়েছে, তাদের বেশিরভাগই বলছিলেন, এই সরকারের ক্ষমতায় থাকার কোন নৈতিক অধিকার আর নেই।
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের সেই সেন্টিমেন্ট এবং দাবীর প্রতি সম্মান জানিয়েই পদত্যাগ করেছেন লেবাননের গোটা সরকার, প্রধানমন্ত্রী হাসা দিয়াব নিজে পদত্যাগ করেছেন, তার আগে ভেঙে দিয়েছেন মন্ত্রিসভাও। প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন অবশ্য নতুন একটি মন্ত্রিসভা গঠন না হওয়া পর্যন্ত দিয়াব সরকারকে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ হিসাবে থাকার অনুরোধ করেছেন। হাসান দিয়াব এখনও এই প্রস্তাবের বিপরীতে হ্যাঁ বা না কিছুই বলেননি।
বিস্ফোরণের ঘটনাটা লেবানন তো বটেই, গোটা বিশ্বকেই স্তব্ধ করে দিয়েছে। সাতাশশো টনের বেশি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট কোন ধরণের প্রোটেকশন ছাড়াই বন্দরে পড়েছিল ছয় বছর ধরে, গোটা ব্যাপারটাই শুনতে অবিশ্বাস্য লাগে। বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত সবার গাফেলতি ছিল এই ঘটনায়। বিস্ফোরণের পর সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা একে একে পদত্যাগ করতে শুরু করেছিলেন, প্রথমে তথ্য ও পরিবেশ মন্ত্রী, তারপর দেশটির আইনমন্ত্রী পদত্যাগ করেন এই ঘটনায়। লেবাননের অর্থমন্ত্রীও পদত্যাগ করতে পারেন বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। এরইমধ্যে হাসান দিয়াব মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে পুরো সরকার ব্যবস্থাকে নিয়েই পদত্যাগ করলেন।
বিদায়ী ভাষনে দিয়াব বলছিলেন, ‘‘আজ আমরা জনগণের ইচ্ছাকে অনুসরণ করছি। জনগণ সাত বছর ধরে লুকিয়ে রাখা এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার চায়। তারা সত্যিকারের পরির্তন চায়। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে....আমি আজ এই সরকারের পদত্যাগ ঘোষণা করছি।” এখানে জানিয়ে রাখি, লেবাননের এই সরকারের মেয়াদ কিন্ত বেশিদিন হয়নি, মাত্র আট মাস আগে, গত জানুয়ারিতে ইরান সমর্থিত প্রভাবশালী হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী ও এর মিত্রদের সমর্থন নিয়ে লেবাননের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল। সে সময় টানা কয়েক মাসের অচলাবস্থার পর হাসান দিয়াব প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন।
কিন্ত এত বড় দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানির পর ঠিকই হাসান দিয়াব এবং তার মন্ত্রীসভার সদস্যরা ঘটনার দায়ভার মেনে নিয়ে পদত্যাগ করলেন। চাইলে তারা বলতে পারতেন, আমাদের আগে যারা ক্ষমতায় ছিল, এটা তাদের দোষ। তারা সাড়ে পাঁচ বছর ধরে দেশকে অচল করে রেখেছিল, তারা এদিকে নজর দেয়নি বলেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। অথবা চাইলে বন্দর কর্তৃপক্ষের ঘাড়ে একচেটিয়া দোষ চাপাতে পারতেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে সবাইকে জেলে পাঠিয়ে নিজেদের গা বাঁচাতে পারতেন।
কিন্ত দিয়াব এবং তার মন্ত্রীসভার সদস্যরা যেটা করেছেন, সেটাই সভ্য সমাজের গণতান্ত্রিক একটা দেশেএ রাজনৈতিক নেতা এবং জনপ্রতিনিধিদের করা উচিত। ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় এমনটাই হয়, সেখানে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে ওই ক্ষেত্রের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল ব্যক্তিটি পুরো ব্যাপারটাকে নিজের ব্যর্থতা হিসেবে স্বীকার করে পদ থেকে সরে যান, তিনি মেনে নেন যে, এই পদে থাকার নৈতিক অধিকার তার নেই।
ইউরোপ-আমেরিকায় কেন যাচ্ছি, সেই পঞ্চাশের দশকে এই উপমহাদেশে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী নামের এক রাজনীতিবিদ রেলমন্ত্রীর চেয়ার থেকে পদত্যাগ করেছিলেন ট্রেন দুর্ঘটনার পর, অথচ ট্রেন দুর্ঘটনায় তার কোন ভূমিকা ছিল না। কিন্ত তিনি যেহেতু রেল মন্ত্রণালয়ের সুপ্রীম পার্সোনেল, ব্যর্থতার জবাবদিহি সবার আগে তাকেই দিতে হবে- এই বোধ থেকেই তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। এটা একটা ন্যাচারাল প্র্যাকটিস, সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্টে এই চর্চাটা বজায় থাকে সবসময়ই।
লাল বাহাদুর শাস্ত্রীরা ইতিহাস হয়ে গেছেন, লেবাননের কীর্তিটাকেও দূর গ্রহের ঘটনা বলে মনে হয়, যখন নিজের দেশের দিকে তাকাই। পদত্যাগ বলে কোন শব্দ এদেশের রাজনীতিবিদ বা জনপ্রতিনিধিদের ডিকশনারিতে নেই। দুর্ঘটনা ঘটলে অন্য দেশে দায় নেয়ার হিড়িক পড়ে, আর আমাদের এখানে শুরু হয় দায়মুক্তির খেলা। একজন আরেকজনের দিকে আঙুল তুলতে থাকে, সময় গড়ায়, নতুন ইস্যু আসে, বা নিয়ে আসা হয়- তারপর আমাদের গোল্ডফিশ মেমোরি ঘটনাটা বেমালুম ভুলে যায়।
এই যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ে এত অভিযোগ, করোনাকালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভেঙে পড়া, রিজেন্ট সাহেদ, আরিফ-সাবরিনার জেকেজি কেলেঙ্কারী- এত কিছুর পরেও কি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান ব্যক্তিটির মাথায় কখনও এসেছে যে, সম্মানের সাথে পদটা ছেড়ে দেয়ার সময় তার হয়েছে? করোনা দেশে আসার দুই মাস আগে থেকেই যিনি 'আমরা প্রস্তুত, আমরা প্রস্তুত' বলে মুখে ফেনা তুলেছিলেন, সেই প্রস্তুতির নমুনা আমরা দেখেছি পরে। একেকটা হাসপাতালের কি বেহাল অবস্থা, করোনা টেস্ট থেকে শুরু করে চিকিৎসকদের মাস্ক-পিপিই সরবরাহ- প্রতিটা জায়গা অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। এক রিজেন্ট লিজেন্ডের কীর্তি সামনে এসেছে, আরও কত সাহেদ-সাবরিনারা ঘাপটি মেরে বসে আছেন আমরা তো জানিই না।
অথচ পদত্যাগ তো দূরের কথা, কর্তাব্যক্তিরা উল্টো নিজেদের গা বাঁচাতে আইন জারী করে হাসপাতালে অভিযান চালানোই বন্ধ করে দিয়েছেন! যাতে আর কোন সাহেদ কীর্তি ফাঁস না হয়! মহামান্য মন্ত্রী আবার প্রশ্নও তুলেছেন, হাসপাতালে অভিযান চালানোর কি আছে? হাসপাতালে অভিযান না চালালে অব্যবস্থাপনার চিত্রটা উঠে আসবে কীভাবে, সেবার নামে ব্যবসার নোংরা খেলায় যারা মত্ত হয়েছে তাদের মুখোশ উন্মোচন কীভাবে হবে- এই প্রশ্নের জবাব মন্ত্রীর কাছে কেউ জানতে চেয়েছেন কিনা আমাদের জানা নেই।
স্বাস্থন্ত্রীকে একা দোষ দিয়ে লাভ নেই। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত কয়জন মন্ত্রী ব্যর্থতার দায়ভার মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেছেন এদেশে? নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না। পদত্যাগের কালচারটাই নেই আমাদের এখানে, আছে যে কোন মূল্যে পদ আঁকড়ে ধরে রাখার, আর সবকিছুতে বিরোধী দলের দোষ খোঁজার সংস্কৃতি। তাজরীন, রানা প্লাজা, বিডিআর বিদ্রোহ, সাগর-রুনি হত্যা, বিশ্বজিত হত্যাকান্ড, হাজার হাজার সড়ক দুর্ঘটনা- কোন ঘটনায় দায়ভার কাঁধে নিয়ে কখনও পদত্যাগ করতে শুনেছেন কাউকে? ব্যর্থতাকে আমরা স্বীকার করি না, কাজেই পদত্যাগের প্রশ্নও আসে না। লেবাননের ঘটনা আমরা দেখেই যাব, এখান থেকে শেখার কিছু নেই। কারণ আমাদের নেতাদের কাছে সবার ওপরে 'পদ' সত্য, তাহার ওপরে আর কিছু নাই। আমাদের দেশে কেউ ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করবে- এটা আকাশ কুসুম কল্পনার চেয়েও বাড়াবাড়ি।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন