কয়টা টাকা লাগে এক-দেড়শো ডাক্তার নার্সকে তিন-চার বেলা খাবার দিতে? কয় হাজার কোটি টাকা দরকার? কেন বেসরকারী একটা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে এসে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে?

একাত্তর টেলিভিশন একটা রিপোর্ট করেছে, ভয়াবহ এক তথ্য উঠে এসেছে সেখানে। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের নার্সরা খাবার পাচ্ছেন না, ফোনে কান্নাকাটি করে তারা বলছেন, তাদের ভাত দেয়া হচ্ছে না, তারা মোটামুটি না খেয়েই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন! করোনার এই আপৎকালে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল হচ্ছে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, সর্বোচ্চ মনযোগটা সেখানে দেয়া উচিৎ, অথচ সেখানকার নার্সদের পেটে খাবার নেই- এটা ভাবতেও তো শিউরে ওঠা লাগে!

নার্সিং ইন্সটিটিউটের উপ-পরিচালকের কাছে সাংবাদিকেরা জানতে চেয়েছিল, কেন নার্সরা না খেয়ে আছেন, কেন তাদের খাবার দেয়া হচ্ছে না। উপ-পরিচালক জবাব দিয়েছেন, নার্সদের খাওয়ানোর জন্যে তাদের কাছে নাকি বাজেট নেই। এছাড়া খাবার সরবরাহের দায়িত্বে যে লোক ছিল, সে নাকি পালিয়ে গেছে করোনার ভয়ে, সেকারণে খাবার দেয়া যাচ্ছে না ঠিকমতো!

আর ইউ *কিং কিডিং আস? এটা কি কোন কমেডি সিনেমার স্ক্রিপ্ট? নইলে এরকম উদ্ভট আর গাঁজাখুরি যুক্তি কোত্থেকে আসে? নার্সদের খাওয়ানোর বাজেট নেই? তাহলে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালকে করোনার জন্যে স্পেশালাইজড হিসেবে প্রস্তুত করার সিদ্ধান্তটা কে নিয়েছিল? কেন নিয়েছিল? করোনায় আক্রান্ত রোগীদের জন্যে এই হাসপাতালকে হেডকোয়ার্টার হিসেবে বানানোর আইডিয়াটা কার মাথা থেকে বেরিয়েছিল?

কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের ছয় চিকিৎসককে বরখাস্তের খবরে অনেককেই উল্লাস প্রকাশ করতে দেখেছি ফেসবুকে। ‘চাকরি করবি, বেতন নিবি আর রোগীর সেবা দিবি না, এটা কেমন কথা রে কসাইয়ের দল?’- এরকম ডায়লগ ঝাড়তে দেখেছি অনেক ইঁচড়ে পাকা লোকজনকে। কিন্ত মুদ্রার উল্টো পিঠ বলেও তো একটা কথা আছে, এখন যেমন জানা যাচ্ছে যে, এই ছয়জনের মধ্যে কয়েকজনকে একদম বিনা কারণেই চাকরীচ্যুত করা হয়েছে, কাউকে লঘু পাপে দেয়া হয়েছে গুরুদণ্ড। কেউ হয়তো উচ্চপদস্থ কর্তার ফোন ধরতে পারেননি, কারো ডিউটি টাইম অন্য রোস্টারে ছিল- তাকে না পেয়ে সরাসরি বরখাস্তের আদেশ দেয়া হয়েছে- এমন দাবী করছেন ভুক্তভোগী চিকিৎসকরা।

ফেসবুক লাইভে এসে বলা বা মিডিয়ার সামনে মুখ খোলা এই চিকিৎসকদের একটা কথায়ও আমি বিশ্বাস করলাম না। ধরে নিলাম, কর্তৃপক্ষ সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এই চিকিৎসকরা অন্যায় করেছেন বলেই তাদের চাকরি কেড়ে নেয়া হয়েছে। তাহলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে শুরু থেকেই অদক্ষতার পরিচয় দিয়ে আসছে, একের পর এক বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করে যাচ্ছে, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারছে না, সর্বোপরি ‘আমাদের সব প্রস্তুতি নেয়া আছে’ বলে মুখে ফেনা তুলে ফেললেও সেই প্রস্ততির ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না কোথায়- সেসবের দায় নেবে কে? স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বরখাস্ত করবে কে? সচিবের চাকরি যাবে না কেন?

কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল

এই দেশের মেডিকেল খাতে কি পরিমাণ দুর্নীতি হয়, সেটা প্রায় সবাই জানে। সরকারী হাসপাতালগুলোতে লাখ টাকার যন্ত্রপাতি কিনে কোটি টাকা বিল করা হয়, নষ্ট মেশিন নিয়ে আসা হয়, সেটা কাজ না করলেও টেকনিশিয়ানকে বেতন দেয়া হয় বছরের পর বছর ধরে। অথচ কোপ দেয়ার বেলায় সবার আগে ডাক্তারদের মাথাটাই খুঁজে পায় সবাই। প্রধানমন্ত্রী ডাক্তারদের প্রশংসা করে স্বাস্থ্য বীমার কথা বলেন, অথচ বাস্তবে আমরা দেখি ডাক্তার আর নার্সদের কান্না, তাদের খালি পেটে থাকা। ছয়জন ডাক্তারকে বরখাস্ত করার আগে এগুলো একটু ভাবা উচিত ছিল না?

একবারও কি কেউ ভেবেছে, কেউ খোঁজ নিয়েছে যে এই লকডাউনের মধ্যে ডাক্তার বা নার্সরা যে বাসায় যেতে পারছেন না, মানুষগুলো কি খেয়ে ডিউটি করছেন, নাকি না খেয়ে করছেন, নাকি শুকনো পাউরুটি আর কলা খেয়ে থাকছেন- সেই খবর রেখেছে কেউ? সরকার বারবার বলছে চিকিৎসকরা আমাদের ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র, সেই ওয়ারিয়রদের জন্য কী সুব্যবস্থা রাখা হয়েছে? সবাই তো এখনও পিপিই’ই পায়নি, নিজেদের কেনা গ্লাভস আর মাস্ক পরে কাজ চালাচ্ছেন অনেকেই।

হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয় এদেশে, সাবেক অর্থমন্ত্রীর কাছে তো চার হাজার কোটি টাকা কোন টাকাই ছিল না। প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়া হয় সত্তর-আশি হাজার কোটি টাকার, অথচ না খেয়ে থাকেন ডাক্তার-নার্সরা, যারা কিনা সামনে থেকে লড়ছেন করোনার বিরুদ্ধে, সেবা দিচ্ছেন আক্রান্ত রোগীদের। কয়টা টাকা লাগে এক-দেড়শো ডাক্তার নার্সকে তিন-চার বেলা খাবার দিতে? কয় হাজার কোটি টাকা দরকার? কেন বেসরকারী একটা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে এসে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে? করোনা চিকিৎসার ফ্ল্যাগশিপ হাসপাতালেই এই অবস্থা! এটা কি লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার মতো ঘটনা না?

অনেকেই বলবেন, ডাক্তারদের এত তেল দেয়ার কিছু নেই, কাজের বিনিময়ে তারা তো বেতন পাচ্ছেন। একদিনে যে বেতনটা একজন ডাক্তার পান, সেটা কাউকে দেয়া হলে তিনি কি কুয়েত মৈত্রীতে একটা রাত কাটাতে রাজী হবেন? যে দেশের মানুষ নিজের এলাকায় কোয়ারেন্টাইন জোন বানাতে দেয় না, এলাকার হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা দেয়ার কথা শুনলে হাসপাতাল ভাঙতে তেড়ে আসে, সর্দি-জ্বরে মারা যাওয়া মানুষকে কবর দিতে দেয় না এলাকার কবরস্থানে- সেই দেশের মানুষ যখন ডাক্তার-নার্সদের ডেডিকেশন নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তখন মুখ খারাপ করে গালাগাল করতে ইচ্ছে হয় ভীষণ।

কি জানি, কাল হয়তো কান্নাকাটি করা এই নার্সদের কাউকে বরখাস্ত করা হবে ‘শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ’ দেখিয়ে। অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে মুখ খোলাটাও তো একটা বিশাল অপরাধ, বড় কর্তাদের ভুল সামনে আনার মতো পাপ আর হয় নাকি? হয়তো শুনতে পাব, এই নার্স বা ডাক্তারেরা আসলে করোনা রোগীদের সেবা দিতে চাইছিলেন না, এজন্যেই কান্নাকাটির নাটক করেছেন! হীরক রাজার দেশে যে সবই সম্ভব!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা