লিফট ওভারলোডেড হওয়ায় তারই অধীনস্ত এক কর্মচারী তাকে চিনতে না পেরে বলেছেন লিফট থেকে নেমে যেতে, লতিফুর রহমান স্যরি বলে নেমে গেছেন, কোন উচ্চবাচ্য করেননি- বাংলাদেশে এরকম আর একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কেউ দেখাতে পারবে?

লতিফুর রহমান মারা গেলেন জুলাই মাসের প্রথম দিনটায়। চার বছর আগের যে তারিখে হোলি আর্টিজানে নৃশংস জঙ্গী হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন তার নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেন। ফেসবুকে সংবাদকর্মী এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা সবাই শোক জানাচ্ছেন, দল-মত নির্বিশেষে স্মরণ করছেন লতিফুর রহমানকে। একজন ব্যবসায়ী, একজন মিডিয়া টাইকুন বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের দেশে এমন সম্মানের স্থানে আরোহন করতে পারেন, সেটা লতিফুর রহমান না থাকলে জানা হতো না। 

লতিফুর রহমানের প্রয়াণের পর তার যে গুণটির কথা সবাই বারবার বলছে, সেটি হচ্ছে বিনয়। একদম মাটির মানুষ ছিলেন তিনি। দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের একজন ছিলেন তিনি, হাজার হাজার কর্মচারী কাজ করে তার অধীনে, মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে বিদেশী রাষ্ট্রদূত কিংবা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রধানরাও তাকে সমীহ করে কথা বলতেন, অথচ সেই মানুষটা কিনা নিজের প্রতিষ্ঠানের সামান্য একজন পিয়নকেও আগ বাড়িয়ে সালাম দিতেন, কুশল জানতে চাইতেন! লিফট ওভারলোডেড হওয়ায় তারই অধীনস্ত এক কর্মচারী তাকে চিনতে না পেরে বলেছেন লিফট থেকে নেমে যেতে, তিনি স্যরি বলে নেমে গেছেন, কোন উচ্চবাচ্য করেননি- বাংলাদেশে এরকম আর একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কেউ দেখাতে পারবে?

জন্ম, পরিবার, সংগ্রাম

বড়লোক পরিবারে জন্ম, বেড়ে ওঠা। কিন্ত সাফল্যের গল্পটা নিজের হাতে লিখেছিলেন তিনি। শূন্য থেকে শুরু হয়েছিল যাত্রা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে যখন নিজে কিছু করবেন বলে ব্যবসায় নামলেন, তখন কর্মচারী ছিল মাত্র পাঁচজন। গতকাল যখন তিনি মারা গেলেন, তখন তার ট্রান্সকম গ্রুপে মোট কর্মচারীর সংখ্যা দশ হাজারের বেশি! ব্যাংক থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন, আজ তার প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি! সাফল্য তো এটাকেই বলে! 

লতিফুর রহমান

চায়ের ব্যবসা দিয়ে শুরু করেছিলেন, সেটাকে ধীরে ধীরে বড় করেছেন, ব্যবসার ক্ষেত্র ছড়িয়েছেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। প্রকাশনা ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন, ফুড এন্ড বেভারেজ, সিমেন্ট সহ আরও নানা ক্ষেত্রে বিস্তৃত করেছেন নিজেকে। তার মালিকানাধীন ট্রান্সকম গ্রুপ এখন ষোলোটি প্রতিষ্ঠানের মালিক, পিৎজা হাট এবং কেএফসির মতো ফুড চেইনগুলোকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন লতিফুর রহমানই। 

মিডিয়া মুঘল

শুধু প্রথম আলো আর ডেইলি স্টারের জন্যেও এই মানুষটাকে আজীবন মনে রাখবে সবাই। সৎ আর সাহসী সাংবাদিকতার দারুণ এক ক্ষেত্র তৈরী করে দিয়েছিলেন তিনি। চাইলেই পারতেন, মিডিয়া মুঘল হয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে। সেই ইচ্ছেটা কখনও হয়নি তার। দুটো পত্রিকাই নিজেদের সম্পাদকীয় নীতি অনুযায়ী চলেছে, দেশের সবচেয়ে বেশি প্রচারিত দৈনিকে পরিণত হয়েছে, লতিফুর রহমান এই দুই পত্রিকার ভার দুই সম্পাদকের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে থেকেছেন, কখনও প্রভাব বিস্তার করতে আসেননি। 

প্রভাব বিস্তারে ছিল অনীহা

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের একটা ঘটনা বলি। ডাকাবুকো ব্যবসায়ীদের নামে দুর্নীতির অভিযোগ আসছে, নতুন নতুন দুর্নীতিবাজদের তালিকা বের হচ্ছে, সেগুলোর কোনোটা আংশিক সত্যি, কোনোটা আবার মিথ্যা। পত্রিকার কাজ সেসব প্রকাশ করা। এরকমই একটা তালিকায় লতিফুর রহমানের নামও এলো। প্রথম আলো বা ডেইলি স্টার চাইলেই এটার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারতো, বিরোধিতা করতে পারতো। উল্টো লতিফুর রহমানকে জানানোর পরে তিনি নিজেই বলেছেন, তালিকা যেভাবে এসেছে সেভাবেই যেন ছাপা হয়। গোটা ব্যাপারটা রূপকথার মতো লাগে না শুনতে? বলে রাখা ভালো, লতিফুর রহমানের বিরুদ্ধে সেই দুর্নীতির অভিযোগ কিন্ত হালে পানি পায়নি। 

অতি সাধারণ প্রতিমূর্তি

এই দেশের শতকরা ৯৯ জন ব্যবসায়ীর দেশের বাইরে বিপুল সম্পত্তি থাকে, সুইস ব্যাংকে থাকে অগাধ টাকা। জ্বর-সর্দি হলেও তারা দৌড় দেন সিঙ্গাপুরে, থাইল্যান্ডে। অথচ লতিফুর রহমান অসুস্থ হবার পরে গিয়েছেন তার বাবার ভিটায়, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন মানুষটা। বেশ কয়েক বছর ধরেই অসুস্থতায় ভুগছিলেন, শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল। ডাক্তার বলেছিলেন জায়গা বদল করতে। ইউরোপের বন্ধুরা নাকি তাকে বলেছিলেন, ফ্রান্সে বা বিলেতে একটি কান্ট্রি হাউস কিনে সেখানে নির্মল পরিবেশে থাকতে। লতিফুর রহমান রেগেমেগে জবাব দিয়েছেন, ঢাকা থেকে দূরে কোথাও যেতে হলে তিনি গ্রামের বাড়িতেই যাবেন, অন্য কোথাও নয়! লতিফুর রহমান সেই কথা রেখেছেন। 

লতিফুর রহমান

আঘাত পেয়েছেন বারবার

১৯৯৮ সালে তার ছোট মেয়ে শাজনীন তাসনীম রহমানকে নিজের বাড়িতে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছিল। বাংলাদেশের মতো দেশে অন্য কেউ হলে অনেক কিছুই করতে পারতেন। লতিফুর রহমান ভরসা রেখেছিলেন প্রচলিত বিচারব্যবস্থার ওপর। দীর্ঘ দুই দশক পরে খুনীর সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে, সেটা লতিফুর রহমান দেখে যেতে পেরেছেন। কিন্ত তার আগেই আরেকটা আঘাত বিদীর্ণ করে দিয়েছে তার হৃদয়কে। ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলায় নিহত হয়েছিল তার নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেন। মেয়ের হত্যাকান্ড তাকে আঘাত দিয়েছিল প্রচণ্ড, সেই শোক কাটিয়ে ওঠার পরেই আবার ফারাজের ঘটনাটা- তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন ভীষণ। কাকতালীয় ব্যাপার, ফারাজের মৃত্যুর ঠিক চার বছরের মাথায় চিরবিদায় নিলেন লতিফুর রহমান, এটাও নিয়তির অদ্ভুত এক খেয়াল! 

ছিলেন প্রচণ্ড দেশপ্রেমিক

বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ী আর রাজনীতিবিদই ডুয়েল পাসপোর্ট ব্যবহার করেন, অর্থাৎ বাংলাদেশের পাশাপাশি তারা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা আমেরিকা, কানাডা কিংবা যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোরও নাগরিক। অথচ এত অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েও লতিফুর রহমানের মাথায় কখনও অন্য কোন দেশের নাগরিকত্ব নেয়ার খেয়াল আসেনি। তিনি গর্ব করেই বলতেন, ‘আমাদের পরিবারের সবার একটাই পাসপোর্ট- বাংলাদেশের। আমরা কখনো অন্য দেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করিনি। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, এই দেশের প্রতি আমার আস্থা আছে।'

মানুষটা দেশকে নিয়ে বড্ড ভাবতেন। দেশের অর্থনীতি, ব্যাংকিং সিস্টেম, ব্যাংকগুলোর দেউলিয়া হয়ে যাওয়া, অর্থনৈতিক সংকট- সবকিছু নিয়ে তার ভীষণ চিন্তা ছিল। ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে আসাটা, কিংবা কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের অনুগত হয়ে থাকাটা আমাদের দেশে কমন প্র‍্যাকটিস। লতিফুর রহমান এখানেও নিজেকে অনন্য রাখতে পেরেছিলেন। দল-মতের ঊর্ধ্বে থেকে তিনি কাজ করেছেন। বাংলাদেশের উন্নতির সম্ভাবনা নিয়ে তার মনে কোন সন্দেহ ছিল না, বলতেন- 'আমি মনে করি, অনেক সম্ভাবনা আছে এখানে। যদি রাজনৈতিক বিভেদ না থাকত, তাহলে আরও অনেক দূর এগোতে পারত বাংলাদেশ।’

ট্রান্সকম গ্রুপ, প্রথম আলো বা ডেইলি স্টার অফিসে যারা তাকে একবারের জন্যেও কাছ থেকে দেখেছে, তারা একবাক্যে স্বীকার করেন, লতিফুর রহমান একদম মাটির মানুষ ছিলেন, অহংকার তার মধ্যে কখনও জায়গা করে নিতে পারেনি, ছিলেন বিনয়ের অবতার। এমন মানুষগুলোর বিদায় আমাদের ব্যথিত করে, কারণ আমরা জানি, এই দেশে অজস্র উদ্যোক্তা বা সফল ব্যবসায়ীর জন্ম হবে, কিন্ত আরেকজন লতিফুর রহমানকে বাংলাদেশ আর কখনও পাবে না...

আরও পড়ুন-

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- https://www.egiyecholo.com/contributors/write-for-us


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা