যে জীবনটা অভিশপ্ত হয়ে যেতে বসেছিল, যে জীবনটা অসহ্যকর হয়ে উঠতে পারত, সেই জীবনটাকে তিনি কি দারুণরকমে বদলে দিয়ে বাঁচার মতো বাঁচলেন!

দেড়শ বছর আগে এমন ঘটনা কোনো কিশোরীর সাথে হলে নির্ঘাত তাকে চিতায় উঠতে হতো। তিনি নিজেও জানেন, তাই নিউইয়র্কে কনফারেন্সে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিকভাবেই বলে ফেলেন, '১৫০ বছর আগে জন্মালে আমাকে হয়ত এতক্ষণে স্বামীর সাথে চিতায় জ্বলতে হতো'। ভাগ্যিস রাজা রামমোহন রায় জন্মেছিলেন এবং বুঝেছিলেন সতীদাহ প্রথাটা বিলোপ করাটা কতটা জরুরি। তাই, ভারতে ললিথা অন্তত জীবন সংগ্রাম চালিয়ে নেয়ার সুযোগ পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, এই নারী রীতিমতো ইতিহাস গড়েছেন। তার ঐতিহাসিক গল্পটা জানা যাক।

ললিথার বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১৫ বছর বয়সে। এখনকার দিনেও অনেক জায়গায় বাল্যবিবাহ ঘটে থাকে বটে, তবুও বেশিরভাগ মানুষ ১৫ বছরে বিয়ের কথা ভাবতে পারে না। কিন্তু, সেই উনিশশো ত্রিশের দশকে হয়ত কম বয়সে বিয়ে হওয়াটাই নৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। সে যাই হোক, সংসারটা অসুখী বলা যাবে না, ললিথার দিনগুলো কাটছিলো ভালই। একটা ফুটফুটে সন্তানও এলো কোলজুড়ে। নাম রাখা হয়েছিল শ্যামলা। সেটা ১৯৩৭ সালের কথা, যখন ললিথার বয়স হয়েছিল ১৮। কিন্তু হায়! ভাগ্যের কী পরিহাস। সন্তানের বয়স যখন চার মাস মাত্র, ঠিক তখন ললিথার স্বামী মারা গেলেন, আর শিশু শ্যামলা হয়ত বুঝতেও পারেনি সে পিতৃহারা হলো।

সতীদাহ প্রথা বিলোপ হয়েছিল বটে, কিন্তু বিধবা নারীর জন্য নিয়মকানুনগুলো ছিল বড্ড কঠিন। ১৮ বছরের বিধবা তরুণীর পক্ষে সেসব মানা তো আরো কঠিন। মাথার সব চুল ফেলে দিতে হয়। সমাজের মূল স্রোত, পরিচিত দুনিয়া থেকে একদম আলাদা হয়ে যেতে হয়। আর কঠিন ধর্মীয় আচার পালন করতে হয়। একটা মেয়ে যার ১৫ বছরে বিয়ে হলো, ১৮তেই যিনি বিধবা হলেন, তার জন্যে এসব কিছু বিভীষিকাময় হওয়ার কথা। কোনো অপরাধ করেননি তিনি, তবুও তাকে আলাদা থাকতে হচ্ছে, সবার কাছ থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে শুধু বিধবা হওয়ার কারণে, এটা ললিথা মানতে পারেননি মানসিকভাবে।

ললিথা

ললিথা জন্মেছিলেন ১৯১৯ সালে। টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত তেলেগু পরিবারে জন্ম হয়েছিল তার। যেখানে তার ভাই পড়ালেখার সুযোগ পেয়েছে, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পেরেছে। ললিথার বাবা যিনি নিজে শিক্ষিত, তিনি ললিথাকেও অবশ্য পড়াতে চেয়েছেন, তবে এর মধ্যে মেয়ের বিয়ে দিলেন ভাল পাত্র পেয়ে এবং বললেন, বিয়ের পরেও পড়া যাবে ক্লাস টেন পর্যন্ত। বিরাট সুযোগই (!) বটে।

ললিথার স্বামী ভদ্রলোক ছিলেন তার পরিবারের ১৬ তম সন্তান। তিনি মারা যাওয়ার পর ললিথার শাশুড়ি খুব বিমর্ষ এবং হতাশ হয়ে পড়েন। ক্ষোভগুলো এসে ললিথার উপরই পড়তো। তার উপর বিধবা হিসেবে কঠোর বিধিনিষেধ তো ছিলই। কিন্তু, ললিথা ঠিক করলেন, জাগতিক, সামাজিক এসব নিয়ম কানুনের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের জীবনটা যাপন করবেন। তাই সব ছুঁড়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়বেন।

কাজটা মোটেও সহজ নয়। প্রথমত, তার সন্তান শ্যামলার দায়িত্বও তাকে পালন করতে হবে৷ দ্বিতীয়ত একজন নারী সেই সমাজে ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনে পড়বে কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখবে এটাই অনেকের কাছে অস্বাভাবিক এবং অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু, ললিথা তো ইতিমধ্যে অনেক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি পাড়ি দিয়ে ফেলেছেন!

ললিথা ভর্তি হয়ে গেলেন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং, গুইনডি ছিল মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় অধীনস্থ। এই কলেজের ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্টের ইতিহাসে প্রথম নারী ছাত্রী ছিলেন ললিথা। কলেজে গিয়ে প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলেন হয়ত। চারদিকে সব ছেলের দল, সেখানে একমাত্র নারী ছাত্রী ছিলেন কেবল ললিথাই। অবশ্য, তারা ললিথার প্রতি বেশ শ্রদ্ধাশীল ছিল। কলেজ কর্তৃপক্ষ ললিথার জন্য আলাদা হোস্টেলে সীটের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল। তারাও হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন এই নারী ইতিহাস গড়বে একদিন। আর ললিথার কন্যা শ্যামলাকে তখন তার এক চাচার বাড়িতে রাখা হয়েছিল। ললিথা সপ্তাহান্তে মেয়ের কাছে যেতেন।

হোস্টেলে ললিথার একাকীত্ব বোধ হতো। আর কোনো ছাত্রী নেই, কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছে না! তবে ললিথা বেশ ভালই করছিলেন পড়ালেখায়। কলেজ কর্তৃপক্ষ তখন ভাবলো, তারা বিজ্ঞাপন দিবে কলেজে যেন অন্যান্য ছাত্রীরাও ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়তে আসে। বিজ্ঞাপনে খুব কাজ হয়েছে এমন নয়, কিন্তু দেখা গেল সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সের জন্য দুইজন ছাত্রী যোগ দিল কলেজে।

দুইজনই ললিথার চেয়ে পড়ালেখার হিসেবে একবছরের জুনিয়র হলেও, একসাথেই তাদের গ্র‍্যাজুয়েশন হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষ কোর্সের সময় কয়েক মাস কমিয়ে আনায় এই তিনজন একসাথে গ্র‍্যাজুয়েট হন। এর আগে কলেজের সার্টিফিকেটের যে অংশে টাইপ করা ছিল 'হি', ললিথা এবং বাকি দুইজনের জন্য ওই শব্দটা কেটে তারা 'শি - (She)' লিখেন। ইতিহাস কিভাবে বদলায়, একজন নারীর স্বপ্ন সার্টিফিকেটের ফিক্সড শব্দকে কিভাবে বদলে দিতে পারে তার সুন্দর উদাহরণ এটি!

সার্টিফিকেটে 'হি' কেটে 'শি' লিখেন তিনি

ইতিমধ্যে ললিথার বাবা শুভ রাও মেয়ের ডিটারমিনেশন সম্পর্কে বেশ ভাল ধারণা পেয়ে গেছেন। মেয়েকে তিনি তাই রুখে দেয়ার চেষ্টা করেননি, টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত অভিভাবক যা করে থাকে আর কি। তিনি বরং সাহায্যই করেছেন। জনাব রাওয়ের ওয়ার্কশপেই ললিথা গ্র‍্যাজুয়েশনের পর কিছু মাস কাজ করেন। নয় মাস পর ললিথা কলকাতার এসোসিয়েটেড ইলেক্ট্রিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি শুরু করেন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে।

১৯৬৪ সালে নিউইয়র্কে প্রথমবারের মতো নারী ইঞ্জিনিয়ার এবং বৈজ্ঞানিকদের একটা বিশাল কনফারেন্স হয়। সেখানে ভারত থেকে ললিথা আমন্ত্রিত হন এবং বক্তব্য রাখেন প্রথম নারী ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে! নিশ্চয়ই ভারতের জন্য দিনটা গর্বের এবং নারীদের জন্য ললিথা হয়েছিলেন ভীষণ অনুপ্রেরণাময়ী। এই এত সুদূর পথচলা আর স্বপ্নপূরণে কতটা আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন একজন ললিথা তা এই ২০২০ সালে বসে কতটুকুই বা বোঝা যাবে। তিনি যেসময় সংগ্রামটুকু করেছিলেন তখন ব্যাপারটা দুঃসাহসিক ছিল, তিনি এমন পথ বেছে নিয়েছেন যে পথে আগে কেউ পা মাড়ায়নি ভারতে।

সেই সময় এভাবে নিজের জীবন নিজের স্বপ্ন নিজে ঠিক করে পা বাড়াবার সাহস কজন দেখানোর সাহস করতেন! আর এই দীর্ঘসময়ে তিনি নিজের মেয়েকেও কখনো মায়ের অভাব তো ভাল পিতার অভাবটুকুও নাকি অনুভব করতে দেননি। শ্যামলা নিজে তাই মায়ের কথা যখন বলে ভীষণ গর্বে তার মন ভরে যায়। মাকে সে অনুকরণীয় মনে করে। বাকি জনমে আর বিয়ে করেননি ললিথা। এটাও নিজেরই সিদ্ধান্ত। কেউ কিছু মনে করেছে কি করেনি তাতে কবে পরোয়া করেছেন তিনি!

এমন জীবন যার, এমন সাহসী মানুষ যিনি তার জন্য ষাট বছরই যথেষ্ট কীর্তির ছাপ রেখে যাওয়ার জন্য। জীবনটা ললিথার ৬০-এর বেশি দীর্ঘায়িত হয়নি, কিন্তু যে জীবনটা অভিশপ্ত হয়ে যেতে বসেছিল, যে জীবনটা অসহ্যকর হয়ে উঠতে পারত, যে জীবনটা নিঃসঙ্গতায় একাকীত্বে সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে পার হয়ে যেতে পারত- সেই জীবনটাকে তিনি কি দারুণরকমে বদলে দিয়ে বাঁচার মতো বাঁচলেন। আর ইতিহাসের অংশ হয়ে ইতিহাসকে স্বাক্ষী রেখে ললিথা হয়ে থাকবেন অসংখ্য নারীদের অনুপ্রেরণা - যারা নিজের জীবনটা যাপন করবার সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার অপেক্ষায় আছে। ললিথার গল্প তাই তাদের সাহায্য করতেই পারে...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা