আমি কারও দিকে তাকিয়ে থাকি না। আমার এখান থেকে কাঁদলে গণভবন পর্যন্ত শব্দ যায় না। আমার গ্রামে সকালে যার পেট খালি থাকে তাকে সন্ধ্যার পর ভাত দিলে হবে না। সকালের ভাত অন্তত দুপুরের আগে দিতে হবে। আপনাদের কাগজ কলমের হিসাব আমি বুঝি না। আমি আমার এলাকার দায়িত্ব নিছি, আপনারা বাংলাদেশের দায়িত্ব নেন।

কাল রাতে চন্দ্রপুরের উপর দিয়ে একটা ছোটখাটো ঝড় বয়ে গেছে। কিন্তু বড় ঝড় বয়ে গেছে বিকেলবেলা। সেই ঝড়ের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন থানার ওসি আর ইউএনও। ৬৩০ বস্তা চুরি যাওয়া চাল নিজের বাড়িতে নেয়ার অভিযোগ শুনে তারা এসেছিলেন।

চন্দ্রপুর ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের মানুষজন চাঁদের আলোর চেয়ে সূর্যের আলো বেশি পছন্দ করে। দিনের মত পরিষ্কার তাদের মাথার ভেতরটা। একদিনে হয় নি, ধাপে ধাপে এসব হতে হয়। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে চন্দ্রপুরের চেয়ারম্যান। নাম সাইফুল তালুকদার। একসময়ের সব তালুক শেষ হয়েছে। তবে শুধু ভালোবাসার তালুকটা রয়ে গেছে। এলাকার অনেক ঘরে বিল্ডিং উঠেছে। তবে তার টিনের ঘরে এখনও বিল্ডিং উঠেনি। থাকার ঘর ছাড়া অতিরিক্ত দুটো ঘর আছে তার। একটাতে মানুষ রাখা। একটাতে চাল ডাল, শুকনো খাবার। মানুষ রাখার ঘরে থাকে তিনজন। বড় ঘরে দূরত্ব রেখে ঘুমাতে কষ্ট হয় না।

ওসি সাহেবের সাথে থাকা কনস্টেবল চালের বস্তা গুনলেন। ৬৩০ বস্তার সাথে আরও ১৮০ বস্তা চাল বেশি আছে। সরকারি চালের সিল লাগানো বস্তার সংখ্যা ১০০। বাকিগুলোতে রাইস মিলের নাম লেখা।

- বস্তা কোথায় ফেলছেন চেয়ারম্যান সাহেব?
- বস্তা ফেলি নাই।
- বস্তা পাল্টায়া চাল হালাল করছেন সেইটা স্বীকার করেন।
- আমি চালের মিল থেকে কিনে এনেছি। রিসিট সাথে আছে।
- ওসব বানানো যায়।
- আপনার কথাও বানানো যায়।
- সত্যটা বলুন।
- দরজা খুলুন।

ওসি সাহেব নিজের হাতে দরজা খুললেন। এ ঘরের বাইরের দিকের দরজা দিয়ে উঠোন দেখা যায়। একদম পুকুরপাড় পর্যন্ত বিশাল বিস্তৃত উঠান। সেখানে চুন দিয়ে দূরে দূরে মানুষ দাঁড়ানোর জন্য মার্ক করা। ২৫ জনের মত দাঁড়াতে পারে সেখানে। একদম ২৫ জনই দাঁড়িয়ে আছে। তাদের প্রায় সবাই মধ্যবয়সী। খেটে খাওয়া মানুষের মত দেখতে তাদের চেহারা। কেউ কেউ গৃহিণীদের মত।

- আপনারা কারা?
- আমরা মানুষ।
- এখানে কী চান?
- ব্যাখ্যা।
- কিসের ব্যাখ্যা?
- কেন এসেছেন?
- চালের খোঁজ নিতে।
- আমাদের পেটের খোঁজ নিতে আসছিলেন?

আগত সম্মানিত ব্যক্তিরা চুপ করে গেলেন। একসাথে অনেক চাল কোথাও ট্রাকে করে গেলে সবাই সন্দেহ করে। এমন সন্দেহেই কেউ হয়ত তাদের জানিয়েছিলো এই খবর। কিন্তু এই চাল চুরির চাল না। সাইফুল চেয়ারম্যান নিজের টাকায় কিনে এনেছেন। নিজের টাকা পুরোপুরি না। তার এলাকার যারা দেশের মধ্যে বড় চাকরি করা, বড় ব্যবসায়ী আছেন তাদের লিস্ট আছে তার কাছে। লিস্ট ধরে ধরে সবার থেকে অনুদান সংগ্রহ করা হয়েছে। যতটা সবার সামর্থ্য তারচেয়ে বেশি করেই সবাই দিয়েছেন।

যে যতটা পারে দিয়েছে। সেদিন এক রিকশাওয়ালার বউ তার মাটির ব্যাংকে জমানো সব টাকা দিয়ে গেছেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনারা চলবেন কীভাবে? তিনি বললেন, চায়ের দোকানদার সবুরের বউ যেমনে চলবো আমিও সেমনেই চলবো।

চেয়ারম্যান সাহেব এতক্ষণে আবার মুখ খুললেন। তিনি বললেন, আপনাদের ১০ টাকার চাল থেকেও আমি ১০০ বস্তা কিনেছি। আমার এলাকার একজনে ৫ কেজি করে কিনলে কত কেজি হয় সেটা ক্যালকুলেটর দিয়ে হিসেব করে সেই অনুযায়ী চাল আমি কিনে এনে আমার ঘরে ঢুকিয়েছি। আমার মানুষেরা অতদূর গিয়ে চাল কিনে আনতে পারবে না। আর এতে সামাজিক দূরত্বও থাকে না। আর যাদের সামর্থ্য নাই তারা ১০ টাকা কেজিতেও কিনতে পারবে না। আমি নিজে কিনে এনেছি। এখন নিজ দায়িত্বে তাদের ঘরে পৌঁছে দিবো।

আরও বললেন, চালের বস্তা আমি নিজে মাথায় করে দিয়ে আসি না। আমার দিয়ে আসার মত লোক আছে। মানুষের জন্য কাঁদার লোক আছে। আপনাদের যদি লোক লাগে জানাবেন। আমি পাঠিয়ে দিবো।

প্রতীকি ছবি

উপস্থিত ভদ্রলোকদের যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। যাওয়ার সময় তাদের চোখ আটকে গেলো ঘরের টিনের দেয়ালের একটা পোস্টারে। সাইফুল চেয়ারম্যানের নাম দিয়ে সেখানে লেখা, "মার্কার নাম বাংলাদেশ" -প্রচারে, বাংলাদেশের জনগণ।

- এইটা কোন ইলেকশনের মার্কা চেয়ারম্যান সাহেব?
- আমার মনের ইলেকশনের। এই মার্কা আমার মার্কা। আমার শক্তি। যতদিন এই মার্কার ইজ্জত রাখতে পারবো ততদিন এই মানুষগুলার সাথে এক কাতারে দাঁড়ায়া থাকবো।
- আপনার ইউনিয়ন পরিষদের ইলেকশনের মার্কা যেন কী ছিলো?
- সেইটা আমি মনে রাখি নাই।

গর্বে মাথা উঁচু করবেন না লজ্জায় মাথা নিচু করবেন বুঝলেন না ওসি সাহেব কিংবা ইউএনও। যাওয়ার আগে হাত রাখলেন চেয়ারম্যান সাহেবের কাঁধে। বললেন, কেন করতেছেন? চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, ডিউটি করতেছি স্যার। আমার ডিউটি ৯ টা ৫ টা না। আমার ডিউটি সারাদিন। চেয়ারম্যান মেম্বার বেঁচে থাকতে ইউনিয়নের কেউ না খেয়ে মরতে পারবে না। এইটাই জনপ্রতিনিধিগিরি। এইটাই নেতা। এই হ্যাডম ছাড়া লিডার হওয়া যায় না।

সাইফুল চেয়ারম্যান বললেন, আমি কারও দিকে তাকিয়ে থাকি না। আমার এখান থেকে কাঁদলে গণভবন পর্যন্ত শব্দ যায় না। আমার গ্রামে সকালে যার পেট খালি থাকে তাকে সন্ধ্যার পর ভাত দিলে হবে না। সকালের ভাত অন্তত দুপুরের আগে দিতে হবে। আপনাদের কাগজ কলমের হিসাব আমি বুঝি না। আমি আমার এলাকার দায়িত্ব নিছি, আপনারা বাংলাদেশের দায়িত্ব নেন।

পরিতৃপ্তির মত লজ্জা নিয়ে চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে বের হলেন ওসি সাহেব আর ইউএনও। এই গল্প তারা কি কাউকে বলতে পারবেন? দেশের সিস্টেম কি এই সত্য হজম করতে পারবে? এমন সততা কি রাষ্ট্র তার জনগণের সামনে দেখাতে পারবে?

রাত আটটা। অন্ধকার গ্রামের রাস্তা। মোবাইলের আলো জ্বেলে পথ চলতে হয়। আশপাশ নীরব হয়ে গেছে ততক্ষণে। পাখিরা ডাকছে না। মুরগীর খামার থেকে পোল্ট্রি মুরগীর শব্দ ভেসে আসছে শুধু। ইউএনও সাহেব কান পাতলেন বাতাসে। সাথে কান পাতলেন ওসি সাহেবও। অনেকদূর পর্যন্ত শোনার চেষ্টা করলেন। একদম গণভবন পর্যন্ত। তবে তারা কিছুই শুনলেন না। শুধু একটু দূরের এক বাড়ি থেকে এক ছেলের ছড়া পাঠের শব্দ ভেসে এলো। বানান করে করে আদর্শলিপি পড়ছে সে,

"আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!"


লিডার! The chairman we wanted. মানুষ বাঁচাতে গেলে রূপকথার মত যে গল্পকে সত্য হতে হবে...

পরিশিষ্ট- তানভীর মেহেদীর লেখা এই গল্পটি কেবলই কল্পবাস্তব। সত্যি সত্যি এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। পত্রিকার পাতা খুললে, ফেসবুকের নিউজফিডে ঢুকলে শুধু ত্রাণের চাল চুরির খবর পাওয়া যায়, সাইফুল চেয়ারম্যানরা শুধু গল্পেই থাকেন, বাস্তবে তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা