কী ঘটেছিল লাইকা নামের কুকুরটির ভাগ্যে?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
কন্সপিরেসি থিওরি যদি একপাশে রাখি, তাহলে আমরা বলতে পারি পৃথিবী থেকে সর্বপ্রথম মহাকাশ অভিযানে যাওয়া প্রাণীর নাম লাইকা, আর এটি ছিল একটি কুকুর।
মোহাম্মদ সালাউদ্দিন : ১৯৫০ সালের আগে কোনো মানুষকে মহাকাশ অভিযানে পাঠানো চ্যালেঞ্জিং ছিল বিজ্ঞানীদের জন্য। তাই বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময়ে মাছি, ইঁদুর, বানর প্রভৃতি প্রাণীকে মহাকাশ অভিযানে পাঠিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল স্পেস মিশনে মানুষ পাঠানো সম্ভব কিনা পরীক্ষা করা। কিন্তু মহাশূন্যে পাঠানোর পরে এই প্রাণীগুলো মারা গিয়েছিল। এরকমই একটি মিশনের বলি হয়েছিল লাইকা নামের সেই কুকুরটি।
১৯৫৭ সাল, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা রাশিয়া পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম মহাকাশযান স্পুটনিক-১ সফলভাবে উৎক্ষেপণ করে। এরপরই রুশ বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, মহাকাশে পৃথিবী থেকে কোনো প্রাণীকে পাঠানো যায় কিনা। এই ইচ্ছা বাস্তবায়ন করার জন্য তারা মরিয়া হয়ে ওঠে, যার খেসারত জীবন দিয়ে দিতে হয়েছিল লাইকাকে।
রুশ বিজ্ঞানীরা তাড়াহুড়ো করে মাত্র চার সপ্তাহের মধ্যে তৈরি করে ফেলে তাদের দ্বিতীয় স্পেসক্রাফট স্পুটনিক-২, এটা ডিজাইন করা হয়েছিল শুধুই একটি কুকুরের জন্য। স্পুটনিক-২ এর প্রধানত তিনটি জিনিস ছিল; অক্সিজেন জেনারেটর, কার্বন ডাইঅক্সাইড অবজারভার এবং কুকুরটির কেবিন ঠান্ডা রাখার জন্য একটি ফ্যান। এছাড়া ছিল তার জন্য সাতদিন বেঁচে থাকার মতো কিছু খাবার এবং তার প্রস্রাব ও বিষ্ঠার জন্য একটি ব্যাগ।
স্পুটনিক-২ এর কেবিনটা এতই ছোট ছিল যে কুকুরটা যে একটু নড়াচড়া করবে সে সুযোগও ছিল না। স্পেসক্রাফট স্পুটনিক-২ তৈরি করে ফেলার পর রুশ বিজ্ঞানীদের প্রয়োজন ছিল শুধুই একটি কুকুর, আর তারা জেনেশুনে রাস্তার একটা কুকুরকেই বেছে নেয় কারণ রাস্তার কুকুরদের ঘরে পোষা কুকুরদের তুলনায় খারাপ পরিবেশে থাকার অভ্যাস বেশি, যা তাদের অভিযানের জন্য বেশি উপযুক্ত। তাই তারা খুঁজে নিয়েছিল মস্কোর রাস্তায় বেওয়ারিশভাবে ঘুরে বেড়ানো লাইকা নামের সেই কুকুরটিকে।
এই অভিযানের সাথে সংশ্লিষ্ট একজনের মতে; "লাইকা বুদ্ধিদীপ্ত এবং শান্ত স্বভাবের ছিল, তাকে ট্রেনিং দেয়া সহজ ছিল। আদুরে চেহারার ছিল; তার চোখের রং ছিল কালো, তার চোখ যেন কথা বলতো!"
কিন্তু রাস্তা থেকে তুলে আনার পরই শান্ত স্বভাবের লাইকার জীবনে নেমে আসে দুর্যোগ। মুক্ত লাইকাকে পরাধীনতার শিকল পড়িয়ে দিনের পর দিন নিষ্ঠুরভাবে ট্রেনিং দেয়া হয় মহাকাশে পাঠানোর জন্য। যেহেতু স্পুটনিক-২ একটি ছোট আকৃতির স্পেসক্রাফট, তাই লাইকাকে একটি ছোট খাঁচার মধ্যে ২০ দিন আটকে রাখা হয় যাতে সে স্পেসক্রাফটের ছোট্ট কেবিনে আবদ্ধ থাকতে পারে। সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা কুকুরটির স্বাভাবিক খাবারদাবারও বদলে ফেলেছিল৷ এমনই নির্মম সব ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে লাইকাকে তৈরি করা হয়েছিল মহাকাশ অভিযানে পাঠানোর জন্য। যা আপাতদৃষ্টিতে ট্রেনিং মনে হলেও আসলে তা অসহায় লাইকার জন্য টর্চারের মতো ছিল।
সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা জানতো কীভাবে মহাকাশে যেতে হয়, কারণ তারা ইতোমধ্যেই স্পুটনিক-১ সফলভাবে লঞ্চ করেছে। তবে তারা যেটা জানতো না সেটা হলো, মহাকাশ থেকে কীভাবে ফিরে আসতে হয়! তাই সহজেই আমরা বুঝতে পারি যে, লাইকা নামের হতভাগা কুকুরটির জন্য এটি শুধুই একটি সুইসাইডাল স্পেস মিশন ছিল, যে মিশনে মৃত্যুই তার অবধারিত গন্তব্য।
লাইকা কি তার আশু পরিণতির কথা একবারও আন্দাজ করতে পেরেছিল? সে কি বুঝতে পেরেছিল যে, আর মাত্র অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই তাকে পরিকল্পিতভাবে চিরদিনের জন্য পৃথিবী থেকে বের করে দেয়া হবে? হয়তো জেনেছিল, হয়তো বা না৷
কিন্তু এই পরিকল্পনার সাথে যুক্ত বিজ্ঞানীরা সবাই এটা জানতো। তাদের মধ্য থেকে একজনের খুব মায়া হয় লাইকার জন্য, তিনি লাইকাকে গবেষণাগার থেকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান, নিজের সন্তানদের সাথে খেলতে দেন। লাইকাকে শেষবারের মতো কিছু ভালো মূহুর্ত উপহার দেন তিনি।
১৯৫৭ সাল, নভেম্বরের ১ তারিখ; লাইকাকে শিকল দিয়ে বেঁধে স্পুটনিক-২ এর ছোট্ট কেবিনে প্রবেশ করানো হল। আর ওভাবেই স্পুটনিক-২ এর কেবিনে কুকুরটিকে তিনদিন রাখা হল যাতে সে মহাকাশযাত্রার সময়েও এরুপ পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে পারে। তারপরই আসে সেই মুহুর্ত, পৃথিবী থেকে কোনো প্রাণীর সর্বপ্রথম মহাকাশযাত্রার ঐতিহাসিক মুহুর্ত, লাইকার পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেওয়ার মুহুর্ত।
১৯৫৭ সাল, নভেম্বরের ৩ তারিখ; পৃথিবীতে লাইকার জীবনের শেষ দিন৷ স্পুটনিক-২ স্পেসক্রাফট লাইকাকে নিয়ে উড়াল দেয়ার আগে একজন সোভিয়েত টেকনিশিয়ান লাইকার নাকে চুমু খেলেন, উপস্থিত সবাই লাইকাকে অশ্রুসিক্ত চিরবিদায় জানায়। কারণ তারা জানতো লাইকা আর কোনোদিন ফিরে আসবেনা এই পৃথিবীতে।
স্পেসক্রাফট স্পুটনিক-২ উৎক্ষেপণ করা হল; সেই সাথে লাইকাও রওয়ানা দিল অজানা গন্ত্যব্যে, চিরদিনের জন্য। কিন্তু টেকনিশিয়ানের ভুলে মহাকাশযানের একটি অংশ রকেট থেকে আলাদা হতে পারেনি। আসলে, একটি মহাকাশযান তৈরির জন্য চার সপ্তাহ সময় যথেষ্ট নয়। আর, এই ত্রুটির কারণে লাইকাকে বহনকারী মহাকাশযান স্পুটনিক-২ এর কেবিনে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে লাইকার হার্টবিটও বাড়তে থাকে। তীব্র তাপে লাইকার হার্টবিট স্বাভাবিক ১০০ থেকে ২৪০ এ পৌঁছে যায়!
লাইকার কেবিনের তাপমাত্রা এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, একসময় কেবিনের সেন্সর থেকে সংকেত আসাও বন্ধ হয়ে যায়। সেই মুহুর্তে দূরের আকাশে ভাসমান স্পেসক্রাফটের উত্তপ্ত ছোট্ট কেবিনে শিকলে বাঁধা অবস্থায় মৃত্যুর সাথে লড়তে থাকা অসহায় লাইকার অবস্থা কেমন হয়েছিল তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। প্রচণ্ড গরমে পুড়তে পুড়তে জীবনের সাথে টানা তিন ঘন্টা লড়াই করে অবশেষে হার মানে লাইকা, মহাকাশেই পরলোকগমন করে সে।
মৃত্যুর আগে লাইকা পৃথিবীকে চারবার প্রদক্ষিণ করে। ওই অবস্থায়ই ১৬২ দিন মহাকাশে ছিল স্পুটনিক-২, মৃত লাইকাকে নিয়ে ২৫৭০ বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে মহাকাশযানটি৷
১৪ই এপ্রিল ১৯৫৮; স্পেসক্রাফট স্পুটনিক-২ পৃথিবীর এ্যাটমোস্ফিয়ারে প্রবেশ করার সময় মৃত লাইকাসহ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। শেষ হয় সোভিয়েত বিজ্ঞানীদের নিষ্ঠুর এক্সপেরিমেন্টের শিকার লাইকার মহাকাশ অভিযান।
আজকের বিজ্ঞান মানুষকে পৃথিবীর বাইরে বসবাসের স্বপ্ন দেখাচ্ছে, মানুষ চাঁদে পদচিহ্ন এঁকেছে। একদিন হয়তো মঙ্গলগ্রহেও পৌঁছে যাবে পৃথিবীর মানুষ, কিন্তু মহাজাগতিক অগ্রযাত্রার ইতিহাসে লাইকার অবদানের কাছে বিজ্ঞান চিরকাল ঋণী থেকে যাবে...