১৯৫৬ সালের আগস্ট মাস। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের মাহবুবনগরে এক ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে ১১২ জনের। সেই দুর্ঘটনার নৈতিক দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন তৎকালীন রেল, পরিবহন ও যোগাযোগ মন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সাথে দেখা না করেই, তার কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন তিনি।

বিস্মিত নেহেরু সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে বরং ফেরত পাঠান। বলেন, "দুর্ঘটনা তো ঘটতেই পারে। এর জন্য পদত্যাগ করতে হবে কেন?" ফলে সে যাত্রায় নিজ পদে বহাল থাকেন শাস্ত্রী। 

কিন্তু এর মাত্র মাসতিনেক পরই, নভেম্বরে আবার তামিল নাড়ুতে আরেক রেল দুর্ঘটনায় মারা যায় ১৪৪ জন। ফের অবিলম্বে নিজের পদত্যাগপত্র জমা দেন শাস্ত্রী, এবং অনুরোধ জানান এবার যেন সেটি গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি তিনি পদত্যাগপত্রে লেখেন, "এটি আমার জন্য এবং সামগ্রিকভাবে সরকারের জন্য মঙ্গলকর হবে, যদি আমি নীরবে আমার দায়িত্ব ছেড়ে দিই।" 

তিন মাসের ব্যবধানে শাস্ত্রীর দ্বিতীয় দফা পদত্যাগের সিদ্ধান্তে নড়েচড়ে বসে গোটা জাতি। সাড়া পড়ে যায় ভারতবর্ষ জুড়ে। ২৬ নভেম্বর দ্য পাইওনিয়ার পত্রিকা তাদের সম্পাদকীয়তে লেখে, "শ্রেষ্ঠভাবে পরিচালিত রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু দুর্ঘটনাগুলো তো হওয়া উচিৎ ব্যতিক্রম ঘটনা, প্রচলিত ঘটনা নয়।" 

এভাবেই দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলো থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী মহল থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থায় নিরাপত্তা জোরদারের আহ্বান জানানো হলেও, সকলে বিরত থাকে শাস্ত্রীকে দোষারোপ করা থেকে। 

আগেরবার সরাসরি পদত্যাগপত্র প্রত্যাখ্যান করলেও, এবার দোটানায় পড়ে যান প্রধানমন্ত্রী নেহেরু। লোকসভায় সবার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি স্বীকারও করেন যে এটি তার জন্য খুবই কঠিন একটি সিদ্ধান্ত। তিনি আরো বলেন, "সাংবিধানিক যথার্থতার বৃহত্তর দৃষ্টিকোন থেকে এখানে আমাদের এমন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিৎ যেন কোনো ব্যক্তিই না ভাবে যে যা-ই হয়ে যাক না কেন, আমরা বিন্দুমাত্র প্রভাবিত না হয়েই আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখব।" 

এর মাধ্যমে নেহেরু ইঙ্গিত দেন যে তিনি শাস্ত্রীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে চলেছেন বটে, কিন্তু তা কেবলই নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ববোধ থেকে। 

যখন এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে নেহেরু পুরোপুরি মন থেকে চাইছেন না পদত্যাগপত্রটি গ্রহণ করতে, ৩০ জন সংসদ সদস্য তার কাছে অনুরোধ করেন যেন তিনি শাস্ত্রীকে যেতে না দেন, কেননা উল্লিখিত দুই দুর্ঘটনায় ব্যক্তিগতভাবে শাস্ত্রীর তো কোনো ত্রুটি ছিল না। তারা বলেন, শাস্ত্রী যে পদত্যাগ করতে চেয়েছেন, এজন্য তিনি প্রশংসার দাবিদার। কোনো ব্যবস্থা নিতে হলে তা নেয়া উচিৎ রেলওয়ে বোর্ডের বিরুদ্ধে, যেহেতু তাদের যান্ত্রিক গোলযোগের কারণেই দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। এভাবে সংসদ সদস্যরা সাফ জানিয়ে দেন যে গোটা ঘটনায় অভিযোগের আঙ্গুল তুলতে হবে আমলাতন্ত্রের দিকে। এক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক নেতাকে বলির পাঁঠা বানানো যাবে না।  

কিন্তু শেষ পর্যন্ত, দেশের গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সংসদ সদস্য কিংবা প্রধানমন্ত্রী, সকলের আপত্তি কিংবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও, শাস্ত্রী তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, এবং সরে দাঁড়ান নিজের পদ থেকে। অবশ্য পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৫৭ সালেই আবার তিনি ফিরে আসেন মন্ত্রীসভায়। ১৯৫৯ সালে তিনি শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ১৯৬১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হন। ১৯৬৪ সালে পোর্টফোলিওবিহীন মন্ত্রী হিসেবে তিনি ম্যাঙ্গালোর বন্দরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ওই বছরই নেহেরুর মৃত্যুর পর তিনি হন ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী।

তবে সে যা-ই হোক, ১৯৫৬ সালে তার সেই নজিরবিহীন মনোভাব দেখিয়ে দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়াকে এখনো মনে রেখেছে ভারতের সাধারণ মানুষ। তার নামই আজো উচ্চারিত হয় মুখে মুখে, যখনই কোনো মন্ত্রী তার দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হন। শাস্ত্রীর উদাহরণ দেখিয়ে মন্ত্রীদেরকে তাদের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়। অবশ্য এখন পর্যন্ত খুব কম মন্ত্রী বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্বই শাস্ত্রীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। এবং যারাও বা করেছেন, তাদের অধিকাংশই কাজটি নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সাংবিধানিক দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে নয়, করেছেন ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য নিয়ে।

-

* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা