আপনি একাকী থাকতে ভালোবাসেন? খুব বেশি ভিড়ভাট্টা পছন্দ না? তাহলে ঘুরে আসুন লাটভিয়া থেকে। দেশটিকে যে বলা হচ্ছে ইউরোপের ইনট্রোভার্ট দেশ! কিন্তু কেন?

বিবিসির একটি প্রতিবেদনে লাটভিয়া নামক এক দেশের কথা পড়ছিলাম। দেশটার নাম জানি, কিন্তু সে দেশ বা সেখানকার মানুষদের সম্পর্কে কিছুই জানা নেই। কিছু জানার আগ্রহও ছিল না। তবুও প্রতিবেদনটির হেডলাইন দেখে আকৃষ্ট হলাম। দেশটাকে বলা হচ্ছে, ‘ইউরোপের ইনট্রোভার্ট দেশ’!

কেন এ নামে ডাকা হচ্ছে তা জানার আগ্রহ হলো, এবং পড়ে মজা লাগল। চলুন, জেনে জেনে নেয়া যাক, কেন লাটভিয়া ইউরোপের ইনট্রোভার্ট বা অন্তর্মুখী দেশ! 

গত বছর লন্ডন বই মেলায় “লাটভিয়ান লিটারেচার” নামে একটি কমিক বই প্রকাশিত হয়েছে। এই বইটিতে কৌতুক আকারে লাটভিয়ার সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য চিত্রায়িত হয়েছে। আর বইটি প্রকাশিত হয়েছে লাটভিয়ার একটি সাংস্কৃতিক প্রচারণা #আইঅ্যামইনট্রোভার্ট এর অংশ হিসেবে।

“আই অ্যাম ইনট্রোভার্ট” বা “আমি অন্তর্মুখী” নামক এই প্রচারণার পরিকল্পনাকারী লাটভিয়ার একজন প্রকাশক এবং লেখক অ্যানিট কনসেট। অ্যানিট কনসেটের মতে, এই প্রচারণার মাধ্যমে তারা তাদের  দেশের মানুষের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সঠিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। লাটভিয়া ইনট্রোভার্টদের দেশ- এটা বললে মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না বলে অ্যানিট কনসেট দাবী করছে। লাটভিয়ার মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের কথা জানলে সবারই অবশ্য অ্যানিট কনসেটের দাবীর সত্যতা স্বীকার করে নেবে।

নিজেদের অন্তর্মুখী স্বভাব নিয়ে তাদের মোটেও হীনমন্যতা নেই, বরং আছে গর্ব   

লাটভিয়া দেশটির শান্ত নির্মল প্রকৃতিতে নেই কোন শোরগোল, উন্মাদনা। সেখানকার একমাত্র কোলাহল গাড়িঘোড়ার শব্দ এবং দর্শনার্থীদের শোরগোল। লাটভিয়ার স্থানীয় অধিবাসীদের হইচই কথাবার্তা তেমন শোনা যায় না বললেই চলে। সেদেশের অধিবাসীরা একা একা পথ চলতেই পছন্দ করে। তবু, মাঝে মাঝে যদিওবা একদল লাটভিয়ানদের দেখা মেলে, তাদের মধ্যে কোন কোলাহলের দেখা পাওয়া যায় না। তারা পথ চলে শান্ত, নিশ্চুপভাবে, নিজেদের মধ্যে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে। যেন দেখেই বোঝা যায়, তারা দলবেধে থাকলেও অন্যের সঙ্গ তাদের তেমন একটা ভাল লাগছে না। 

লাটভিয়ার লোকেরা একাকী থাকতে পছন্দ করে বলে, সেদেশে অদ্ভূত সব রীতির প্রচলন রয়েছে। যেমন, রাজধানী রিগা’র অধিবাসীরা অপরিচিত কাউকে দেখে কখনো হাসে না। লাটভিয়ার লোকেরা নাকি রাস্তায় একপাশে কোন মানুষকে দেখলে, চট করে রাস্তা ক্রস করে অন্য পাড়ে চলে যায়, যাতে অন্যদের মুখোমুখি হতে না হয়। 

লাটভিয়ার উৎসব অনুষ্ঠানগুলোতেও তাদের অন্তর্মূখীতার পরিচয় পাওয়া যায়। সব দেশেই যেখানে প্রধান উৎসবগুলো প্রতিবছর পালিত হয়, সেখানে লাটভিয়ার একটি বড় উৎসব, “লাটভিয়ার গান ও নাচের উৎসব” পালিত হয় প্রতি পাঁচ বছরে মাত্র একবার। 

লাটভিয়ার সবচেয়ে বড় উৎসবটিও অনুষ্ঠিত হয় পাঁচ বছরে একবার

লাটভিয়ার বড় কোন অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের লোকেরা কমন হলঘরের ভেতর দিয়ে খুব সাবধানে যাতায়াত করে। তারা যথাসম্ভব প্রতিবেশিদের সাথে সাক্ষাৎ এড়িয়ে চলে। প্রতিবেশিদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হলেই তো আবার শুভেচ্ছা বিনিময় করতে হবে! সে আর এক বাড়তি ঝামেলা! লাটভিয়াতে কথা না বলাটা বা শুভেচ্ছা বিনিময় না করাটা মোটেও অভদ্রতা নয়। বরং বেশি কথা বলাটা এবং হইচই করাটাই সেখানে অদ্ভূত চোখে দেখা হয়।

লাটভিয়ানদের স্বভাব বাইরের অনেক দেশের মানুষদের কাছেই অদ্ভূত মনে হলেও, সুইডেন, ফিনল্যান্ড বা এস্তোনিয়ার মানুষদের কাছে কিন্তু খুবই স্বাভাবিক। তারাও লাটভিয়ানদের মতো একইরকম অন্তর্মুখী স্বভাবের কিনা! 

লাটভিয়ানরা যে সবাই জাতিগতভাবে একই রকম, তা নয়। লাটভিয়ানদের মধ্যে রয়েছে রাশিয়ান এবং অন্যান্য অনেক উপজাতি গোষ্ঠীর মানুষ। তাদের মধ্যে রয়েছে ভাষাগত বা ঐতিহ্যগত এবং মতাদর্শগত ভিন্নতা। তাই সেদেশের সকল মানুষই যে এক রকম সেটা বলাটা একটু কঠিনই। তবু সাধারণভাবে লাটভিয়ানরা খুবই নিরিবিলি স্বভাবের। 

লাটভিয়ানরা কেন এতটা অন্তর্মুখী? এ প্রশ্নের নির্দিষ্ট কোন ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও, সে দেশের জনবসতির ধরন বিশ্লেষণ করলে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। সে দেশের জনসংখ্যা বেশ কম। আর জনসংখ্যা কম বলেই জনসংখ্যার ঘনত্বও খুবই কম, প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মাত্র ৩৪ জন। জনসংখ্যার ঘনত্ব কম বলে সেখানে মানুষের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ এমনিতেও কম হয়। আর মানুষের সঙ্গ এড়িয়ে চলতে চাইলে তো তা আরও সহজ। 

সেদেশের দোকান-পাট, ক্যাফে বা রেস্তোরাগুলোতে ভীড় থাকে না বললেই চলে। তাই চাইলেই যে কেউ অন্যদের সঙ্গ এড়িয়ে চলাফেরা করতে পারে। আবার থাকার জায়গারও অভাব নেই। লাটভিয়ার বেশিরভাগ মানুষ শহরে বাস করে এবং অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে থাকে। এক সমীক্ষা অনুসারে সেদেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে বাস করে। 

সেখানকার প্রায় প্রত্যেকেই স্বনির্ভর এবং প্রত্যেককেরই নিজস্ব আবাসস্থল রয়েছে। তাই কেউ কারও ব্যাপারে নাক গলায় না, বা অন্যদের সঙ্গ তেমন একটা পছন্দ করে না। একা থাকতেই তারা স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। 

এরপরও আরও বেশি নির্জনতা চাইলে অনেকে শহরের কোলাহল ছেড়ে শান্ত নিরিবিলি বনভূমি ঘেরা গ্রামে পাড়ি জমায়। শহর ছেড়ে একা একাই, স্বনির্ভর অনেকেই গ্রামে গড়ে তোলে সুখের নিরিবিলি ছোট্ট কাঠের নীড়। প্রকৃতিপ্রেম আর রোমান্টিসিজম যাদের মজ্জাগত, গ্রামের ছায়াঘেরা ছোট্ট নীড়ে পরিপূর্ণতা পায় তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। 

এমনিতেই লাটভিয়ার জনসংখ্যা কম, তার উপর আবার জনসংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে বহির্গমণের ফলে। দেশ ছেড়ে জীবিকার প্রয়োজনে অনেকেই পাড়ি জমাচ্ছে ভীনদেশে। ফলে, আরও বেশি নির্জন হয়ে পড়ছে লাটভিয়া।

লাটভিয়ানরা মানুষের সঙ্গে খুব বেশি যোগাযোগ পছন্দ করে না বলেই তাদের মনস্তত্ব ব্যাখ্যা করা মুশকিলের ব্যাপার। সাইক্রিয়াটিস্টদের মতে, লাটভিয়ার অধিবাসীদের এ অন্তর্মূখী স্বভাবের একটি ভালো দিক রয়েছে। সেটি হলো, লাটভিয়ানরা খুবই সৃজনশীল। একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা আর নির্জনতা লাটভিয়ার মানুষদের করেছে সৃষ্টিশীল- কমপক্ষে সব লাটভিয়ানরা এমনটাই বিশ্বাস করে। 

লাটভিয়ার বুদ্ধিজীবী, যেমন- লেখক, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, স্থপতি এদের মধ্যে এই অন্তর্মুখী স্বভাবটা বেশিই তীব্রতর বলে অনেকে মনে করে। লাটভিয়ান মনোবিদরা মনে করেন, সৃজনশীলতা লাটভিয়ানদের চরিত্রের গুরুত্বপূর্ণ দিক। লাটভিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সৃজনশীলতাকে সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। ইউরোপিয়ান কমিশনের একটি রিপোর্ট অনুসারে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের শ্রমবাজারে সৃজনশীলতার দিক দিয়ে লাটভিয়া সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে।

আমি নিজেও লাটভিয়ানদের মতো খানিকটা ইনট্রোভার্ট বা অন্তর্মুখী স্বভাবের। তাই লাটভিয়ানদের স্বভাবের কথা জেনে, আমার বেশ একটু সাহস হচ্ছে। অন্তর্মুখী হওয়া খুব একটা খারাপ কিছু নয়। অন্তর্মুখী মানুষরা সৃজনশীল হয়। আপনিও যদি আমার মতো অন্তর্মুখী হয়ে থাকেন, তবে কিছুটা সাহস আপনিও সঞ্চয় করতে পারেন, সার্বিয়ানদের স্বভাবের কথা জেনে। কী বলেন?

ফিচার্ড- 'আই অ্যাম ইনট্রোভার্ট' ক্যাম্পেইনে ব্যবহৃত ছবি

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা